সমাজের নিয়ম-কানুন কি পরিবর্তনশীল?

সমাজের নিয়ম-কানুন কি পরিবর্তনশীল?
ছবি: খুরশীদ শাম্মী।

খুরশীদ শাম্মী: ধর্মীয় ইতিহাসে আদম এবং হাওয়াকে নিয়ে পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির নানান রঙিন গল্প থাকলেও বর্তমান বিজ্ঞানের জগতের একমাত্র সভ্য প্রাণী মানুষ কিন্তু একদিনে সৃষ্টি হয়নি। কোটি কোটি বছর পূর্বে একাধিক নির্দিষ্ট জৈবিক অণুতে বিক্রিয়া করে বিশেষ এক ভ্রূণ তৈরি হয়ে মানুষের জীবনের উৎপত্তি হয়েছে। এবং কোটি কোটি বছর ধরে বিভিন্ন বিবর্তনের ফলে আঁকার আকৃতি পরিবর্তিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে আজকের মানুষ।

.
একটু লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাই যে আধুনিক মানুষদের গড়ন, আঁকার আকৃতি, লক্ষ বছর আগের মানুষদের শারীরিক গঠন থেকে কিছুটা হলেও ভিন্ন। আরো এক লক্ষ বছর পর হয়তো মানুষের দৈহিক গঠনে আরো পরিবর্তন দেখা যাবে।

.
ঠিক একইভাবে মানুষের চলন, বলন, খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, পারস্পরিক সম্পর্কের মতো বিষয়গুলো কালের বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়েছে। এবং মানুষ ধীরে ধীরে বন্য থেকে সভ্য এবং সামাজিক জীবে রূপান্তরিত হয়েছে। মানুষের তৈরি এই সমাজই মানুষকে কিছু নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে বেঁধে সুষ্ঠু এবং সুশৃঙ্খল পথে পরিচালিত করে। প্রতিটি মানুষ তার জীবনের সুন্দর দিকগুলোর জন্য সমাজের প্রতি কোন না কোন ভাবে কৃতজ্ঞ। আমাদের জীবনে সমাজের প্রাধান্য দিতে আমরা কথায় কথায় বলে থাকি, মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের নিয়ম কানুন মেনে চলা প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।

.
এখন প্রশ্ন হলো, সমাজের নিয়ম কানুনগুলো কি পরিবর্তনশীল?

.
এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক সূত্র কিংবা তত্ত্ব গবেষণার দরকার হয় না। খুব সাধারণ দৃষ্টিতেও স্পষ্ট দেখা যায় যে, বিশ্বের যাহা কিছু মানুষ দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে তাহার সকল কিছুই সময়ের ব্যবধানে পরিবর্তন হয়ে আসছে। সুতরাং সমাজের নিয়মকানুনগুলোও পরিবর্তনশীল।

.
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, এই পরিবর্তনশীল বিশ্বে সমাজের নিয়ম-কানুনগুলোর তালিকা, বর্ণনা, এবং তা পালনের নির্দেশনার দায়িত্বে সময়ের ব্যবধানে যারা যখন থাকেন তারা মনে প্রাণে কতটা নিরপেক্ষ? নিঃস্বার্থ? কতটা মুক্তমনা? এবং তারা তাদের নিজেদের কর্তব্যের প্রতি কতটাই বা শ্রদ্ধাশীল?

.
ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যায় যে মানব সভ্যতা সৃষ্টির সেই প্রথম থেকেই মানুষ নিজেদের জীবনের আবির্ভাব, ধর্ম বিশ্বাসের মতো বিষয় নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। বর্তমান বিজ্ঞানের যুগেও এর কোন ব্যতিক্রম হয়নি, বরং দিনদিন এই বিভাজন কঠিনতর হচ্ছে। তবে শুরু থেকেই সমাজে একদল মানুষ আছেন যারা বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে মানুষে মানুষে বিভাজনকে উপেক্ষা করে নিরপেক্ষ থেকে নিজেদের শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে নানাভাবে মানব সমাজের সেবা করে আসছেন। তারা তাদের কর্মে এবং গুণে সমাজে মহান ব্যক্তি বলে পরিচিত। সাধারণ মানুষ তাদের সর্বদা সম্মান করে। তারা সমাজের নীতিনির্ধারক সহ আরো নানান গুরুত্বপূর্ণ পদের অধিকারী হন। ঐ সকল প্রকৃত সমাজ সেবকদের মহান জীবনে ঈর্ষান্বিত হয়ে একদল সুবিধাবাদী মানুষ, মানব জাতির সামগ্রিক কল্যাণের কথা না ভেবে, কেবল নিজেদের স্বার্থ আদায় করার লোভে কৌশলে সমাজের প্রথম সারিতে থাকার চেষ্টা করে আসছে।

.
অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা তাদের লজ্জার মাথা খেয়ে, চাটুকারিতা করে ইনিয়ে বিনিয়ে উদ্দেশ্যানুযায়ী প্রভাবশালী হয়ে উঠে। কোন প্রকারে একবার তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম হওয়ার সাথে সাথে, তারা তাদের চারপাশে নিয়োজিত করে তাদের মতো আরো কিছু স্বার্থ-লোভীদের। এবং পরবর্তীতে নিজেদের রক্ষা করতে সর্বদা জিইয়ে রাখে ঐ সকল চাটুকার। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন তাদের প্রকৃত চেহারা জনগণের কাছে উন্মোচন হয়, সাধারণভাবেই তখন তারা প্রথম সারিতে থাকতে ব্যর্থ হয়।

.
তারা তখন তাদের পালিত চাটুকারদের দ্বারা সমাজে নানান প্রকার নেতিবাচক কর্মকাণ্ড করে সমাজে ত্রাস সৃষ্টি করে। যা কিনা সাধারণ জনগণের মধ্যে এক প্রকার বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে প্রকৃত সমাজসেবকদের ঘাড়ে সকল ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে দেয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তারা নিজেদের স্বার্থে, সামাজিক নিয়মকানুনগুলোর মূল বক্তব্য কিছুটা ঠিক রেখে, সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে, পরিবর্তন করে সমাজের প্রচলিত নিয়ম-শৃঙ্খলার বর্ণনা এবং তা মেনে চলার পদ্ধতি। তাদের চারপাশের চাটুকার এবং অন্যান্য সুবিধাবাদী মানুষেরা চলতে চেষ্টা করে একই নীতিহীন অন্যায়ের পথে। ধীরে ধীরে ভুল পথের ঐ নীতিহীন কাজগুলো একদিন খুব স্বাভাবিক বলে মনে হয় তাদের কাছে। সাধারণ দৃষ্টিতে তখন তারা নিজেদের জয়ী মনে করে। তারা নিজেদের প্রভাবশালী ভাবতে শুরু করে এবং মনে করে সমাজ তাদের দ্বারা চালিত হচ্ছে।

.
আর যারা মানব সমাজের কল্যাণের আশায় কর্তব্যপরায়ণ হয়ে শিক্ষা, সততা এবং নিষ্ঠার সাথে সঠিক পদ্ধতিতে সমাজের সকল নিয়মকানুন ভেবে চিন্তে মেনে চলে। তাদের সহজ এবং সঠিক চলার পথে কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়ায় ঐ সকল সুবিধাবাদী এবং অসৎ মানুষদের কর্মকাণ্ড। তখন প্রকৃত সমাজসেবক এবং আইনের প্রতি এবং সমাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষদের চলতে হয় চলমান অন্যায়ের স্রোতের বিপরীতে। তারা বিশ্বাস করে, “স্রোতের বিপরীতে পথ চলতে কায়িক পরিশ্রমের চেয়ে মানসিক যন্ত্রণা সবসময়ই অনেক বেশী অনুভূত হয়। তবুও নীতিহীনতায় গা ভাসিয়ে দেয়াটা অনুচিত।” তাদের পথচলা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। আপাতদৃষ্টিতে তাদের পরাজয় মনে হলেও, জয় কিন্তু সততার ই শত ভাগ। তারা সতর্কতা অবলম্বন করে। শক্ত করে সত্যের হাল ধরে সঠিক পথে চলতে চেষ্টা করে। তাদের সাথে থাকে কেবল তাদের সততা, নিষ্ঠা, সুশিক্ষা, আত্মবিশ্বাস এবং সাধারণ জনবল। সাধারণ জনবল যদিও সব সময় দেখা যায় না কিন্তু সময়মত উপস্থিত থেকে প্রকৃত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ায়, আর হুঙ্কার দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেয় যে তারা সমাজের মঙ্গল চায়। যেহেতু চাটুকারদের উদ্দেশ্য নিজেদের সুবিধা আদায় করা। যতক্ষণ সম্ভব তারা সুবিধাবাদী প্রভাবশালীদের পাশে ঘোরাঘুরি করলেও সাধারণ জনবলের কাছে হেরে যাওয়ার ভয়ে নিজেদের চেহারা পরিবর্তন করে নেয় এবং দল বদল করার চেষ্টা করে। একবারও ভাবে না যে সমাজ তাদের কিভাবে দেখে? তখন সমাজের কালো চাঁদরে ঢাকা সুবিধাবাদী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের লুকিয়ে চলতে হয়। চাটুকাররা নিজেদের চরিত্র উন্মোচন করে, এই দল সেই দল করে কাটায়। আর প্রকৃত সমাজসেবক নিজেদের মতো কাজ করে।

.
এভাবেই কালে কালে সাধারণ জনবল এবং প্রকৃত সমাজ সেবকদের সততা এবং নিষ্ঠার জয় হয়।

.
[খুরশীদ শাম্মী: প্রবাসী লেখক।।]


অতিথি লেখক