দেখে এলাম বাংলাদেশ…
খুরশীদ শাম্মী: দেখে এলাম প্রাণের বাংলাদেশ, যেখানে টাকা শুকনো পাতার মতো হালকা হচ্ছে দিনদিন। হালকা হওয়ার সুবাদে কেহ টাকা উড়ায়, কেহ কুড়ায়। ভিক্ষুককে দশ টাকা দিলে বদনখানির দিকে তাকায়, টাকা না দিয়ে ক্ষমা চাইলে তারা উল্টো টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। অতঃপর আমাকে ভিক্ষা দেওয়া থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
হ্যাঁ। করোনাকে উপেক্ষা করে কেমন ছোঁচার মতো ছুটে গেলাম মা, মাতৃভূমি, আপনজনদের কাছাকাছি হয়ে তাদের একটু চোখে দেখা, সামান্য স্পর্শ পাওয়ার টানে। মাস্ক পরিধান করে দীর্ঘ ২৮ ঘণ্টা ভ্রমণকালে যে আমি বলে চলছিলাম, “কাউকে উচ্চতর সাজা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ হলে, তাকে করোনার জন্য ভ্রমণে সীমাবদ্ধতা আইন চলাকালীন সময় সাতদিনের ছুটি ও টরন্টো-ঢাকা-টরন্টো উভয়দিকের যাত্রাপথে অন্তত দু’বার করে বিরতির ভাঙা পথে উড়োজাহাজের টিকেট কিনে দেওয়া মন্দ হয় না”। দেশের মাটি স্পর্শ করার পরপরই সেই আমার ক্লান্ত দেহ ও মন আপনজনদের সংস্পর্শে কেমন চাঙা হয়ে উঠল, তখন সুর পরিবর্তন করে বলেই ফেললাম, “টরন্টো-ঢাকা দীর্ঘ ভ্রমণ অনেকটা প্রসব বেদনার মতো, নবজাতকের স্পর্শে যেন সব কষ্ট নিমিষে বিলীন।”
উড়োজাহাজ ভ্রমণ আমার যত বিরক্তিকর-ই ছিল না কেন, মাটির স্পর্শে, প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে সতেজ মন পই-পই উড়ে বেড়াতে শুরু করল, ঘোলা নীল আকাশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেল অনুভব। ঘোর কেটে বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া মাত্রই শুরু হলো ব্যথা অনুভব, তবে ব্যথাটা একটু ভিন্ন ধরণের। দূষিত বায়ু, জল, কোলাহল ব্যথা সূচনা করলেও তাহা সহ্যের মধ্যেই ছিল। কেননা, বাংলার মাটি, জল, বায়ুর সংমিশ্রণেই তো আমার সৃষ্টি। আর শিকড়টা গাঁথা রয়েছে এখনো ওই মাটিতেই। তবে, স্বল্পদৈর্ঘ্যের অবস্থান কালে দৈনন্দিন জীবনের পদে পদে দুর্নীতি মেনে নেওয়া ছিল খুবই কষ্টদায়ক। মাঝেমধ্যে মনে প্রশ্ন জেগেছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় না কেন? কিন্তু, যতবারই অভিযোগ তোলার কথা ভেবেছি, ততবারই হোঁচট খেয়েছি, কারণ যাদের সমীপে অভিযোগ তোলা হবে তারাই দুর্নীতির মহানায়ক। আর ঐসকল মহানায়কেরা আমার মতো ভুক্তভোগীদের কারো না কারো আপনজন, কাছের মানুষ, প্রিয় ব্যক্তিত্ব, পরিচিত জন। সুতরাং আমাদের সীমাবদ্ধতাই মূলত আমার ব্যথার অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে। আশ্চর্য হয়েছি সরকারি অফিসগুলোতে প্রবেশ করে। যতবার কোনো সরকারি অফিসে যেতে হয়েছে, ততবারই অনুভূতি আহত হয়েছে, অপরিচ্ছন্নতা যেন অফিসগুলোর পরিচয়পত্র ও ঘুষ একটি প্রধান খাদ্য, সাধারণ জনগণের প্রতি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আচরণ দেখে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ফিরতে হয়েছে বহুবার। দেখেছি কীভাবে খোলা বাজারে পণ্য বিক্রয়ের মতো বিভিন্ন অফিসে বাধ্য হয়ে সাধারণ নাগরিকগণ ঘুষের দর কষাকষি করতে বাধ্য হয়। নয়টার অফিস কখন খুলবে তা নির্ভর করে কর্মচারীদের ব্যক্তিগত রুটিনের উপর, আর কর্মকর্তারা তো আসেন আরো পরে। ডিজিটাল বাংলাদেশে অনলাইনে প্রেরিত আবেদনপত্র পুনরায় লাইন ধরে, ধাক্কা খেয়ে অফিসের কর্মচারীদের মন জয় করে জমা দিতে হয়। অনিয়মই যেন সেখানে নিয়ম হয়ে গেছে, দেখার কেহ নেই, সঠিক ব্যবস্থা নেওয়ারও কেহ নেই। জনগণের কাছে বিভিন্ন জেলার দুর্নীতি নিয়ন্ত্রকদের রেপুটেশন শুনলে মনে হবে দেশে দুর্নীতি মহামারী রূপ নেওয়ার একটি কারণ তারা। একজন মিশুক চালককে যখন দৃঢ়কণ্ঠে বলতে শুনি, “আমার নামে অভিযোগ কইরা লাভ হইবে না। কোনো পুলিশ আমার কিচ্ছু করবে না, করতে পারবেও না।” তখন মিশুক চালকের সাহসের উৎসও আমরা বুঝে নেই।
এরপরও বলবো, দেশের উন্নয়ন হয়েছে। গ্রাম পর্যন্ত বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে, মাটির পথগুলো ইট-পাথরে নির্মাণ করা হয়েছে ও হচ্ছে, বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার, প্রশস্ত সড়ক ও সেতু নির্মিত হয়েছে, অভ্যন্তরীণ জেলা সমুহের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে, ঢাকা থেকে মাওয়া যাওয়ার সড়ক বেশ ভালো লেগেছে, পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে বাংলাদেশ ছোট হয়ে আসবে নিঃসন্দেহে, তবে ঢাকার যানজট নিরাময়ের জন্য ট্রাফিক পুলিশ নয়, বরং ডিজিটাল ট্রাফিক লাইট মেনে চলার নিয়ম চালু করার ব্যবস্থা করা খুব জরুরি বলে মনে হয়েছে।
প্রতিযোগিতা বিষয়টি অনুভব হয়েছে সড়কে চলমান যানবাহনগুলোর চলাচলের পদ্ধতি থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবনেও। যেমন, রিকশা আগে যাবে না গাড়ি? কিংবা, কার সন্তান পরীক্ষায় বেশি ভালো করল? প্রতিযোগিতায় হার-জিত থাকে, সুতরাং প্রতিযোগিতা কখনোই সবার জন্য কল্যাণকর হয় না। প্রতিযোগিতা করে উপরের দিকে উঠছে বহুতল ভবন, ফ্লাটবাড়ি, যাহা ছিনিয়ে নিয়েছে অনেকের একমাত্র বন্ধু খোলা আকাশকে। তবে অধিকাংশ ছাদ ও বারান্দার সবুজ গাছগাছালিগুলো প্রাণে আশার আলো সঞ্চারিত করে। ফ্লাটবাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে মোহাম্মদপুর বিহারি রিফিউজিক্যাম্পও উপরে বেড়ে উঠছে অপরিকল্পিতভাবে কোনো ফাউন্ডেশন ছাড়াই, যাহা খুবই ভয়ংকর। পড়াশুনার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীদের থেকে অভিভাবকদের মধ্যে অধিক পরিলক্ষিত। অভিভাবকদের এই অসুস্থতা করোনার থেকেও ভয়াবহ; শিক্ষার মান বিবেচনা না করেই তারা টাকার শ্রাদ্ধ দেয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার উভয়স্থানে। সেই সুযোগে বেড়ে উঠছে স্কুল, কলেজ, কোচিংসেন্টার ও বিশ্ববিদ্যালয় যত্রতত্র। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে ক্লিনিক। ক্লিনিক ও ডাক্তারদের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে অসংখ্য। প্রমাণিত হয়েছে যে সবদার ডাক্তার আছে মহল্লায় মহল্লায়।
দেশের রাজনীতিকে মনে হয়েছে খুবই অপ্রয়োজনীয় একটি বিষয়। যদিও দেশের স্বার্থপর জনগণ তাদের দৈনিক কথোপকথনের সত্তর শতাংশ “ইয়েস ম্যাম/ ইয়েস স্যার” শব্দ ব্যবহার করে। এই জন্যই সাধারণ জনগণ রাজনীতিকে খুব তুচ্ছ একটা বিষয় হিসেবে গণ্য করে। অথচ এই রাজনীতি হওয়া উচিত ছিল জনগণের জন্য। জনগণের স্বার্থে রাজনৈতিক নেতাদের কাজ করা ও জনগণের সান্নিধ্যে থাকার কথা ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী জনগণ নিজেদের ভাগ্য খোলার তাগিদে রাতদিন রাজনৈতিক নেতাদের অহেতুক গুণগান করে নেতাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গেছে। আর সেই সুযোগ গ্রহণ করে এক একজন রাজনৈতিক নেতা ক্ষমতা ও টাকার পাহাড় গড়ছে। শুধু কি তাই? নেতাগণ ও তাদের চাটুকারেরা নিরীহ জনগণদের মানুষ হিসেবেই গণনা করে না যেন।
২০২১ সাল ছিল বাংলাদেশ স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বছর। ডিসেম্বরে বিজয় সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশকে সাজানো হয়েছিল বেশ। লাল, সবুজ, সাদা বাতিতে খুব উৎসবমুখর অনুভব হয়েছিল পুরো ঢাকা শহর, কেমন না বলা আনন্দ দোলা দিয়েছিল আমাদের মনে। ইচ্ছে করছিল প্রতিদিন বিজয়ের উল্লাসে মাতি। নিয়ম-অনিয়মের হরেক রকম গিট্টু খেয়ে প্রতিদিন উল্লাসে মেতে ওঠা হয়নি আমাদের, তবে বিশেষ দিন অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। ১৪ই ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেজেছিল সন্ধ্যা সাতটা, বিশেষ দিনের আয়োজিত অনুষ্ঠান ততক্ষণে শেষ। গেটে দায়িত্বরত কয়েকজন প্রহরী পেছনের দিকে যেতে বারণ করলে অনুগত নাগরিকের মতো শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি সম্মান জানিয়ে ফিরে আসি দ্রুত। বিলম্ব না করে তাই ১৬ই ডিসেম্বর দুপুরেই পৌঁছে যাই সাভার স্মৃতিসৌধে। এমন বিশেষ দিনে স্মৃতিসৌধের মূল ফটকে নিরাপত্তাকর্মীদের অপ্রতুলতা কঠিন সমালোচনা দাবি করে। সজ্জিত সংসদভবন এলাকা জনগণের জন্য উন্মুক্ত জেনে গভীর রাতেই পৌঁছে যাই সেখানে। আলোকসজ্জা অবশ্যই সুন্দর ছিল। তবে রাষ্ট্রীয় একটি দিবসকে কেন্দ্র করে সজ্জীকরণে একটি রাজনৈতিক দলের ছায়া লেপ্টে থাকায় নিরপেক্ষতার অভাব অনুভূত হয়েছে।
শত অনুযোগের পরও কিন্তু দেশ ছেড়ে আসার সময় হৃদয় কেঁপেছে, কেননা নাড়িটা পোঁতা রয়েছে ওখানে। নাড়ির টান থাকবে আজীবন। ফিরে যাবো হয়তো বারবার। আশায় বুক বাঁধি, একদিন হয়তো কেহ একজন এসে আমাদের সকল অভিযোগ দূর করবেন, দেশ দুর্নীতি মুক্ত হবে, সাধারণ জনগণ দুর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশ পাবে।
[খুরশীদ শাম্মী: প্রবাসী লেখক।।]