এমন আন্তরিকতা কোথায় পাবো?
স্মরণ: ভাষা সৈনিক আব্দুল লতিফ
সাবরিনা নিপু: ‘আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারোর দানে পাওয়া নয় ….’ গানটি শুনলেই শরীরের রক্ত চলকে ওঠে অথবা ‘ ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায় ‘ গানগুলো কোনো অনুষ্ঠানে অথবা টিভি রেডিও যেখানেই যখন বেজে ওঠে আমিও সাথে সাথেই হারিয়ে যাই সেই ছোট বেলায় ! তখন বয়স কতো হবে ? আট কি নয় ! ছায়ানটের ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানের জন্য রিহার্সেল করাতে আসতেন লতিফ স্যার ! কি যে যত্ন করে প্রতিটি শব্দে সুর লাগানো শেখাতেন তা ওঁর সান্যিধ্য যারা পেয়েছেন তারাই ভালো জানেন । কখনও কখনও চলে যেতাম ওঁর ইস্কাটন গার্ডেন এর বাসায় । এমন আন্তরিকতা আজ কোথায় পাবো ! ভাবলে স্বপ্নের মতো মনে হয়।
…
ভাষা সৈনিক আব্দুল লতিফ (১৯২৪-২০০৬) একাধারে সঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার। তিনি বরিশালের রায়পাশা গ্রামে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল। এ আকর্ষণ তাঁর গ্রামে তাঁকে গায়ক হিসেবে পরিচিত করে তোলে। গান গাওয়ার অপরাধে তাঁর ফুফু তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফুফুর কাছে গানগুলি ছিল ইসলাম বিরোধী। কিশোর আবদুল লতিফ এ ঘটনার আকস্মিকতায় বিচলিত না-হয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ফুফুকে একটি গান শোনাতে চান এবং তিনি সে প্রস্তাবে সম্মত হন। আবদুল লতিফ আল¬াহ-রসুলের প্রশংসায় ভরা আববাসউদ্দীনের গাওয়া নজরুলের একটি ইসলামি গান গেয়ে শুনান। গান শুনে ফুফু মুগ্ধ হন এবং তাঁকে গান গাওয়ার অনুমতি দেন। এভাবেই পারিবারিক স্বীকৃতি নিয়ে আবদুল লতিফের শিল্পিজীবনের শুরু।
ভাষা সৈনিক আব্দুল লতিফ (১৯২৪-২০০৬) একাধারে সঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার। তিনি বরিশালের রায়পাশা গ্রামে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল। এ আকর্ষণ তাঁর গ্রামে তাঁকে গায়ক হিসেবে পরিচিত করে তোলে। গান গাওয়ার অপরাধে তাঁর ফুফু তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফুফুর কাছে গানগুলি ছিল ইসলাম বিরোধী। কিশোর আবদুল লতিফ এ ঘটনার আকস্মিকতায় বিচলিত না-হয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ফুফুকে একটি গান শোনাতে চান এবং তিনি সে প্রস্তাবে সম্মত হন। আবদুল লতিফ আল¬াহ-রসুলের প্রশংসায় ভরা আববাসউদ্দীনের গাওয়া নজরুলের একটি ইসলামি গান গেয়ে শুনান। গান শুনে ফুফু মুগ্ধ হন এবং তাঁকে গান গাওয়ার অনুমতি দেন। এভাবেই পারিবারিক স্বীকৃতি নিয়ে আবদুল লতিফের শিল্পিজীবনের শুরু।
…
আবদুল লতিফ যখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র তখন তিনি ১৯৩৯ সালে ১৬ বেঙ্গল ব্যাটালিয়ান ইন্ডিয়ান টেরিটোরিয়াল ফোর্স-এ তিনি নির্বাচিত হন। ছয়মাস পর এ ব্যাটালিয়ন ভেঙে দেওয়া হয়। পরে তিনি কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। সরাসরি রাজনীতিতে যোগ না দিলেও তিনি রাজনীতি সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যোগ দেন। চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে তিনি কলকাতায় কংগ্রেস সাহিত্য সংঘে যোগ দেন। সংস্থার অফিস ছিল কলকাতার গোপাল মল্লিক লেনে।
…
রাজনীতি সচেতন নতুন শিল্পীদের এখানে গান শেখানোর ব্যবস্থা ছিল। গান শেখাতেন সুকৃতি সেন। আবদুল লতিফও তাঁর কাছে গান শেখেন। তাদের গানের দলে এবং ক্লাসে তিনি ছিলেন একমাত্র মুসলমান শিল্পী। এ সময় নোয়াখালিতে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা সংঘটিত হলে মহাত্মা গান্ধী শান্তিমিশনে নোয়াখালি আসেন। আবদুল লতিফ কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে বরিশাল থেকে স্টিমারে নোয়াখালি চলে যান। কলকাতায় বিজ্ঞান কলেজে এক সভায় তিনি নোয়াখালিবিষয়ক জনসভায় গান্ধীর সামনে সমবেতভাবে শান্তির গান পরিবেশন করেন। কলকাতায় তাঁর সঙ্গে খ্যাতনামা সঙ্গীতশিল্পী মমতাজ আলী খানের হূদ্যতা গড়ে ওঠে।
…
আবদুল লতিফ কলকাতা থেকে ১৯৪৮ সালে ঢাকা আসেন। এখানে বিখ্যাত গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ১৯৪৭ পরবর্তীকালে হিন্দু শিল্পী-গীতিকারদের দেশত্যাগের ফলে পূর্ববাংলায় বড় রকমের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এ সঙ্কট-মুক্তির লক্ষ্যে তিনি আবদুল লতিফকে গান লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৪৯-৫০ সালে তিনি প্রথমে আধুনিক গান ও পরে লেখেন পল্লিগীতি।
…
আবদুল লতিফের মেজাজে গণসঙ্গীতের উপাদান ছিল। সেটা তাঁর প্রথম জীবনের কলকাতা-পর্বেই পরিলক্ষিত হয়। কংগ্রেস সাহিত্য সংঘে কোরাসে তাঁরা যেসব গান গাইতেন, তা ছিল গণসঙ্গীত। এটা ছিল তাঁর রন্ধ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। বরিশালের গ্রামীণ জীবনধারার লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর মানসজগত ছিল গভীরভাবে প্রোথিত। কীর্তন, পাঁচালি, কথকতা, বেহুলার ভাসান, রয়ানি গান, কবিগান, গুনাই যাত্রা, জারি-সারি, পালকির গান প্রভৃতি সঙ্গীতের সুরকে তিনি নিজের কণ্ঠে ধারণ করেন। এটাই পরবর্তীকালে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তাঁকে বিশিষ্টতা এনে দেয়।
…
তাঁর গানগুলিতে পূর্ব-বাংলার অধিকার বঞ্চিত মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময়ে লেখা তাঁর সবেচেয়ে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত গান-‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’। এ গানটিতে তিনি বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের আবহ ও সুরকে ফুটিয়ে তুলেছেন। গানটি পূর্ব বাংলার ঐতিহ্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার এক প্রতীকী গানের বৈশিষ্ট্য অর্জন করে।
…
আবদুল লতিফ সঙ্গীতের নানা শাখায় বিচরণ করেছেন। বাল্যকাল থেকে গ্রামবাংলার জীবনযাপন পদ্ধতি, আচার-অনুষ্ঠান, সঙ্গীতকলার সঙ্গে পরিচিত হলে তাঁর নিজের মধ্যে একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লাভ করে। উদার ও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত আবদুল লতিফের সঙ্গীতে পরিস্ফুট হয় অসাম্প্রদায়িক লৌকিক গণচেতনা। ‘ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি ‘ এই গানটিতেও প্রথম তিনিই সুর দিয়েছিলেন । জহির রায়হানের একটি চলচ্চিত্রে সুর দিয়ে মিউজিক ডাইরেক্টর হিসেবে আত্ম প্রকাশ করেন ।
১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমী প্রকাশ করে তাঁর ভাষার গান, দেশের গান। এতে আছে বাংলা ভাষা-সম্পর্কিত চবিবশটি। দেশের গান একান্নটি; পঁচানববইটি গণসঙ্গীত, দুটি জারি এবং আটটি মানবাধিকার সম্পর্কিত গান। তাঁর অন্য দুটি বইয়ের নাম দুয়ারে আইসাছে পালকি (মরমী গান) এবং দিলরবাব। ২০০৫ সালের ২৬ফেব্রুয়ারি এই মনীষীর মৃত্যু হয়। আজ এই দিনে তাঁকে স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধায় ।
…
[লেখক: সাবরিনা নিপু।]