বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা, ভারতের নির্বাচন থেকে
সৈকত রুশদী: সর্বোচ্চ সংখ্যক, প্রায় ৯১ কোটি, ভোটার নিয়ে সংসদীয় ব্যবস্থায় বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। সাত পর্বে গত ১৯ মে সম্পন্ন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সেদেশের ৬৭ শতাংশ ভোটার ব্যালট পেপারের মাধ্যমে তাদের সাংবিধানিক অধিকার চর্চা করেছেন। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে ২৩ মে।ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী রক্ষণশীল বিজেপি জোট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা (৩৫১) নিয়ে দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠনের গণরায় পেয়েছে।
…
অপরদিকে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দানকারী ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতির অনুসারী মধ্যপন্থী দল কংগ্রেস জোট রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে পেয়েছে (৮৬) দ্বিতীয় স্থান। এপর্যন্ত পাওয়া ফলাফল অনুসারে, সংসদের নিম্ন পরিষদ লোকসভায় মোট ৫৪৩ আসনের মধ্যে আঞ্চলিক দলগুলো পেয়েছে ১০৫ টি আসন। ভারতে নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্র অব্যাহত ১৯৪৭ সালে দেশটির স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই বিগত সাত দশক ধরে। সেই ধারাবাহিকতায় কিছুটা ছন্দপতন ঘটে ১৯৭৫-১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকালে জরুরী অবস্থা জারীর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ ও নিপীড়নের কারণে।
…
কিন্তু গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি অংশগ্রহণমূলক ও পক্ষপাতহীন অবাধ নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন পূর্ণ মাত্রায় বহাল ছিল বরাবরই। তার ফলেই ১৯৭৭ সালে নির্বাচনী রায়ে ইন্দিরাকে ক্ষমতা হারাতে হয়। আর পরবর্তী নির্বাচনে তিনি আবার ক্ষমতায় ফিরেও আসতে পারেন। ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি হলেও এবারের নির্বাচন সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে। সেদেশে এটিই স্বাভাবিক।
…
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-এ ফলাফল জালিয়াতির অভিযোগ নিয়ে বিতর্কের পুরো চিত্র না পাওয়া পর্যন্ত নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে বলা যায়না। সেকারণে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জনমতের প্রতিফলন হতে পেরেছে কীনা তা’ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি ভারতে। অথচ সেই প্রশ্ন জাজ্বল্যমান বাংলাদেশে ১৯৯৬ সাল থেকে।
…
এখন দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতের বেশিরভাগ জনগণ কেন ধর্মীয় উগ্রবাদী দল ও নেতার প্রতি ঝুঁকে পড়ছে, সেই কারণগুলো বিশদভাবে অনুসন্ধান করে দেখার প্রতি।
…
অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন, ভারতের এই নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী বিজেপি জোটের নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয় দফায় যে বিপুল বিজয়, তা’ কী ধরণের প্রভাব ফেলবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে এবং প্রতিবেশী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সমাজজীবনে।
…
কেবল ভারতের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আগ্রহই বাংলাদেশের মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। সেদেশের নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশনের স্বাধীন, সাহসী ও কার্যকর ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য। গণতন্ত্রের সোপান নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ভারতের জনগণ যেভাবে অবাধে, চাপমুক্ত থেকে ও স্বাধীনভাবে তাদের সাংবিধানিক অধিকার চর্চা করে, বাংলাদেশের জনগণ তাদের সাংবিধানিক অধিকার সেই পর্যায়ে (যেমন, সাধারণ নির্বাচন ১৯৯১) ফিরিয়ে আনতে চায় কীনা এবং তা’ চাইলে কী কী করা প্রয়োজন সেটা বাংলাদেশের মানুষকেই গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে।
…
স্বাধীনভাবে ভোটের অধিকার প্রয়োগ করা সম্ভব হলে, তার প্রকৃত ফলাফল কীভাবে পাওয়া সম্ভব সেটিও ভেবে দেখতে হবে এবং সেই লক্ষ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ও সমষ্টিগতভাবে কাজ করতে হবে।
…
সৈকত রুশদী: টরন্টো, ২৪ মে ২০১৯।