কাকাবাবু: তোমায় খুব মিস করছি!
মো.ফরিদ আহমদে: বাবা – মা। দুনিয়ার সবচেয়ে আপনজন। মহান সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেককে তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী মা বাবার মাধ্যমে দুনিয়ায় সৃষ্টি করেছেন। মায়ের গর্ভে দশমাস দশদিন কেটে পৃথিবীতে আগমন। তাই “মা”-কে উত্তম আসনে রাখা হয়েছে। তাই বলে বাবার মর্যাদারও বিন্দুমাত্র কমতি নেই।
…
পৃথিবীতে এমন কিছু মহৎ লোকের আগমন ঘটে কালে কালে যাঁরা তাদের মহতী হৃদয়ের ভালবাসা দিয়ে অনেকের হৃদয়ে চির স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকেন চিরকাল। আমার হৃদয় জুড়ে রয়েছেন একজন মহান ব্যক্তি। তাঁকে আমি ‘কাকাবাবু’ বলে ডাকতাম। একজন আদর্শ বাবার মতো স্নেহ, আদর, ভালবাসা দিয়েছেন আমাকে। আমাকে নিজ সন্তানের মতো স্নেহে সিক্ত করেছেন। আমাকে মনি বলে ডাকতেন যা শুনে আমার প্রাণ আনন্দে ভরে যেত। আমার জন্মদাতা না হলেও তারচেয়ে তিনি কোন অংশেই কম নয়। এই মহৎ মানুষটি আমাদের রেখে ২০০৬ সালের ২৮ আগষ্ট না ফেরার দেশে চলে গেলেন। আর আদরমাখা ” মনি ” ডাক শুনতে পাই না সেই থেকে।
…
আমি যাঁর কথা বলছি তিনি যশস্বী সুনীল ব্যানার্জি। তিনি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক। তাঁর সততা, কর্ম, প্রতিভা ও মিষ্ট ব্যবহার সবাইকে আনন্দ দিতো। সবদিক দিক দিয়েই কাকাবাবু ছিলেন সৎ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন সৎ, সরল ও সহজ মানুষ। তাঁর সাথে আমার পরিচয় ১৯৯৭ সালে। তিনি কখনও-ই আমাকে সন্তান ছাড়া অন্য দৃষ্টিতে দেখতেন না। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডে তাঁর বাসায় যাতায়াত ছিলো আমার নিজের বাড়ির মতো। তাঁর হাসিমাখা মুখখানি এখনো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
…
তাঁর একমাত্র সন্তান সাংবাদিক শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ। কেমন আছে সে আজ? বাবা বলে জড়িয়ে ধরতে পারেনি দশটি বছর। বাবার আদর্শ ধরে রাখতে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে সাংবাদিকতা পেশা বেছে নেন। মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাবস্থায় পিতৃবিয়োগ হলে একজন মানুষের জীবনে কত কিছু সামাল দিতে হয়েছে তার একমাত্র উদাহরণ শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ। যখন তার ক্যারিয়ার গঠন করার সময়, তখন মা সহ একটি পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার কঠিন বাস্তবতা কেমন একমাত্র শুভদা ভালোই জানেন। আসলে দেহের চেয়ে মোনের বেদনা কতটা তীব্র তা ভুক্তভোগী ও ঈশ্বর ছাড়া কারো বোঝার সাধ্য নাই।
…
আজ বিশ্ব বাবা দিবস। সবাই যে যার বাবাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। স্মৃতি স্মরণ করছে। আমি ঢাকায়। বাবা থাকেন পিরোজপুর। দুরত্ব অনেক। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাবার চরণ আজ স্পর্শ করতে পারিনি। এটা বাস্তবতা। তবে, আমাকে মোবাইল ফোনে শুভেচ্ছা জানাতে পেরেছি। প্রযুক্তির এই যান্ত্রিক জীবনে এটাতে-ই সন্তুষ্ট। বাবার আশীর্বাদ কী দূরত্ব মানে? কিংবা বাবার প্রতি আমার যে ভালোবাসা, সেটা কী তাকে বলে বোঝানো যায়? তবুও এই বিশেষ দিনে বাবা’র সাথে কথা বলার অনুভূতি যেন অন্যরকম। এই ভালোলাগা শান্তির। সিক্ত প্রশান্তির। যেই শান্তি বা প্রশান্তি থেকে আজ বঞ্চিত অনেকে। যাদের বাবা প্রয়াত তাদের সকলের প্রতি সমবেদনা জানাই। নিজেকে আমি ভাগ্যবান মনে করছি। আমি অন্তত এখনও পিতার স্নেহের পরশ থেকে বহ্ছিত নই। সৃষ্টিকর্তাকে এজন্য অশেষ ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা।
….
কাকাবাবু আজ আমাদের মাঝে নেই। ১০ বছর আগে এই দিবসটির এতো প্রসার ছিলো না। তবুও তাঁর বাসায় আমার অবিচল যাতায়াত ছিলো। সেটা এখনও আছে। আজও গেছি। ফুল নিয়ে তাঁর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছি। তাঁর অবর্তমান যেন আমাদের জীবনে কালো রাত্রি ঘনিয়ে এসেছে। যে বাসাটি এক সময় থাকতো প্রাণ চঞ্চল, সেটি আজ নীরব। অন্ধকার। অসুস্থ্য কাকীমা। এক প্রকার শয্যাশায়ী। কাকাবাবু’র পুত্র শুভাশিস বিমর্ষ। যে ছেলেটিকে আমি অনেক ছোট্রকাল থেকে চিনি, জানি, তার মুখের হাসি আজ ম্লান। একজন বন্ধু হিসেবে কিংবা বড় ভাই হিসেবে উপদেশ দেয়া যায়। কিন্তু তার হৃদয় গহীনের তীব্র জ্বালা দূর করার সাধ্য কার? যে ছেলেটি সারা জীবন চলেছে বাবার হাত ধরে, আজ তার হাত দু’টি বাবাকে স্পর্শ করতে পারছে না। আমি তাকে কি বলে শান্তণা দেবো? একজনের অনুপস্থিতি-তে একটি পরিবারে কী ধরণের বিপর্যয় নেমে আসে সেটা আমি দেখেছি। শুভাশিসের নির্ঘুম রাত্রির বেদনা, রাতের আকাশে তারাদের ভীড়ে বাবাকে খুঁজে বেড়ানোর ভ্রান্ত প্রয়াস কিংবা তার ক্লান্ত ভারাক্রান্ত মুখটি আমাকে পীড়ি দেয়। মনকে ভারাক্রান্ত করে। আজ বুঝতে পারছি, কাকাবাবুকে আমি কতোটা ভালোবাসতাম। হয়তো সেই ভালোবাসার কোন মানদণ্ড নেই। শত শত দিন, হাজার হাজার মুহূর্ত কাকাবাবুকে কাছে পেয়েও বলা হয়নি,”আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি।” আজ বলার ইচ্ছেটা প্রবল। কিন্তু সুযোগ নেই। আছে শুধু কিছু স্মৃতি। ভালোবাসার এই বন্ধন চিরদিন-ই অদৃশ্য। তবে, সময় সুযোগ মতো সেটা প্রকাশে মনের ব্যথা কমে। হতাশার জন্ম হয়না। শুভাশিস যেমন আজ তার বাবাকে স্মরণ করছে আমিও তেমনি কাকাবাবুকে মিস করছি…!
[মো.ফরিদ আহমদে: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।।]
rosemoni75@gmail.com