হিমোফিলিয়া: সম্মুখ ধারণা থাকা জরুরী

হিমোফিলিয়া: সম্মুখ ধারণা থাকা জরুরী

এসবিডি নিউজ24 ডট কম,ডেস্ক: আমাদের শরীরের কোথাও কেটে গেলে রক্তপাত হয়। শরীরের নিয়মেই বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই রক্তপাত থেমেও যায়। রক্ত জমাট বাঁধতে কাজ করে প্লেটলেটসহ নানা রকম ফ্যাক্টর। এই ফ্যাক্টর উৎপাদনে সমস্যা হলে রক্ত জমাট বাঁধায় সমস্যা সৃষ্টি হয়। ফলে শরীরের কোথাও কেটে গেলে রক্তপাত সহজে বন্ধ হয় না। এটিই মূলত হিমোফিলিয়া।

চিকিৎসা বিজ্ঞান মতে, হিমোফিলিয়া একটি বিশেষ ধরনের রক্তরোগ, যে রোগে শরীরের স্বাভাবিক রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতাটি বিঘ্নিত হয় এবং ফলশ্রুতিতে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হতে থাকে। এটি একটি বংশগত রোগ, যা জিনের মাধ্যমে প্রজন্মান্তরে পরিবাহিত হয়। বিশ্বে প্রতি বছর ১৩০ মিলিয়ন শিশু জন্মগ্রহণ করে, যার মধ্যে ২০ হাজার শিশু জন্মগতভাবে হিমোফিলিয়া নিয়ে জন্মায়। বিশ্বে ১০ হাজারে একজন এই রোগে ভুগছে, যার ৭৫ শতাংশ রোগীই সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত।

হিমোফিলিয়া কীভাবে হয়?

হিমোফিলিয়া একটি বংশানুক্রমিক জিনগত রোগ। এই রোগে রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। তাই শরীরে কোথাও কেটে গেলে আর রক্তপাত বন্ধ হয় না। আমাদের শরীরের এক্স ক্রমোজোমে এফ৮ (F8) ও এফ৯ (F9) নামের জিন থাকে, যা ফ্যাক্টর-৮ ও ফ্যাক্টর-৯ নামের প্রোটিন তৈরির কাজের সঙ্গে জড়িত। শরীরের কোথাও কেটে গেলে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে এই ফ্যাক্টরগুলো কাজ করে। এই প্রোটিন স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কম পরিমাণে থাকলে রক্ত জমাট বাঁধায় সমস্যা দেখা দেয়।এর ফলে কোথাও কেটে গেলে রক্তপাত সহজে বন্ধ হয় না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় তখন এই রোগকে বলা হয় হিমোফিলিয়া। হিমোফিলিয়া সাধারণত দুই প্রকার।

(১) হিমোফিলিয়া ‘এ’
(২) হিমোফিলিয়া ‘বি’।

[এছাড়া হিমোফিলিয়া ‘সি’ নামেও এক ধরনের হিমোফিলিয়া আছে, যা খুবই বিরল।]

রোগের লক্ষণ:

অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ বা কেটে গেলে রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়াটাই হিমোফিলিয়ার মূল লক্ষণ। সাধারণত শিশু বয়সেই এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। এ ছাড়া কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে রক্তক্ষরণ হয়। শরীরের কোথাও আঘাত লাগলে সেই জায়গাটি নীলচে হয়ে ফুলে যায় অর্থাৎ চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ, মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধিতে রক্তক্ষরণ, হাঁটু, কনুই ও অন্যান্য অস্থিসন্ধি ফুলে যাওয়া, শরীরের কোথাও কেটে গেলে দীর্ঘক্ষণ রক্ত ঝরা, দাঁত তোলার পর বা সুন্নতে খতনা করার পর রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়া, শিশু হামাগুড়ি দেয়ার সময় হাঁটুতে কালচে দাগ হওয়া, নবজাতকের নাভি কাটার সময় দীর্ঘক্ষণ রক্তক্ষরণ হওয়া ইত্যাদি।

হিমোফিলিয়ার বংশগতি:

১. যদি বাবা সুস্থ ও মা বাহক হন, তবে ছেলে সন্তানের রোগী হওয়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ আর কন্যা সন্তানের বাহক হওয়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ।
২. যদি বাবা রোগী ও মা সুস্থ হন, তবে সব ছেলে সন্তানই সুস্থ হবে এবং সব কন্যা সন্তানই বাহক হবে।
৩. যদি বাবা রোগী ও মা বাহক হন, তবে ছেলে সন্তানের রোগী হওয়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ। আর কন্যা সন্তানের রোগী হওয়ার আশঙ্কা ২৫ শতাংশ এবং বাহক হওয়ার আশঙ্কা ২৫ শতাংশ।

সুতরাং প্রত্যেক হিমোফিলিয়া পুরুষ রোগী বিয়ে করতে পারবে, তবে সন্তান নেয়ার ক্ষেত্রে রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সাধারণত শুধু পুরুষরাই এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং নারীরা এই রোগের বাহক। তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে নারীরাও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বাবা রোগী ও মা বাহক হলে মেয়েরাও রোগী হতে পারে।

বাংলাদেশে হিমোফিলিয়া:

বাংলাদেশে কতসংখ্যক হিমোফিলিয়া রোগী আছে তার আসলে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে জরিপে দেখা যায়, বিশ্বে প্রতি ১০ হাজারে একজন হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। সেই হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার হওয়ার কথা থাকলেও দেশের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রায় তিন-চার হাজার রোগী নিয়মিতভাবে চিকিৎসাসেবার আওতায় আছে।

চিকিৎসা:

অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ থেকে সাবধান থাকাই এই রোগের প্রধান চিকিৎসা। তাই আক্রান্ত রোগীকে নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক চলতে হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা, ক্রাইয়োপ্রেসিপিটেট পরিসঞ্চালন করতে হয়। ফ্যাক্টর-৮ ও ফ্যাক্টর-৯, যা এই রোগীদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি হয় না, এগুলো ইনজেকশনের মাধ্যমে নিতে হয়। এসব ইনজেকশন অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফলে হিমোফিলিয়া রোগের সঠিক চিকিৎসা বাংলাদেশের বেশির ভাগ রোগীরই নাগালের বাইরে। সঠিক চিকিৎসার অভাবে অনেক মা-বাবা অকালে তাঁদের সন্তান হারান।

এসবিডি নিউজ ডেস্ক