দুনিয়াদারি

দুনিয়াদারি

সা লে হ আ হ ম দ: নিজের মেয়েকে নিয়ে একটা গল্প। একেবারে জীবনের গল্প। সেই ছোট কাল থেকে আমি ওর প্রতি অনিরপেক্ষ। সংসারের যত আনন্দ তার উৎসই যেন এই মেয়ে। আমার আর ওর মধ্যে একটা আত্মস্বীকৃত বোঝা পড়া আছে যা কেউ কাউকে বলিনা।

গতকাল শুনলাম ও আসবে। আমার ভেতরটা চাঞ্চল্যে ভরে যায়। চোখ ভিজে আসে আনন্দে! এ এক দারুন স্বার্থপর অনুভূতি। মনে মনে বলি, তুই কোন কাননের ফুল, মা? কত যত্নে আদরে, স্নেহে বড় হলি তুই। তুই শুধু আমারই ছিলিনারে মা। তোর দুনিয়াতে তোর কাকারা, ফুফুরা, খালামনি, মামা, মামি, চাচাতো ভাই বোন, তুই তো সবারই নাম্বার ওয়ান।

ফোনে মেয়ের আসার খবর শুনে উবার ড্রাইভারকে বললাম, গাড়িটা একটু ঘুরাবেন? একটু রিংরোড যাবো। মেয়ের পছন্দের মিষ্টি কিনতে হবে। ড্রাইভার বললো, স্যার সামনেইতো মিষ্টির দোকান, থামবো? আমি বলি, না, আদি বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারে যাবো। ওই দোকানের কাশ্মীরি চমচম আমার মেয়ের পছন্দ। ড্রাইভার কী ভেবে বললো, স্যার চমচম তো অনেক খাইছি। তবে কাশ্মীরি চমচম খাই নাই। আমি বললাম, এটা খুব পছন্দ আমার মেয়ের। তাই তোমাকে বাবা কষ্ট দিচ্ছি।

আমার মেয়ে তার সংসার নিয়ে আছে। আমি আছি আমার মেয়েকে নিয়ে। ফোন করলে বিরক্ত হয়। বলে, আব্বা, দুই দিন আগে তোমার ওখান থেকে আসছি। আর আসতে বলবানা! আমি চুপ থাকি। কারণ কথা বাড়ালেই কথা বাড়বে। নিজেই নিজেকে জিগ্যেস করি, “তোমার ওখান থেকে, তোমার ওখান থেকে”!আত্মজার কাছে এখন ‘ওখান,ওখান’ হয়ে গেছে। বাবার বাড়ি এখন ‘ওখান’!

বাবাতো ওখান হয় না, বাবা খান খান হয় মেয়ের বিরহে। মাঝে মাঝে মেয়ে আমাকে সারপ্রাইজ দেয়। ওর মাকে বলে, আম্মা, রাতে আমরা আসব। দেরি হবে। উপলের অফিস থেকে ফিরতে রাত হয়। এসে খাবো। আব্বাকে যাগাই রাখবা। আর শোন, আব্বাকে বলবানা, আমরা আসতেছি। আমি খবরের কাগজে হয়তো ডুবে আছি কিংবা কোন টিভি টকশো দেখছি। অনেক রাত। কলিং বেল বাজলো। এত রাতে কলিং বেল? বিরক্তি নিয়ে দরোজা খুলি। হতবাক হয়ে দেখি আমার উপল, আমায়রা, সাদিয়া। আমি কিছু বলতে পারিনা। খোলা দরোজা দিয়ে ওরা ঘরে ঢোকে। আমি ফ্রিজের দরোজা খুলি। দেখি কোকের বোতল আছে কী না। উপল পছন্দ করে। আর দেখি ফ্রীজের কোনাকানিতে রসগোল্লা অবশিষ্ট আছে নাকী। সাদিয়ার রেশমী চমচম। না আজ কিছুই অবশিষ্ট নেই। শার্ট পরে বাইরে যেতে উদ্যত হই। কী করে সাদিয়া বুঝে ফেলে। আমাকে রীতিমত ধমকায়। ‘খবরদার এত রাতে বাইরে যাবানা’।

পরে দেখি ওদের ঝুড়ি থেকে বের হচ্ছে বগুড়ার দই আর রোস্টেড নাট, সাদিয়ার মায়ের পছন্দ। আমার দুটি ছেলে আর তাদের আনন্দের সংসার আমাকে নিরুদ্বেগ রাখে। ভালোবাসা, ওদের দায়িত্ব সব মিলিয়ে আমি পরিপূর্ণ।

কিন্তু মেয়েটাকে নিয়ে এমন অনুভূতি কেন হয়? সব সময় হারিয়ে ফেলার ভয়। ওকে নিয়ে সুখময় এক বেদনার ভারে সব সময় নিমজ্জমান থাকি। আমার কোন অসুবিধার সময় রক্তের সম্পর্কিত মানুষজন বিরক্ত হয়। বলে,আমাকে নিয়ে তাদের এসব গেন্জাম পছন্দ নয়। আমি যখন পুড়ে যাই, দেখি কেউ আনন্দ করতে দূরের নিরিবিলি জীবনে ক্লান্তি দূর করতে গেছে। আমার মেয়ে ঘুরে দাড়ায়। ওর দাড়ানো, স্থিরতা, সাহস, শক্তি যেন আমারই আয়না হয়ে আমারই পাশে দাঁড়ায়। আমি তখন “শিশু হয়ে আছি তাই ট্রেনের জানালা” হয়ে যাই। আমার কিসের চিন্তা? আমার মেয়ে আছেনা? আমার দুনিয়ার সব কষ্টাঘাত যেন সে বইবে। আমার কোন ভয় নাই।

মেয়েরা বুঝি এ রকমই হয়। জীবনের যত দুঃখ, যত আনন্দ তার সব টুকু ভাগ আমার মেয়েটা আমার সংগে বাটেয়ারা করে। প্রতিটা জীবনেরই একটা মর্মকথা থাকে। আমার বেলায় সেটা আমার মেয়ে।

বড় ছেলে ড.ফয়সাল হওয়ার পর কিশোর বাংলায় একটা কবিতা লিখেছিলাম। দ্বিতীয় ছেলে ফাহিমকে নিয়ে “ঘুম “একটা গল্প এখলাস উদ্দিন আহমদ সম্পাদিত” রঙিন ফানুস “এ লিখেছিলাম। সাদিয়ার দুঃখ, আব্বা, তুমিতো আমাকে নিয়া কিছু লিখলানা? ওহ্, আমিতো তো মেয়ে তাই।

কী উত্তর দিব,আমার আত্মজাকে?

অতিথি লেখক