ভোলায় সহিংসতা: বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের বিবৃতি
এসবিডি নিউজ24 ডট কম,ডেস্ক: এক ব্যক্তির ফেসবুক আইডি হ্যাক করে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা হয় ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায়। এ ঘটনায় দ্রুত সময়ের মধ্যেই প্রকৃত অপরাধীকে (হ্যাকার) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনের আশ্বাস দিয়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে পুলিশ। ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় আলেম সমাজের সমঝোতাও হয়। এর পরও একটি বিশেষ মহলের অপরাজনীতির কারণেই আলেম সমাজের সামনে বোরহানউদ্দিন উপজেলা ঈদগা মাঠে পুলিশের ওপর হামলা হয়, গুলি ছোঁড়া হয়। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও গুলি চালায়। ঘটনায় চারজন নিহত হয় এবং দু’জন পুলিশ সদস্য গুলিবিদ্ধ হওয়াসহ বেশ কয়েকজন হামলাকারী আহত হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশিষ্ট নাগরিকরা বলছেন, ‘এ ঘটনায় প্রতীয়মান হয়, ধর্মকে পুঁজি করে বারবার দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও ফায়দা হাসিলের চেষ্টা চালায় মৌলবাদি ও সাম্প্রদায়িক মহল। রাজনীতি ও বিশেষ ধর্মের আড়ালে ওই গোষ্ঠী মূলত সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে চায়। একটি বিশেষ ধর্মের চেতনা বাস্তবায়ন করতে চায়। দেশকে উগ্রধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।’
এ অপশক্তিকে রোখে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেছেন, ‘অশুভ রাজনীতি ও বিশেষ ধর্মের চেতনা বাস্তবায়নের নামে এই উন্মাদনা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে সচেতন নাগরিক, আলেম সমাজকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে অপকর্ম থেকে দেশ রক্ষা পাবে না।’
ভোলায় সহিংসতার ঘটনায় ২০ অক্টোবর রোববার পুলিশের এক বিবৃতিতে বলা হয়, সাবির্কভাবে মনে হচ্ছে- পুলিশ প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করে তদন্ত চলমান রাখা সত্ত্বেও এবং আলেম সমাজ থেকে এ ঘটনায় কোন বিশৃঙ্খলা না করার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও একটি বিশেষ মহল এ ঘটনাকে পুঁজি করে অস্তির পরিস্থিতি তৈরি করেছে এবং করতে চাচ্ছে।
এ ঘটনার বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম, সাংবাদিক কামাল লোহানী, শাহরিয়ার কবির ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনসহ বিশিষ্ট ব্যাক্তিরা একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ‘গত ২০ অক্টোবর (ভোলা) সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা ধারাবাহিক পরিকল্পিত অপচেষ্টার অংশ। ফেসবুককে আশ্রয় করে গুজব ছড়িয়ে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়া এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা ও ভীতিকর হুমকি প্রদানকে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো একটি নিয়মিত কৌশলে পরিণত করেছে। ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়সহ যে কোন ইস্যুতে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে দেশের প্রচলিত আইনি প্রক্রিয়ায় প্রতিকার চাইবার সব সুযোগ রয়েছে। আইনের প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে যারা ধর্মীয় ইস্যুতে গুজব ছড়িয়ে সামাজিক উত্তেজনা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায়। তারা মূলত : অসাম্প্রদায়িক, শান্তিপূর্ণ এবং সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ার শত্রু।’
ভোলায় সাম্প্রসাদিক সহিংসতার ব্যাপারে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সংবাদকে বলেছেন, ‘কোনভাবেই যেন ধর্মীয় উসকানি যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আসলে এখন আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি, যেকোন সময় যেকোন ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যেমন বুয়েটে আবরার হত্যা হলো।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মানবিক গুণগুলো হারিয়ে ফেলছি। সমাজে বৈষম্য বেড়ে চলেছে। কারও মাঝেই সহিষ্ণুতা নেই। জবাবদিহিতারও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধেও মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। সব মিলিয়েই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এগুলো বন্ধ করতে হলে গোটা সিস্টেমের পরিবর্তন করতে হবে।’
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম সংবাদকে বলেছেন, ‘ভোলার ঘটনাটি দুঃখজনক। প্রযুক্তির অপব্যাবহার করে এই ঘটনা ঘটনানো হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু এ ঘটনা আমাদের সংস্কৃতির মূলে আঘাত করেছে।’
তিনি বলেন, ‘দোষীদের গ্রেফতারের পরও পুলিশের উপর হামলা করেছে উগ্রবাদীরা। যারা ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়িয়েছে তারা নিজেরা লাভবান হয়েছে। দেশের কোন লাভ হয়নি। এ ঘটনায় পুলিশের কোন দোষ নেই। তবে পুলিশকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে এবং নজরদারি বাড়াতে হবে।’
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদিন মালিক সংবাদকে বলেছেন, ‘দেশে প্রতিদিনই অনেক ঘটনা ঘটছে। প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।’
বিশিষ্ট নাগরিকরা বিবৃতিতে আরও বলেন, ‘এই অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে রোধ করে একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার ধারাবাহিক অপচেষ্টায় লিপ্ত। আমরা এই ধরনের ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতার তীব্র নিন্দা জানাই এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের শত্রু এই উগ্র মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। আমরা একই সঙ্গে সরকারের কাছে আরও দাবি জানাচ্ছি নিরাপরাধ বিপ্লব চন্দ্রকে যেন কোন প্রকার হয়রানি করা না হয় এবং তার যথোপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হোক। একই সঙ্গে আমরা দেশের সব জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, এই ধরনের যে কোন সাম্প্রদায়িক উসকানি ও গুজবের বিরুদ্ধে সচেতন ও সতর্ক থাকতে।’
পুলিশ সদরদপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয়, গত ১৮ অক্টোবর বিপ্লব চন্দ্র শুভ নামে নিজ ফেসবুক আইডি হ্যাক হওয়ার পেক্ষিতে বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য (২৫) নামের এক যুবক রাত ৮টা ৫ মিনিটে বোরহানউদ্দিন থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। থানায় অবস্থানকালেই বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্যের মোবাইল নম্বরে একটি কল আসে এবং তার কাছে চাঁদা দাবি করা হয়। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে সে ওসিকে জানায়। ওসি বিষয়টি জেলা পুলিশ সুপারকে জানায়। প্রযুক্তির সহযোগিতায় সেদিন রাতেই বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্যের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাককারী এবং তার মোবাইল নম্বরে কল করে চাঁদা দাবি করা যুবক শরীফকে পটুয়াখালী থেকে এবং ইমন নামের এক যুবককে বোরহানউদ্দিন থেকে আটক করে। পরে তাদের থানায় নিয়ে আসা হয়। এ ঘটনায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে ১৯ অক্টোবর বোরহানউদ্দিনর থানায় ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আটক করার বিষয়টি বিস্তারিত জানিয়ে আলেম সমাজ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা হয়। কটূক্তির প্রতিবাদে আলেম সমাজ ২০ অক্টোবর সমাবেশ করার ঘোষণা দিলে উপযুক্ত বিচার এবং বিপ্লবকে আটক দেখানোর পর সমাবেশ বাতিল করে আলেম সমাজ কর্মসূচি বাতিল করে।
সমাবেশ বাতিলের ঘোষণা সত্ত্বেও পুলিশ সার্বক্ষণিক সতর্ক থাকে। রোববার সকাল থেকেই ঈদগা মাঠে কিছু লোক জড়ো হয়। মাঠের বিভিন্ন পয়েন্টে ১৭টি মাইক আনে একটি মহল। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সমাবেশে লোকজনকে সরিয়ে নিতে বললে আলেমরা নিশ্চিত করেন লোকজন কোনরকম বিশৃঙ্খলা করবে না। বরিশাল রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি ঘটনাস্থলে আসেন। ডিআইজি, এসপি ও স্থানীয় ইউএনওকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় ব্যক্তিদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। তারা প্রয়োজনীয় আইনি পদপেক্ষ নেয়ার আশ্বাস দেন। বক্তব্য শেষে অতিরিক্ত ডিআইজি, এসপি ও ই্উএনওসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঠ সংলগ্ন মাদ্রাসার একটি কক্ষে অবস্থান নেন। এর মধ্যে একটি গ্রুপ মাঠে প্রবেশ করে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করতে থাকেন। বিনা উসকানিতে মাদ্রাসা কক্ষে অবস্থানকারী পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওপর আক্রমণ করে। আক্রমণকারীরা অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুলিশের ওপর হামলা করে। হামলাকারীদের অস্ত্রের গুলিতে পুলিশের এক সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়। মারাত্মক আহত হয় পুলিশের আরেক সদস্য। বরিশাল রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজিও আহত হন। এমন পরিস্থিতি ইউএনও এবং ম্যাজিস্টেট আত্মরক্ষার্থে গুলি করার নির্দেশ দেন। এর মধ্যে গুলিবিন্ধ পুলিশ সদস্যদের উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টরযোগে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় নিহত ৪ জনের মধ্যে ২ জনের মাথা ভোতা অস্ত্রের মাধ্যমে থেতলানো ছিল বলে নিশ্চিত করেছে চিকিৎসক।