মাদক: সামাজিক উদ্বেগের কারণ!

মাদক: সামাজিক উদ্বেগের কারণ!

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: দেশের সর্বত্র মাদক এখন সহজলভ্য। শহর-নগর, গ্রামসহ মফস্বল এলাকায়ও হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা, আফিম, চরশ, বাংলা মদ, গুল, মরফিন, কোকেন, হেরোইন, প্যাথেলিন, মারিজুয়ানা, ডেক্রপরটেন, প্যাথেড্রিন, কোকেন, ইকসটামি, এলএসডি, ইলিকসার, চোলাইমদসহ রকমারি মাদকের সঙ্গে তরুণদের সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে মাদকের তালিকায় যোগ হয়েছে বেশ কয়েকটি নতুন নাম। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘কুশ’, ‘ডিওবি’, ‘ডিওএস’, ‘ম্যাজিক মাশরুম’, ‘টাপেন্টাডল’, ‘বুপ্রেনরফিন’, ‘ট্যাপেন্টাডল’ সহ আরও কয়েকটি মাদক।

সংশ্লিষ্টরা জানান, অনেক সময় নতুন স্বাদ এবং নতুন অভিজ্ঞতার জন্যও দেশের মাদকসেবীদের এক্সপেরিমেন্টে যুক্ত হচ্ছে অজানা সব মাদকের নাম। তরুণ মাদকসেবীদের কাছে ব্যাপক চাহিদা সেগুলোর। সে কারণে দেশের বাজারে প্রতি নিয়ত যুক্ত হচ্ছে নিত্য নতুন মাদক। যেগুলো কৌশলে বাজারজাত করা হচ্ছে এবং ক্রমশ সহজলভ্য করা হচ্ছে। এসব মাদক নীরবে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে দেশের আনাচে-কানাচে।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, দাম কম ও সহজলভ্য হওয়ায় ভয়াবহ সব মাদকের দিকে ঝুঁকছে সেবীরা। যেমন ইয়াবার বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘টাপেন্টাডল’। শুরুতে সীমান্ত এলাকায় এই মাদকের প্রভাব থাকলেও বর্তমানে রাজধানীসহ সারা দেশেই ব্যবহার বেড়েছে। ইয়াবার ব্যাপকতা ঠেকাতে সকারের কঠোর নজরদারির মধ্যে ব্যথানাশক ট্যাবলেট ‘টাপেন্টাডল’ বছর পাঁচেক আগে মাদক হিসেবে ব্যবহার শুরু হয় দেশে।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, দেশে এখন পর্যন্ত ৩৭ ধরনের মাদকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ম্যাজিক মাশরুম, ডায়মিথাইলট্রিপ্টামাইন (ডিএমটি), লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড (এলএসডি), ক্রিস্টাল মেথ বা আইস বা মেথামফিটামিন, এস্কাফ সিরাপ, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন, প্যাথিডিন, বিভিন্ন ধরনের মদ, রেক্টিফায়েড স্পিরিট, ডিনেচার্ড স্পিরিট, তাড়ি, বুপ্রেনরফিন (টি.ডি. জেসিক ইঞ্জেকশন), ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড ওয়াশ (জাওয়া), বুপ্রেনরফিন (বনোজেসিক ইনজেকশন), মরফিন, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট ও মিথাইল-ইথাইল কিটোনসহ আরও নতুন কিছু মাদক এসেছে। এগুলো আপাতত ছড়িয়ে না গেলেও কিছু সংঘবদ্ধ মাদকসেবী সেগুলো গ্রহণ করছে এবং বাজার তৈরির চেষ্টা করছে।

২০২২ সালে ‘বিবিসি বাংলা’য় প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, বাংলাদেশের ঢাকায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অগস্টের গোড়ার দিকে এক ব্যক্তিকে আটকের পর জানা গেছে যে তিনি নিজের বাড়িতেই একটি বিশেষ মাদক তৈরি করে বাজারজাত শুরু করেছিলেন, যা বাংলাদেশেই নতুন। এর আগে বাংলাদেশে এই মাদক ব্যবহারের কোন খবর পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে। অপ্রচলিত অর্থাৎ নতুন এই মাদকটির নাম ‘কুশ’। একই সাথে তিনি বাজারজাত করছিলেন হেম্প, মলি, এডারল ও ফেন্টানিল সহ আরও কয়েকটি অপ্রচলিত ধরনের মাদক। বিদেশ থেকে পড়ালেখা করে আসা ওই ব্যক্তি নিজের বাড়িতে ‘কুশ’ তৈরির জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ স্থাপনা তৈরি করেছিলেন। কুশের মতো অপ্রচলিত ধরনের কিছু মাদক বাংলাদেশে আসা শুরু হয়েছে, যদিও সাম্প্রতিক সময়ে বেশি উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে ক্রিস্টাল মেথ বা আইস।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের হিসেবে দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ এবং সবচেয়ে বেশি মাদক ব্যবহারকারী আছে ঢাকা বিভাগে। যদিও বেসরকারি হিসেবে, মাদক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭০ লাখের কাছাকাছি বলে দাবি করে বিভিন্ন সংস্থা। এদের বিরাট অংশের মধ্যে জনপ্রিয় মাদক হলো ইয়াবা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আইস বেশি আসছে আর নতুন করে পাওয়া যাচ্ছে কুশের মতো অপ্রচলিত নানান মাদক, যা উদ্বেগ তৈরি করছে মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের মধ্যেও।

এদিকে, আরও একটি নতুন মাদকের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেটির নাম ‘কেটামিন’। এটি ‘পার্টি ড্রাগ’ নামেও পরিচিত। ভয়ঙ্কর এই মাদকে আসক্ত হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অভিজাত পরিবারের সন্তানরা সহজে এই মাদক পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান, ধানমণ্ডি ও   বনানীতে কেটামিনের প্রচুর চাহিদা। বিভিন্ন পার্টিতে নেশাজাতীয় এই নতুন মাদক সেবন করিয়ে ঘটছে ধর্ষণের ঘটনাও।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোমল পানীয়ের সঙ্গে পাউডার জাতীয় মাদকটি মিশিয়ে সেবন করালে অনেকে সেটি বুঝতে পারে না। এটি সেবনের পর অনেকের স্বাভাবিক জ্ঞান থাকে না। এসময় তরুণীদের সঙ্গে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। দাম বেশি হওয়ায় শুধু ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানরা ব্যবহার করে।

জানা গেছে, নতুন ধরনের অপ্রচলিত এই মাদকটি অত্যন্ত ভয়াবহ। এটি কেউ সেবন করলে কল্পনার জগতে চলে যায়। সেবনের পর স্বাভাবিক জ্ঞান থাকে না। চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত একটি জরুরি ওষুধের ব্যবহার করে এই মাদক উৎপাদন করা হচ্ছে।  এটি ব্যবহারের ফলে মাদকসেবীর নিজের প্রতি কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কেউ কেউ মাদকটিকে বলে ‘রেপ ড্রাগ’ বা ‘পার্টি ড্রাগ’। এর কোনো ঘ্রাণ বা রং নেই। বিভিন্ন দেশে এ মাদক ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। ১৯৭০ সাল থেকে ইউরোপ ও আমেরিকায় এটি খুবই জনপ্রিয়। নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে সেবনকারী অন্য জগতে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়।

মাদকের তালিকায় ‘ভয়ংকর’ উপমা পাওয়া ‘মাঙ্কি ডাস্ট’ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এটি সেবনে সব বিবেচনা লোপ পায়। সেবনকারীর নিজের প্রতি কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এটি দামে সস্তা, কিন্তু এর প্রভাব তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী; যা ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এটিতে আসক্ত ব্যক্তি হ্যালুসিনেশন, অস্বাভাবিক ও হিংস্র আচরণ করে থাকে। ‘মাঙ্কি ডাস্ট’ সেবনে হার্টের সমস্যা ও কিডনি নষ্ট হয়।

জানা গেছে, মাঙ্কি ডাস্ট ক্যাথিনোন থেকে তৈরি হয়। ক্যাথিনোন হলো একধরনের প্রাকৃতিক উত্তেজক, যা উদ্ভিদে পাওয়া যায়। সাধারণত সাদা, হলুদাভ বা বাদামি পাউডারের মতো এই মাদক ম্যাজিক ক্রিস্টাল, মিথানল অথবা পাইরোভালেরোন নামেও পরিচিত। এটি ধূমপানের মাধ্যমে সেবন করা হয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইনজেকশনের মাধ্যমেও নেওয়া হয়। নতুন এই মাদক যুক্তরাজ্যের স্টোক-অন-ট্রেন্ট এবং স্ট্যাফোর্ডশায়ারে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। ল্যাবে তৈরি সিনথেটিক এই মাদক বহু জীবন ও পরিবার ধ্বংস করে দিয়েছে। এই মাদককে ক্ষতির দিক থেকে ‘এ’ ক্লাস (প্রথম সারির) হিসেবে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাজ্য সরকার।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে এ পর্যন্ত ২৫ ধরনের মাদক শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ইয়াবা, হেরোইন, কোকেন, আফিম, গাঁজা, ফেনসিডিল ও ইনজেকটিং ড্রাগ অন্যতম। এগুলো গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। গত তিন বছরে মাদকের তালিকায় যোগ হয়েছে ম্যাজিক মাশরুম, নিউ সাইকো অ্যাকটিভ সাবস্টেশন (এনপিএস) বা খাট, ডায়মিথাইলট্রিপ্টামিন (ডিএমটি), লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথাইলামাইড (এলএসডি), ক্রিস্টাল মেথ বা আইস বা মেথামফেটামিন। সর্বশেষ যোগ হয়েছে পোল্যান্ড থেকে আসা ডিওবি। নতুন মাদকে আসক্তিও দ্রুত বাড়ছে।

প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করার পরও থেমে নেই এর বিস্তার। প্রচলিত মাদক যখন আনা কঠিন হয়ে পড়েছে, তখন মাদকাসক্তদের সামনে পেশ করা হচ্ছে অন্য কোনো নেশাদ্রব্য। সেই নেশায় ঝুঁকছে তরুণ কিশোর থেকে শুরু করে বয়স্ক মাদকসেবীরাও। এ সুযোগে দেশে নিত্যনতুন মাদক আনছে কারবারিরা। মাদক প্রতিরোধে কাজ করা ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মাদকের ট্রানজিট রুটে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মাদকচক্র বাংলাদেশকে এখন ‘সেফ রুট’ হিসেবে ব্যবহার করছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গডফাদারসহ উচ্চপর্যায়ের মাদক কারবারিরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। দেখা যায়, পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়াদের অধিকাংশই মাদকের বাহক। আবার এলাকায় যারা ক্ষুদ্র মাদক কারবারি হিসাবে পরিচিত, তারা মাঝেমধ্যে গ্রেফতার হলেও অল্পদিনেই ছাড়া পেয়ে ফের একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। দেশে মাদক বিস্তারের এটিও অন্যতম কারণ। কাজেই এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুধু বাহক নয়, সমন্বিতভাবে গডফাদারদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, মাদকের বিস্তার রোধ করতে না পারলে সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়বে। দেশে মাদকের বিস্তার রোধে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, এটাই প্রত্যাশা।।

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।

jsb.shuvo@gmail.com

editor