দুনিয়াদারি__পর্ব-১১
__দুনিয়াদারি_পর্ব-১১__
–সা লে হ আ হ ম দ–
_________________________________________________________
প্রিয় শুভাশিস ব্যানার্জি,
ছেলেমেয়েরা আব্দার করবে এটাই স্বাভাবিক। শুভাশিস ভাবে ওর প্রয়াত বাবা সুনীল ব্যানার্জির সব বন্ধুরা ওর বাবার জায়গা নিয়েছে। বুঝি, যখন শুভাশিসের মনখারাপ হয় তখন বাবার ছবি দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মন হালকা করে। শুভাশিস এখন বুঝতে বুঝতে পাকা হচ্ছে, বুঝতে শিখছে পৃথিবীটা কত কঠিন জায়গা।বাবা থাকতে বাবারা রোদ বৃষ্টি ঝড় বাদল সামলান, ছেলেমেয়েদের বুঝতে দেননা। যেমন কাছিম তার ওপরের শক্ত আবরন দিয়ে শরীর বাঁচায়, তেমনি বাবারা বুলেট প্রুফ জ্যাকেট জড়িয়ে বাচ্চাদের আগলে রাখে।
শুভাশিস মাঝে মাঝে আমার বোধিকে জাগায়,অনুনয় করে,অভিমান করে,কই আপনি আমার বাবার না এতো বন্ধু, আংকেল আপনি না বলেছিলেন, আমার বাবাকে নিয়ে লিখবেন?
সুনীল চলে গেছে সে অনেক দিন, আমার চাইতে সুনীল অনেক ব্রিলিয়ান্ট, অনেক বোকাও। সে বিসিএস করে পুলিশে যোগ দেয়নি সাংবাদিকতা করবে। বাংলার বাণীতে আমাদের যাত্রা শুরু,আমি বেশি এগোইনি, সে আরো স্মার্ট কাগজ দৈনিক বাংলায় জয়েন করলো। পঁচাত্তরের জুনে আমরা চাকরি হারালাম, সে দিব্যি থেকে গেলো। বাকশালের চারটা কাগজের মধ্যে দৈনিক বাংলা থেকে গেলো, আমরা বেকার হয়ে পড়ে রইলাম। প্রেসক্লাবে যাই,আড্ডা মারি, মাসে তিনশ বিশ টাকা সরকারি ভাতা পাই। হতাশায় জীবন যখন দেয়ালের পিঠ ঠেকছে,সুনীল সাহস দেয়। একটু আধটু ধার টার করতে হতো ওর কাছ থেকে,আমি বিবাহিত, স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, আমি বেকার, সংসারের টাকা লাগেই, সুনীলের কুমার জীবন, অনেক টাকা কামায়, দিতে অসুবিধে কি?
তখন বেকার সাংবাদিকদের অবস্থা এমনই সঙিন যে গণকন্ঠের একজন সিনিয়র সাব এডিটরকে রাজশাহী থেকে পাইকারি আম কিনে বাইতুল মোকাররমের ফুটপাতে বিক্রি করতে হয়েছে। সেই ছবি আবার বাংলাদেশ টাইমস পত্রিকায় ছাপা হলে হৈ চৈ পড়ে যায়। পরে জিয়াউর রহমান এসে সাংবাদিকদের তৃতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি দিলেন। বেশির ভাগ সাংবাদিকই পরে চাকরি ছেড়ে দেন। এর মধ্যে রঞ্জু ইসলাম, আমীর খসরুর কথা মনে আছে। আমি চাকরি ছেড়ে কর্পোরেট অফিসে ঢুকে যাই।
সুনীল বড় সাংবাদিক। আমার অনেক বন্ধু, এক সময়ের ছোট ভাইের মতো অনেক সাংবাদিক,যাঁরা সবাই এখন বড় বড় জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক, প্রেসক্লাবের সেক্রেটারি, সভাপতি, তাদের কাছে ঘেঁষতে দ্বিধান্বিত বোধ করি,কারন তাদের গায়ে অনেক গন্ধ। জাতি ভাই তো,তাই দুর্গন্ধ সহজেই টের পাই। সুনীল বড় সাংবাদিক হয়েও আমার সাথে তেমন ভাব দেখায় নি, উল্টো ফোন করে প্রতিশোধ নিতো। শালা,এখন টাকা চিনে ফেলেছো, আমারে ফোন করবা ক্যান?
কী আর এমন টাকা কামাই করেছি? ব্যার্থতা,যুদ্ধে হেরে যাওয়া সিনেমার ট্র্যাজিক নায়কের মতো
ধ্বসে গেছি, পাওনা এটুকুই,এখনো কারো কাছে ছোট হতে হয়নি।
শোন শুভাশিস, এই যে তোমার আংকেল ধীরে ধীরে ডুবতে থাকলো, তা কিন্তু তার ছেলেমেয়েদের জানতে দেয়নি, আল্লাহ মানুষকে সবদিক দিয়ে মারেনা,নদীর পাড় একদিকে ভাংলেও অন্যদিক চর জাগে। সেখানে নদী সিকস্তি মানুষ নতুন ঘর বাঁধে। আমার জীবনের প্রদীপ যখন নিভু নিভু, ততদিনে আমার ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। নতুন জাগা চরের মতো ওরাই আশায় বাঁচিয়ে রেখেছে। জীবন নদী ভাঙ্গা গড়ার খেলা,কথাটা পুরানো হলেও সত্যি। বাবাকে তুমি মিস করো আমি জানি। এই মিস করাটাই যুদ্ধের একটা অংশ,যে যুদ্ধ তোমার বাবাও করে গেছেন। তোমার সেই যোদ্ধা বাবাকে আমার সালাম,কারন তোমার বাবা একজন ভালো মানুষ ছিলেন।।