সংবিধানের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব

সংবিধানের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রতি বছরের ৪ নভেম্বরকে ‘সংবিধান দিবস‘ হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের দিন। এই দিন ‘জয় বাংলা‘ স্লোগানে মুখরিত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখে বাংলাদেশ ও ভারতের মিত্রবাহিনীর নিকট রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ কার্যত স্বাধীন হয়। ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার মুজিবনগর হতে ঢাকায় এসে শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে।


১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তিদান করেন। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ তার ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে ‘আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ’ জারি করেন। এ আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়। এ আদেশ বলে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামো থেকে প্রাপ্ত সব আইনকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অধীনে বৈধতাদান করা হয়।


আজ (৪ নভেম্বর’২০১৭)৪৬তম সংবিধান দিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়। একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস থেকে সংবিধান কার্যকর হয়। এরপর থেকে এ পর্যন্ত সংবিধানে ১৬টি সংশোধনী আনা হয়েছে। সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সংবিধান রচনা কমিটির একমাত্র মহিলা সদস্য ছিলেন বেগম রাজিয়া বানু। এ ছাড়া কমিটিতে একমাত্র বিরোধীদলীয় সদস্য ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কমিটি ভারত ও যুক্তরাজ্যের সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করে।


সংবিধান একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। কোনো শাসনব্যবস্থার মূলগ্রন্থ সংবিধান, যাতে স্বায়ত্তশাসিত কোনো রাজনৈতিক সত্তার কর্তব্য নির্ধারণের মৌলিক নিয়ম ও সূত্রগুলো লিপিবদ্ধ থাকে। বাংলাদেশের সংবিধানে সংশোধনীর মধ্যে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, ত্রয়োদশ ও ষোড়শ এই ৫টির বৈধতা বিষয়ে আপত্তি উত্থাপনপূর্বক মামলা করা হলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ওই ৫টি সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন। এর মধ্যে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদের শাসনামলে সামরিক সরকারকে বৈধতা দেয়া হয়েছিল।


অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার বাইরে বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রংপুর ও সিলেটে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ছয়টি স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মেয়াদ অবসান বা মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। আর ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণে সংসদীয় অভিশংসন প্রথার প্রবর্তন করা হয়।


বিভিন্ন মহলে বিতর্কের পর উচ্চ আদালতের রায়ে কয়েকটি সংশোধনী বাতিল হয়েছে। তবে একই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সন্নিবেশ, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে সংসদে এমপিদের ভোট না দেয়ার বিধান সংক্রান্ত ৭০ অনুচ্ছেদ, অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ-বদলি সংক্রান্ত ১১৬ অনুচ্ছেদসহ কয়েকটি বিষয় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে এখনও। আইনজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানকে শুধু আইনজীবী আর সংসদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে এটি সম্পর্কে জানতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া সংবিধানের যে বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সেই বিষয়গুলোতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থার সাম্প্রতিক প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত করে যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। এ জন্য সংবিধান সংশোধনে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা যেতে পারে বলেও মনে করেন অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ।


একটি রাষ্ট্রের মূলত তিনটি বিভাগ। নির্বাহী, বিচার ও আইন- যে কোনো আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য এ তিনটি বিভাগেরই গুরুত্ব সমান। আইন বিভাগ যেমন আইন প্রণয়ন করে, তেমনি নির্বাহী বিভাগ প্রণীত আইনের সঠিক প্রয়োগ করে আর বিচার বিভাগ এই আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেন অসাংবিধানিক কিছু না ঘটে, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করে এবং আইনের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করে। তাই আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি বিভাগের কেউই কারো উপরস্থ বা অধীন নয়। তিনটি বিভাগের কোনোটিই কম গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং সব বিভাগই সমান আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, তাহলো আমাদের সংবিধানের মূল চেতনা হচ্ছে সুপ্রিমেসি অব কন্সটিটিউশন বা সাংবিধানিক প্রাধান্য কোনো বিশেষ বিভাগের প্রাধান্য নয়।


রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটলের মতে, ‘সংবিধান হলো এমন একটি জীবন পদ্ধতি-যা রাষ্ট্র স্বয়ং বেছে নিয়েছে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধানই আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং নাগরিক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার রক্ষা করে।’ অধ্যাপক ফাইনারের মতে, ‘মৌল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সুষম ব্যবস্থাই সংবিধান।’ যেকোনো দেশের শাসনব্যবস্থা বা সরকারের ক্ষমতার উৎসই হচ্ছে সংবিধান। কোনো কিছু যেমন ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতা হতে সৃষ্টি হতে পারে না বা শূন্যতার ভেতর কাজও করতে পারে না। এক কথায় বলা যায়, সংবিধানবিহীন কোনো স্বাধীন, সার্বভৌম ও সভ্য রাষ্ট্র চলতে পারে না। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, মানব সভ্যতার প্রথম সমাজ হিসেবে পরিগণিত গ্রিক সমাজে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল এবং তা স্বাভাবিক হিসেবেও সমর্থিতও হয়েছিল। সেখানে দাসদের কোনো অধিকার ছিল না। দাসরা ছাড়া সব নাগরিকই শাসনকার্যে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করত। বিভিন্ন প্রাচীন গ্রিক নগর-রাষ্ট্রের সংবিধানসমূহ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, যেসব বিশ্বাস এবং ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী ওইসব সমাজ পরিচালিত হয়েছিল তা সেখানকার সংবিধানগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছিল। এথেন্স ও স্পার্টা নগরীর সংবিধানগুলোই এর দৃষ্টান্ত।


পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় সংবিধান ভারতের আর ছোট সংবিধান (মাত্র ১৫-১৬ পাতা) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, তবে ছয় হাজার শব্দের বেশি নয়। ১৭৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত তাদের সংবিধান ২৬ বার সংশোধিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের সংবিধান অলিখিত। আমাদের মহান ও পবিত্র সংবিধান লিখিত, দুষ্পরিবর্তনীয়, মৌলিক অধিকার দ্বারা স্বীকৃত, এককক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা, ১৫৩টি অনুচ্ছেদ, ১১টি ভাগ, ৪টি মূলনীতি, ৭টি তফসিল, ১টি প্রস্তাবনাসহ পরিপূর্ণ একটি সংবিধান। তবুও বিভিন্ন কারণে এখন  পর্যন্ত সংবিধানে ১৫ সংশোধনী আনা হয়েছে।


দেশের জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রে সম্পর্কের ভিত্তি সংবিধান। স্বাধীনতা অর্জন ও একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাতি হিসেবে আমাদের একটি ঐতিহাসিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমাদের সংবিধান অর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ৫ লাখ নির্যাতিত নারীর দীর্ঘশ্বাস। তাই জাতি হিসেবে সংবিধান রক্ষা করা এবং তার সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব।

[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: এসবিডি নিউজ24 ডট কম]

jsb.shuvo@gmail.com

প্রধান সম্পাদক