জীবনের কঠিন অমোঘ নিয়তি অনুযায়ী

জীবনের কঠিন অমোঘ নিয়তি অনুযায়ী
ছবি: শাকিল আহমেদ।

শাকিল আহমেদ: নিজের মত অপরের ওপর জোর করে চাপানোর পথই–জংগীবাদ । সেই পথের প্রথম পাঠ কিন্তু–গালি । অর্থাত গালিগালাজ। যুক্তি যখন অন্ধ হয় এই “গালি” তখন অক্ষমের আশ্রয় । অনেক না পাওয়ার দেশে গালিই আবার অনেক মানুষের আত্মার তৃপ্তি । এই গুন থেকে নিজেও অনেক সময় তাই মুক্ত হতে পারি নি। সেই জন্য গুলশান এ্যটাকের সরাসরি সম্প্রচারের সময় বেশ কিছু তথ্যে যারা গালি দিচ্ছেন –তাদের প্রতি আমার এখনও সম্মান! তবে ভাষা মানুষের পরিচয় তুলে ধরে এও মানতে হচ্ছে । সম্মান এই কারনে বলছি , আমিও যদি বুঝে থাকি একজন মৃত্যপথযাত্রী মানুষ লুকিয়ে থাকলে তার খবর যদি আমি খুনীকে জানিয়ে দেই … নিশ্চয়ই অবশ্যই আমারও রাগ হবে ! কিন্তু সহজ একটি সত্য অনেকেই মিস করে গেছেন। রেস্টুরেন্টের ছোট্র টয়লেটে লুকিয়ে থাকা ছেলেটি (অনেকেই নাম জানেন, আমি/আমরা না বলি)সহ আরও অন্তত ৯ জনের অবস্থান জংগীরা তখনই জেনে গিয়েছিল । বাইরে থেকে তারাই আটকে রেখেছিল টয়লেটের দরজা । পরদিন সকালে অপারেশনের আগে লন দিয়ে হেটে যারা মুক্ত হয়ে এসেছেন, তাদের বাইরে খুব সম্ভব এই দলটিকেই আরও কজন আহত বিদেশী সহ উদ্ধার করেছে যৌথ বাহিনী। এবং এরা প্রত্যেকে জীবিত আছেন ।এটি কেন আমাদের বোধে আসে না , জংগীরা কেন রেস্টুরেন্টে ঢুকে ওই ভবনের প্রতি ইন্চি দখলে বুঝে নেবে না?


ফলে টয়লেট /বাথরুমে লুকিয়ে নয় সমীরেরা মূলত সেখানে আটক ছিলেন। আর সেই কথাটিই রেস্টুরেন্টের বাইরে অপেক্ষার প্রহর গোনা ভাইয়ের কাছে এসএমএস এ লিখছিলেন-সেই ছেলেটি। তার স্ক্রীন শটও রেখে দিয়েছেন আমাদের প্রতিবেদক। ফেসবুকে সেলফি তুলে ছেলেটি তা্ই তাদের উদ্ধারের জন্য আহবান জানাচ্ছিলেন। এখন জীবন বাচানোর ওই আহবান যদি সাংবাদিক প্রচার করেন, তাহলে তার দোষ হবে? তখনও আপনি গালি দেবেন ? ..সত্যিই আমি বুঝতে চাই । মনে পড়ছে , মুম্বাই এ্যাটাকের সময় এনডিটিভি হোটেলের বিভিন্ন রুমে লুকিয়ে থাকা বোর্ডারদের লাইভ টেলিফোন সাক্ষাতকার নিয়েছিল! গুলশান রেস্টুরেন্টে বিভিন্ন জিম্মীদের কখন মেরে ফেলা হয়েছে এবং সাংবাদিক হিসেবে আমরা তার কতটা তখনই জানতে পেরেছি সেই বিস্তারিত বিশ্লেষনেও না যাই । তবে সরাসরি সম্প্রচার নিয়ে অনেকেই র্যা ব কর্তার নির্দেশ না মানায় যে আক্ষেপ করেছেন , সে বিষয়ে শুধু এইটুকু বলতে চাই । একাত্তর টেলিভিশন রাত ৯ টার দিকের ওই ঘটনার প্রথম লাইভ সম্প্রচার শুরু করে রাত ১১ টারও বেশ পরে । ততক্ষণে অন্যান্য সব নিউজ টিভি দেড় ঘন্টারও বেশী লাইভে আছে । আমরা পরিস্থিতি বোঝার চেস্টায় ছিলাম । এবং আমাদের কারিগরি ক্রটিও ছিল । কিন্তু যখন , আইনশৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে লাইভ সম্প্রচারে না যাওয়ার পরামর্শ আসে আমরা একদম কালক্ষেপন না করে লাইভ বন্ধ করে দেই । তারও প্রায় এক ঘন্টা অন্য কয়েকটি টিভি সরাসরি সম্প্রচার করছিল । ফলে আমরাই অন্য সব টিভির তুলনায় ওই রাতে সর্বোচ্চ কম সময় লাইভে ছিলাম ! কেবল আমাদের টিভি যারা দেখেছেন তারা এটি বুঝতে নাও পারেন । একাধিক টিভি যারা দেখছেন তারা এই সত্য জেনে থাকবেন । রাতভর আমরা বহু খবর জেনেছি , কিন্তু আমরা কেবল পুরোনো ছবি প্রচার করেছি । এমন ছবি যা্তে আইন শৃংখলা বাহিনীর অপারেশনের কোন দৃশ্য না থাকে । পরের দিন সকাল দশটার আগ পর্যন্ত আমরা আর সরাসরি ছবি সম্প্রচারে ছিলাম না । অন্য টিভি সকাল ৭ টা থেকে লাইভে ছিল।

ঘটনার পুরো সময় আমরা কেবল টেলিফোনে নিরাপদ তথ্য পাওয়ার চেস্টা করেছি। কেন লাইভ টেলিফোন নিয়েছি? সেটি একেবারেই ভিন্ন বড় আলোচনা । নিশ্চয়ই সরাসরি টিভি সাংবাদিকতা নিয়ে আমার/আমাদের অবস্থান জানানোর চেস্টা ভবিষ্যতে করবো । এইটুকু বলি , একাত্তরের রক্তের পরম্পরা নিয়ে আমরা যারা একাত্তর টিভিতে কাজ করি , যারা আমরা দেশে সরাসরি সম্প্রচার শুরু করেছি , জনমনে ভুল ব্যাখ্যার দায়ও নিশ্চয়ই আমাদেরই । ফলে গালি যদি প্রাপ্য হয়-হোক । তবে , কেবল টিআরপি বাড়ানোর জন্যই সাংবাদিকেরা দৌড়ায় এই যে মনোভাব সমাজে অনেকের তার দায়ও বোধহয় আমাদেরই । আমার বন্ধুদের পাচগুন স্যালারীতে যখন আরামের জীবন, আর আমরা যখন জংগী হুমকি নিয়েও বুক সোজা করে দাড়াই, শো ছেড়ে দিয়ে অন্য চাকরীতে চলে যাই না, নিশ্চয়ই –জীবনের কঠিন অমোঘ নিয়তি অনুযায়ী –গালিতো আমরাই খাব। কারন আমাদের মাথায় টিআরপি ছাড়া আরতো কিচ্ছু নাই….

[লেখক: হেড অফ আউটপুট, একাত্তর টিভি।]

অতিথি লেখক