প্রধান বিচারপতি’র সমালোচনা কী যুক্তিসঙ্গত?

প্রধান বিচারপতি’র সমালোচনা কী যুক্তিসঙ্গত?

সৈকত রুশদী: বিদেশে নিরাপদ অবস্থানে থেকে তত্ত্বীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা অনেক কিছুই বলতে পারি। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বাংলাদেশে বাস্তবতা ভিন্ন। যেমন ছিল সামরিক শাসক পিনোশের চিলিতে। সরকারের বিপক্ষে মন্তব্য করলে, এমনকী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের বিরূপ মন্তব্যে ‘লাইক’ দেওয়ার জন্যও নাগরিকদের তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাসহ বিভিন্ন মামলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। জেল-জরিমানা হচ্ছে। সর্বোপরি, সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা মামলা ও গ্রেফতারসহ কতো ধরণের বিপদের মুখে পড়ছেন, তা’ কারও অজানা নয়। বিএনপির দ্বিতীয় সারির এক নেতা গুম হয়েছেন, আরেকজন গুম হতে হতে প্রাণে বেঁচে বন্দী ভারতে। আর কতো নাগরিক যে গুম হয়েছেন এবং বন্দুকযুদ্ধের নামে বিনা বিচারে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে খুন হয়েছেন, তার হিসেব নেই।


প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আর দশটা মানুষের মতোই দোষে-গুণে একজন মানুষ। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ, বিচারপতি মোস্তফা কামাল ও বিচারপতি মুহম্মদ হাবীবুর রহমানের মতো সাহসী তাঁকে আমার কখনোই মনে হয়নি। তিনি যে ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগের অনুসারী, এব্যাপারেও দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। কেবল একটি মাত্র পত্রিকা ‘দৈনিক জনকন্ঠে’ তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের এবং সেই অভিযোগের কারণে তাঁর ছুটি নিতে ‘বাধ্য হওয়া’র কাহিনী ছাপা হয়েছে। তাও প্রতিবেদন হিসেবে নয়। উপসম্পাদকীয় বা কলামে। এসকল অভিযোগ কোনো আদালতে এখনও প্রমাণিত হয়নি এবং প্রমাণসাপেক্ষ। বাংলাদেশে এরকম অভিযোগ যেকোনো সরকার ইচ্ছে করলে যেকোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে আনতে পারে। যেকোনো সময়।


বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ সত্য হোক আর মিথ্যা হোক, তাঁকে নিশ্চয়ই এই অভিযোগের কারণে দেশ ছাড়তে হয়নি। তাঁকে কী কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছে সেকথা সবাই জানে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রদান এবং রায়ের মন্তব্যের কারণে তাঁকে সরকার প্রধান, মন্ত্রিসভার সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক সাবেক বিচারপতিদের তীব্র সমালোচনা, মৌখিক আক্রমণ, তাঁর সংখ্যালঘু জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ করে অবমাননা, এমনকী দেশত্যাগে বাধ্য করার হুমকির পর্যন্ত মুখোমুখি হতে হয়েছে। অথচ তাঁকে নৈতিক সমর্থন দেওয়ার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ ও কিছু বাকপটুতা ছাড়া সাবেক বিচারপতি, আইনজীবী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলকেও দাঁড়াতে দেখা যায়নি। এরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কোন প্রধান বিচারপতি বা বিচারপতি কখনও পড়েননি। এই এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি।


দেশের এরকম ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীন পরিবেশে এবং ব্যক্তিগতভাবে হুমকি ও সমালোচনার মুখে এককভাবে বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাঁর কী কী করণীয় ছিল? আর দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার আগে তিনি যেটুকু বলেছেন স্পষ্টভাবে, সেখানে কী সৎসাহসের কোন অভাব লক্ষ্য করা গেছে?


প্রধান বিচারপতিকে হুমকির মুখে কথিত জোর করে ছুটিতে পাঠানো ও দেশত্যাগে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার যে অন্যায় করেছে এবং বিচারবিভাগের স্বাধীনতাকে ভুলুন্ঠিত করেছে, অনেকে একবারের তরেও তার সমালোচনা করবেন না! সমালোচনা করবেন অন্যায়ের শিকার ব্যক্তিটির, অনেকের প্রত্যাশামতো দু:সাহসী না হয়ে ওঠার কারণে!


আমি মনে করি, বিচারপতি সিনহা দেশ ছাড়ার আগে যে সাহসী বিবৃতি দিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তার চেয়ে বেশি কিছু করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলনা।


সৈকত রুশদী: প্রবাসী সাংবাদিক।।
টরন্টো, কানাডা,
১৪ অক্টোবর ২০১৭.

অতিথি লেখক