সৌন্দর্য হারাচ্ছে সেন্টমার্টিন
এসবিডি নিউজ24 ডট কম,ডেস্ক: দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন ধ্বংসের পথে। অনিয়ন্ত্রিত পর্যটক ও অপরিকল্পিত স্থাপনার কারণে দ্বীপটির অবস্থা খুবই নাজুক। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজার পর্যটককে কেন্দ্র করে দ্বীপের চারপাশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে স্থাপনা তৈরির হিড়িক পড়েছে। পাশাপাশি পর্যটকদের অসচেতনতায় সেখানকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য এখন মারাত্মক হুমকির মুখে। ফলে প্রবাল, শৈবাল, সামুদ্রিক কাছিম, লাল কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ নানা জলজ প্রাণী এবং জীববৈচিত্র্য এখন বিলুপ্তির পথে। দ্বীপের এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ নিয়ে কাজ করা কক্সবাজারের একাধিক সংগঠনের দায়িত্বশীলরা।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপের প্রকৃতি বর্তমানে ধ্বংসের পথে। এই পথ থেকে দ্বীপের পরিবেশ ও প্রতিবেশ ফিরিয়ে আনতে অন্তত এক বছর দ্বীপে বসবাসকারী লোকজন ছাড়া পর্যটকদের যাতায়াত বন্ধ করা দরকার। অথবা দ্বীপের ধারণক্ষমতা নির্ধারণ করে শতভাগ মনিটরিংয়ের মাধ্যমে পর্যটকের যাতায়াত নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া প্রবাল, শৈবাল, সামুদ্রিক কাছিম, লাল কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ নানা জলজ প্রাণী এবং জীববৈচিত্র্য ফেরানো সম্ভব হবে না।’
কক্সবাজারের প্রবীণ সাংবাদিক মমতাজ উদ্দিন বাহারী বলেন, পর্যটকদের কাছে ‘দক্ষিণের স্বর্গ’ নামে পরিচিত প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন। বিগত কয়েক বছর ধরে এই দ্বীপে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়েছে পর্যটকদের আনাগোনা। পাশাপাশি অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে হরেক স্থাপনা। যে কারণে পরিবেশের চরম বিপর্যয় ঘটেছে। সুতরাং পর্যটক যাতায়াত কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করা হলে ইমারত ব্যবসায়ীরা কিছু একটা বুঝতে পারবেন। জাতিও বুঝতে পারবে, জীববৈচিত্র্যের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এরই মধ্যে।
সূত্র জানায়, সেন্টমার্টিন এখন পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা। সেখানকার পর্যটন নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। এটি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির কাছে পাঠানো হবে। এ বিষয়ে একটি সফটওয়্যারও তৈরি করা হয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের পর্যটকদের গমনাগমন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেখানে প্রতিদিন ১ হাজার ২৫০ জন পর্যটক যেতে পারবে। তবে সেখানে রাত্রিযাপন করা যাবে না। ১ হাজার ২৫০ জন পর্যটক সেন্টমার্টিনে যাতায়াতের ব্যাপারে পর্যটনের সংখ্যা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক সার্ভিসেস সংস্থার মাধ্যমে এসেসমেন্ট করা হয়েছিল। তারা প্রতিদিন ১ হাজার পর্যটকের ধারণক্ষমতার বিষয়টি উল্লেখ করেছে।
এদিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ সেন্টমার্টিন দ্বীপে বিভিন্ন পথে যাতায়াত করেন। পাশাপাশি রাত্রিযাপনও করেন। ফলে অপরিকল্পিতভাবে একের পর এক রিসোর্ট, হোটেল ও রেস্টুরেন্টসহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠছে। এতে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, যত্রতত্র প্লাস্টিকের বর্জ্য, পাথর তোলা, সৈকতের বালি অপসারণ ক্রমাগত বেড়েই চলছে। দ্বীপের ভূগর্ভস্থ সুপেয় মিঠা পানির স্তরও নিচে নেমে গেছে। ফলে কিছু কিছু নলকূপে আসছে লবণাক্ত পানিও।
এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ১৪টি বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও মানছেন না এই দ্বীপে আসা পর্যটকরা। পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, প্রতিদিন পর্যটকদের সংখ্যা সীমিত করে ১০০০ থেকে ১ হাজার ২০০ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখলে এখানকার ভারসাম্য ধরে রাখা সম্ভব হবে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, সেন্টমার্টিন রক্ষায় সরকারের দেওয়া বিধিনিষেধ মানা হচ্ছে না। মানুষের কোলাহল এবং সৈকত ও পানিতে অতিরিক্ত দূষণের কারণে দ্বীপের বহু উদ্ভিদ ও প্রাণী এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়েছে সামুদ্রিক কাছিম। এই দ্বীপ হচ্ছে সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন ক্ষেত্র।
পরিবেশ সংগঠক ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে এককালে দ্বীপটিতে ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, পাঁচ প্রজাতির ডলফিন, চার প্রজাতির উভচর প্রাণী, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ট বা কড়ি জাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, দুই প্রজাতির বাদুড়সহ নানা প্রজাতির প্রাণীর বসবাস ছিল। এসব প্রজাতির অনেকগুলো এখন বিলুপ্তির পথে। পাশাপাশি অপরিকল্পিত স্থাপনা ও লোকবলের চাপে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এসব জীববৈচিত্র্য।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ জানান, কয়েকজন জাহাজ মালিকের লোভে ধ্বংসের পথে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। পর্যটক সীমিত ও রাত্রিযাপন নিষিদ্ধের দাবি জানাচ্ছি। একটি দ্বীপ জাতীয় সম্পদ। এটি কখনো দু’একজন জাহাজ মালিকের লোভের শিকার হতে পারে না।
পরিবেশ সংগঠক ও প্রবীণ সাংবাদিক ফজলুল কাদের চৌধুরী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে জানান, জাহাজের বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ প্রতিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়ে সেন্টমার্টিনে চলাচল করছে বে ক্রুজ নামক জাহাজসহ আরো কয়েকটি জাহাজ। তবে এই দ্বীপে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে মহান আল্লাহপাক ছাড়া সেন্টমার্টিনকে রক্ষা করার কেউ নেই। সবাই ধ্বংসে লিপ্ত। ’
এদিকে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করে সরকার। তবে দুই দশকের বেশি সময়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরিবেশের বিপর্যয় বন্ধ করা যায়নি। বরং প্রতিনিয়ত ঘটছেই।