শীতের সবজিতে ঘাটতির আশঙ্কা

শীতের সবজিতে ঘাটতির আশঙ্কা

বিশেষ প্রতিনিধি, এসবিডি নিউজ24 ডট কম: দুই দফা বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে এবার এক মাস দেরিতে শীতের সবজি পাবে দেশের মানুষ। বর্তমানে অল্প পরিমাণে যে সবজি বাজারে এসেছে, তা আগাম শীতের সবজি হলেও বিশেষ উপায়ে চাষ করা। শীতের আগাম সবজির মূল সরবরাহ বাজারে আসবে নভেম্বরের মাঝামাঝিতে। আর মূল শীতকালীন সবজি আসবে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ। ফলে মূল শীতকালীন শাকসবজির জন্য মানুষকে আরো দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। তবে বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে আগাম শীতকালীন সবজি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় এবার সবজি উৎপাদনে কিছুটা ঘাটতি দেখা দিতে পারে। যদিও বন্যা ও বৃষ্টির কারণে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় শীতকালীন মূল সবজির উৎপাদন বাড়তে পারে এবং ঘাটতি পূরণে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে অনেক কৃষকের হাতে সময়মতো সবজি বীজ, চারা ও সার না পৌঁছানোয়, কৃষিঋণসহ নানা ধরনের প্রণোদনার অভাবে চাষ কম হওয়ায় সবজির কাক্সিক্ষত উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।


কৃষি গবেষকরা বলছেন, আগাম শীতকালীন সবজি উৎপাদনের ঘাটতি পূরণ করতে হলে মূল শীতকালীন সবজি চাষে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। তারা জানান, নিচু জমির পানি নামতে দেরি হওয়ায় এই সপ্তাহের মধ্যে মাটির ‘জো-কন্ডিশন’ চাষের উপযোগী হবে। আর মধ্যম স্তরের জমি ইতোমধ্যেই চাষ উপযোগী হয়েছে। আগামী সাত দিনের মধ্যে এসব জমিতে সবজি চাষ শুরু করা যাবে। সুতরাং এই সপ্তাহের মধ্যেই কৃষকদের মুলা, ফুলকপি জাতীয় সবজির বীজ দিতে হবে। সরকারি খামারে ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে কৃষকরা বিভিন্ন সবজির চারা উৎপাদন করেছে, সেখান থেকে কৃষকদের চারা দেওয়া যেতে পারে। সার দিতে হবে। এ ছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা আর্থিক প্রণোদানও নিশ্চিত করতে হবে। এসব উপকরণ না পেলে এই দফায় উৎপাদনও ব্যাহত হতে পারে।


এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক আবদুল আজিজ বলেন, বন্যা ও ভারী বর্ষণের কারণে এবার অনেক ফসল নষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে শীতের আগাম সবজি চাষ ব্যাহত হয়েছে। তবে বন্যা-পরবর্তীতে কৃষকরা আবার মাঠে নেমেছেন। সাধারণত বন্যার পরে মাটি উর্বর হয়। ফলে ফসলও ভালো হয়। এবার দেরি করে হলেও সবজি উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে বলে আশা করা যায়। অনেক এলাকায় কৃষকদের হাতে এখনো সবজি চারা-বীজ পৌঁছায়নি-কৃষকদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এই কর্মকর্তা বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত সব কৃষককে বীজ, সার ও কীটনাশক দেওয়া হচ্ছে। যদি কোনো এলাকায় কৃষক এখনো না পেয়ে থাকেন, সে ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হবে। না পেলে দ্রুত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ২৪ জেলার সাত লাখ ৭৬ হাজার ২০২ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে কৃষি পুনর্বাসন হিসেবে ১৩৬ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার ৫৫১ টাকার সহায়তা দিচ্ছে সরকার। এর মধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের ছয় লাখ কৃষককে ১১৭ কোটি টাকার বীজ, সার এবং নগদ এক হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। আর নওগাঁ, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, রংপুর, নাটোর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, শেরপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক লাখ ৭৬ হাজার ২০২ জন কৃষক পাবেন ১৯ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার ৫৫১ টাকার গম, ভুট্টা, সরিষা, চীনাবাদাম, খেসারিসহ বিভিন্ন শাকসবজি এবং বোরো ধানের বীজ ও সার।


অবশ্য বেশ কিছু জেলার কৃষকরা এখনো শাকসবজির বীজ ও চারা এবং আর্থিক প্রণোদনা পাননি এবং বিতরণ নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে হাওর অঞ্চলে এখনো ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুতের কাজ শেষ হয়নি। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে কৃষি ভর্তুকির বীজ ও সার বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার মোট ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের এক-তৃতীয়াংশ কৃষক কোনো সহযোগিতাই পাননি। দিনাজপুরে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের হাতে এখনো সাহায্য এসে পৌঁছায়নি। পর্যাপ্ত সাহায্য পাননি শেরপুরের চার উপজেলার কৃষকরা।


অথচ এই সপ্তাহের মধ্যেই কৃষকদের হাতে শাকসবজির চারা-বীজ পৌঁছাতে হবে উল্লেখ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অধ্যাপক আরিফুর রহমান বলেন, শীতকালের মূল শাকসবজির চাষ শুরু হয়ে গেছে। নিচু জমি থেকে পানি নেমেছে। তবে জমির ‘জো-কন্ডিশন’ ঠিক হতে আরো সাত দিন লাগবে। ফলে এই সময়ের মধ্যেই কৃষকদের চারা ও বীজ দিতে হবে। এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা শীতকালীন শাকসবজি উৎপাদনে ইতোমধ্যেই মাঠে নেমেছেন। শেষ ভরসা শাকসবজি উৎপাদনের মধ্য দিয়ে স্বপ্ন দেখছেন ঘুরে দাঁড়ানোর। প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, দিনাজপুরের ইসলামপুর ও জামালপুর উপজেলার কৃষকরা শীতের সবজি চাষ শুরু করেছেন। মাঠজুড়ে শোভা পাচ্ছে শিম, বাঁধাকপি, ফুলকপি, বেগুন, বরবটি, মুলা, লাউ, করলা, পটোল, পালংশাক ও লালশাক। নওগাঁয় দ্বিগুণ দামে চারা কিনে শীতকালীন সবজি চাষে মনোযোগ দিচ্ছেন কৃষকরা। হাতেগোনা কয়েকজন কৃষক সরকারি সহায়তা পেলেও বেশির ভাগ কৃষককে লড়তে হচ্ছে ব্যক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে বন্যায় অধিকাংশ সবজিখেত নষ্ট হয়েছে। পরে সরকারের সহযোগিতা ছাড়াই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন কৃষকরা। কিছু এলাকায় শাকসবজি বোনা শুরু করেছেন। মাঠে এখন শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, মুলা, করলা, পটোলসহ আরো কিছু সবজি।


এ বছর দেশে শীতকালীন শাকসবজির সার্বিক চিত্র কী-জানতে চাইলে অধ্যাপক আরিফুর রহমান বলেন, বাজারে যদিও আগাম শীতকালীন শাকসবজি আসতে শুরু করেছে, কিন্তু মূল সরবরাহ শুরু হয়নি। এগুলো বিশেষ পদ্ধতিতে চাষ করা। ফলে স্বাদ ও পুষ্টিগুণে ঘাটতি রয়েছে। আগাম শাকসবজি এখনো মাঠে। বাজারে আসবে নভেম্বরের মাঝামাঝিতে। ১০ নভেম্বর থেকে শীত শুরু হবে। তারপর বাজারে শীতকালীন আগাম শাকসবজি মিলবে। আর আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই যে শাকসবজি লাগানো হবে, সেগুলোই শীতকালীন মূল শাকসবজি। বাজারে আসবে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ, ভরা শীতে।


এবার শীতকালীন শাকসবজি চাষ এক মাস পিছিয়েছে-জানিয়ে এই কৃষি গবেষক জানান, আগাম শীতের সবজি পাওয়ার কথা অক্টোবরে। কিন্তু আসছে নভেম্বরে। আর মূল শীতের সবজি পাওয়ার কথা নভেম্বরে, সেটি আসবে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ। সেই সঙ্গে মোট উৎপাদনে ঘাটতি থাকতে পারে উল্লেখ করে অধ্যাপক আরিফুর রহমান বলেন, যদিও বন্যার পর মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় ও উৎপাদন বাড়ে। কিন্তু অক্টোবরে যে উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল, সেই এক মাসের ঘাটতি পূরণ হবে না। তবে শেষ পর্যন্ত ঘাটতি নাও হতে পারে-জানিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আক্কাস আলী বলেন, সরকার যথেষ্ট প্রণোদনা দিচ্ছে। বিশেষ পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে। সুতরাং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক থাকতেও পারে।


এদিকে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও দেশে শাকসবজি উৎপাদন বাড়ছে বলে জানিয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন গবেষকরা। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বার্ষিক মোট সবজি উৎপাদন হয় ২২ লাখ টন, যেখানে ১৯৭০ সালে উৎপাদন হতো মাত্র সাত লাখ টন। গত তিন দশকে দেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণের বেশি। দেশে বর্তমানে প্রায় আট লাখ হেক্টর জমিতে বছরে প্রায় ২০ লাখ টনের অধিক সবজি উৎপাদন হচ্ছে। গত অর্থবছরে ৬৫০ কোটি ৪১ লাখ ২০ হাজার টাকার সবজি বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়েছে।


রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ওমান ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে বাংলাদেশের ৫০ জাতের সবজি ও ফলমূল রফতানি হচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের ফেলো ও কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী বলেন, দেশের চাষযোগ্য জমির মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশে শাকসবজি চাষ হয়। দেশে ৬০ ধরনের ও ২০০ জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। এসব সবজির ৯০ শতাংশ বীজ দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। প্রতি বছর উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে ৪০ ভাগ সবজি নষ্ট হচ্ছে। সুতরাং সব ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কার্গো বিমান চালু, বিদেশি বিমানগুলোয় পণ্য রফতানির ব্যবস্থা গ্রহণ, যেসব দেশে এসব পণ্যের বাজার আছে সেসব দেশে ফ্লাইট বাড়ানো, চলমান ভর্তুকি অব্যাহত রাখাসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া গেলে এ খাতে আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।

বিশেষ প্রতিনিধি