সাংবাদিকের_ডায়েরি…

সাংবাদিকের_ডায়েরি…

লুৎফর রহমান হিমেল: গ্রামে যাওয়া কম হয়। কিন্তু সবসময় গ্রামেই পড়ে থাকে মন। সশরীরে শুধু ঢাকায় থাকি। গ্রামে গেলেই খেয়াল করি তার নানা পরিবর্তন। সেখানে আবাদি জমিগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে খুব দ্রুত। উঠছে বাড়ি। এখানে সেখানে। পরিচিত জমির আইলের মানচিত্র রেখা বদলে যাচ্ছে। আমার হৃদয়ের কোনে আঁকা সেই উঁচু-নিচু নানা নামের জমিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। সেই তেতুল তলা, কলস তলা, জোঁকতলা, বাইদ, নইল্যাকুড়ি, হিজলতলা— সব স অ ব বদলে যাচ্চে। আমি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আসি। আমার শৈশবের বিচরণ করা স্মৃতি হাতড়ে ফেরা সেই গ্রাম-জমি-বসতবাড়ির সেই সোনালী মানচিত্র আর নেই। কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই।


জমিগুলো দেখে মনে হয় জমিগুলোর ওপর কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে কাঁদি আর চিৎকার করে বলি, ‘আমার শৈশবের জমির মতোন জমিগুলোকে আবার সে রকম করে দাও, পথগুলো বাড়িঘরমুক্ত করে দাও, সেই বাইদ ফিরিয়ে দাও, সেই খাঁটি গ্রাম ফিরিয়ে দাও।’ এভাবে কাঁদতে পারলে হয়তো ভালো হতো। কিন্তু আমি হয়তো শহুরে ভদ্রলোক হয়ে গেছি। কান্নাকাটি করা আমাকে আর মানায় না, মানাবেও না হয়তো।


সেবার কোরবানীর ঈদে বাড়ি গেলাম। ফেরার দুদিন আগে মায়ের হাতে বানানো ফুলপিঠা গোগ্রাসে মুড়মুড় করে খাচ্ছিলাম। মা দেখে বললেন, ‘এই পিঠা তোর এত পছন্দ, আগে বললে তো অনেকগুলো বানিয়ে রাখতাম, ঢাকায় নিয়ে যেতে পারতি।’ খাবার টেবিলের পাশেই উপস্থিত ছিলেন প্রতিবেশী লালু ভাইয়ের স্ত্রী। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, তাঁদের বাড়িতে এক টিন বানানো আছে। সেগুলো তিনি দিয়ে দিতে চান। এবং আশ্চর্য, ঢাকায় আসার দিন দেখি তিনি সেগুলো নিয়ে এসেছেন!


এই যে লালু ভাইয়ের স্ত্রীর মতো মানুষগুলোর হৃদয় এখনো সবুজই রয়ে গেছে। তারা প্রতিবেশীর প্রয়োজনে এখনো সবার আগে ছোটেন। সবার মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেন নিরন্তর। সবকিছু বদলালেও গ্রামের এই মানুষদের হৃদয়ের সবুজ রংটা বদলায়নি।


অথচ এই শহরে বন্ধু, ভাই, প্রতিবেশী, কলিগ, এলাকাবাসী পরিচয়ে কত শত মানুষের বাস, কিন্তু কেউ কারো নয়। তারা পরস্পরকে ভালবাসা দিতে রাজি আছে, তবুও সহযোগিতা নয়। কে কাকে বুঝাবে যে সহযোগিতা ছাড়া ভালবাসার দাম নাই।

[লুৎফর রহমান হিমেল: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন।]

অতিথি লেখক