স্বাগত চোদ্দ শ’ উনিশ
সাযযাদ কাদিরঃ ঘটনাবহুল একটি বছর শেষে আসছে আরেকটি বছর। ক’দিন পরেই আমরা অভিনন্দন জানাবো নতুন বছরকে, উদযাপন করবো বছরের প্রথম দিন ? ১লা বৈশাখ ১৪১৯ বঙ্গাব্দ, ১৪ই এপ্রিল ২০১২ অব্দ (খ্রিষ্টাব্দ), ২১শে জুমাদা আল-আউয়াল ১৪৩৩ হিজরি সন ? বঙ্গাব্দ পালনকারী বাঙালির জন্য এ দিনটিতে শুরু হবে নতুন একটি বছর। কিন্তু খৃষ্টীয়, হিজরি বা অন্যান্য সন অনুসরণকারীদের জন্য নতুন বছরের প্রথম দিনটি নির্ধারিত হয়ে আছে ভিন্ন-ভিন্ন তারিখে। এর কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের বর্ষপঞ্জি।
সময়-গণনার এই বিশেষ পদ্ধতিটি সুপ্রাচীন, একই সঙ্গে সমস্যাসঙ্কুলও বটে। ওইসব সমস্যা এখনও আছে, পাশাপাশি আছে সমাধানেরও চিরন্তন প্রয়াস। বহমান সময়ের হিসাব সংরক্ষণের এই পদ্ধতির নাম “বর্ষপঞ্জি” (“পঞ্জিকা”) বা “ক্যালিনডার”।
প্রাচীনকালে মানুষ যখন বুঝতে পারে প্রকৃতি মূলত নিয়ম-শাসিত, আর প্রকৃতির নিয়মে ঋতুর যে পরিবর্তন ঘটে তা-ই নিয়ন্ত্রণ করে তাদের জীবন, চাহিদা ও খোরাক ? তখন তাদের জন্য দরকারি হয়ে ওঠে বর্ষপঞ্জি। কবে শীত নামবে, বর্ষা শুরু হবে ? তা জানতে হবে আগেভাগে, নইলে ওই বিপদকালের জন্য প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব কিভাবে! ঘড়ি আবিষ্কারের আগে মানুষ সময়ের হিসাব রেখেছে সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজির মাধ্যমে। সূর্যের উদয় ও অস্তের মাধ্যমে সে পেয়েছে সবচেয়ে সহজ ও স্বাভাবিক এক একক ? সৌর দিন । ঋতুগুলোর মাধ্যমে মোটামুটিভাবে পাওয়া গেছে আরও একটি সহজ একক ? সৌর বর্ষ।
সেকালের মানুষ অবশ্য জানতো না ঋতু পরিবর্তনের কারণ। সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী যে ঘোরে সে সত্য অজ্ঞাত ছিল তাদের কাছে। তবে চাঁদের আকার ও অবস্থানের পরিবর্তন তো চোখে পড়ে সহজেই। ফলে প্রাচীনতম বর্ষপঞ্জিতে এক পূর্ণিমা থেকে আরেক পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়ের হিসাব থেকে চান্দ্র মাস নির্ণয়ের ব্যাপারটি ঘটে। সৌর দিনের সঙ্গে সৌর বর্ষের হিসাব মেলাতে যুক্ত হয় এই মাসের হিসাব।
চান্দ্র মাসের হিসাব আমাদের সকলেরই জানা ? গড়ে ২৯.৫৩০৫৮৯ দিনে হয় এক চান্দ্র মাস। এ রকম ১২টি মাস মিলে হয় প্রায় ৩৪৫ দিন। ফলে সৌর বর্ষ থেকে তা হয়ে পড়ে ১১ দিন কম। এক সৌরবর্ষ হতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড। এই অসংগতি চলছে হাজার-হাজার বছর ধরে। চান্দ্র ও সৌর বর্ষপঞ্জিতে সাযুজ্য বিধান করা সম্ভব হয়নি এখনও।
প্রাচীনকালের বর্ষপঞ্জিতে চালু হয়েছিল সৌর ও চান্দ্র বর্ষে সমতা বজায় রাখার জন্য কোনও বছর ১২ মাসে, কোনও বছর ১৩ মাসে গণনা করার নিয়ম। তাই গ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর দক্ষিণ উপত্যকায় অবস্থিত বেবিলন-এর জ্যোতিষীরা যে বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করতেন তাতে অনেক আদিম বৈশিষ্ট্য ছিল। অনিয়মিতভাবে কোনও-কোনও বছরের শেষে তাঁরা জুড়ে দিতেন একটি অতিরিক্ত মাস। রাজজ্যোতিষীরা যখন বুঝতেন বর্ষপঞ্জির হিসাব অনুযায়ী আর কাজ চলছে না তখন একমত হয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা ঘোষণা করতেন তাঁরা। এ রকম ঘোষণা তিনবারও করতে হতো তাঁদের। কিন্তু এতে হিসাবের ভুল ও অন্যান্য বিভ্রান্তি এড়ানো যেতো না কোনও ভাবে। সম্ভবত মিশর-এর জ্যোতিষীরাই প্রথম ব্যবহার করেন একটি পূর্ণাঙ্গ সৌর বর্ষপঞ্জি। তাঁরা খেয়াল করেছিলেন কয়েক মাস অদৃশ্য থাকার পর সূর্যোদয়ের ঠিক আগে আকাশে দেখা দেয় লুব্ধক নক্ষত্র । তারা আরও খেয়াল করেছিলেন, লুব্ধক-এর পুনরুদয়ের পর-পরই নীলনদে আসে বাৎসরিক বন্যা। এই ঘটনাকে নির্দেশিকা হিসেবে রেখে ৩৬৫ দিনের এক সৌর বর্ষ নির্ণয় করেন তাঁরা। ওই বর্ষ হতো ১২ মাসে, আর প্রতিটি মাস হতো ৩০ দিনে। বছর শেষে যুক্ত হতো অতিরিক্ত পাঁচ দিন । দিনের অতিরিক্ত চতুর্থাংশ হিসাবে না রাখায় তাদের বর্ষপঞ্জিতে গরমিল ঘটতো নিয়মিত। মিশরের এই বর্ষপঞ্জি নিয়ে গবেষণা হয়েছে অনেক। গবেষকরা ধারণা করেন, অন্তত ৪২৩৬ পূর্বাব্দে প্রচলিত ছিল মিশরীয় বর্ষপঞ্জিটি।
রোম-এর জ্যোতিষীরা বর্ষপঞ্জির ধারণা পেয়েছিলেন গ্রিক জ্যোতিষীদের গণনা থেকে। তাঁদের পঞ্জিতে ছিল ১০ মাস, আর ৩০৪ দিনে এক বছর। বাকি ৬০ দিন তাঁরা হিসাবে রাখতেন না, ওই দিনগুলো ছিল শীতকালের মধ্যভাগে। রোম নগরীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উপকথায় বর্ণিত রোমালাস (আ. ৭৭১-৭১৮ পূর্বাব্দ) ৭৩৮ পূর্বাব্দে ওই বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন বলে কথিত আছে।
রোমালাস-এর উত্তরাধিকারী নুমা পমপিলিয়াস (৭১৫-৬৭৩ পূর্বাব্দ) ওই পঞ্জির শুরুতে একটি এবং শেষে আরও একটি মাস গণনার নির্দেশ দেন। এছাড়া সৌর বর্ষের সঙ্গে হিসাব মিলাতে তিনি ২২ ও ২৩ দিনের আরও একটি মাস নির্ধারণ করেন। ওই মাসটি এক বছর পর-পর যুক্ত হতো বছরের শেষ মাসটির ২২,২৩ তারিখের মধ্যে। ওই বর্ষপঞ্জির হিসাব বদলানো হয় ৪৫২ পূর্বাব্দে।
জুলিয়াস সিজার (১০০-৪৪ পূর্বাব্দ) রোম সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়ে লক্ষ্য করেন বিদ্যমান বর্ষপঞ্জির হিসাব তিন মাস আগে চলছে প্রত্যেক ঋতুর। তিনি তখন জ্যোতিষী সোসিনিজিনিস-কে নির্দেশ দেন পঞ্জিকা সংস্কারের। ওই সংস্কারের ফলে ৩১ ও ৩০ দিনের পর্যায়ক্রমিক ১২টি মাস নিয়ে গণনা করা হয় একটি বছর, তবে দ্বিতীয় মাসের জন্য নির্ধারিত হয় ২৯ দিন। চার বছর পর-পর ওই মাসটি গণনা করা হতো ৩০ দিন হিসাবে। একই সঙ্গে ৪৬ পূর্বাব্দে, অন্য এক নির্দেশে ৪৪৫ দিনে গণনার ঘোষণা দেয়া হয়। পরে সম্রাট অগসতাস (৬৩ পূর্বাব্দ – ১৪ অব্দ) দ্বিতীয় মাসের একটি দিন সরিয়ে নিয়ে যান অষ্টম মাসে ? যাতে সপ্তম মাসের সমান সংখ্যক দিন থাকে ওই মাসেও।
‘জুলিয়ান’ নামে খ্যাত এই বর্ষপঞ্জি ১৫০০’র বেশি বছর ধরে চালু ছিল। এই পঞ্জি অনুযায়ী প্রতিটি বছর ছিল ৩৬৫.২৫ দিন। অর্থাৎ প্রতিটি সৌরবর্ষ থেকে ১১ মিনিট ১৪ সেকেন্ড দীর্ঘ। ফলে ঋতুভিত্তিক তারিখে গরমিল দেখা দিতে থাকে। ১৫৮০ সালে মহাবিষুবের তারিখ দেখা দেয় ১১ই মার্চ হিসেবে অর্থাৎ ১০ দিন আগে চলে আসে তারিখটি (২০শে মার্চ)।
এর পর জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদযোগ নেন জ্যোতিষীরা। তাঁদের পরামর্শে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি (১৫০২-৮৫) ১০ দিন বাতিল করেন দশম মাস থেকে । ফলে ১৫৮২ সালের ৫ই অকটোবর পরিণত হয় ১৫ই অকটোবর। এছাড়া দ্বিতীয় মাসে একটি অতিরিক্ত দিন সংযোজনের নির্দেশ দেন ৪০০ দ্বারা বিভাজ্য শত বর্ষে। এ হিসেবে ১৬০০ সালে যুক্ত হয়েছে একটি অতিরিক্ত দিন, ২০০০ সালেও যুক্ত হয়েছে আরও একটি দিন।
এই বর্ষপঞ্জি ‘গ্রেগরিয়ান’ নামে খ্যাত। সৌরবর্ষের সঙ্গে এর ব্যবধান মাত্র ২৬ সেকেন্ড। প্রতি ১০০ বছরে এই ব্যবধান বাড়বে .৫৩ সেকেন্ড হারে। কারণ সৌরবর্ষ ছোট হয়ে আসছে ক্রমশ।
ইউরোপের বিভিন্ন রোমান ক্যাথলিক অধ্যুষিত দেশ ‘গ্রেগরিয়ান’ বর্ষপঞ্জি গ্রহণ করে সঙ্গে-সঙ্গে। জারমানি’র কয়েকটি রাজ্য ‘জুলিয়ান’ বর্ষপঞ্জি বহাল রাখে ১৭০০ সাল পর্যন্ত। গ্রেট ব্রিটেন ও আমেরিকান উপনিবেশগুলিতে ‘গ্রেগরিয়ান’ চালু হয় ১৭৫২ সালে। এই বর্ষপঞ্জি রাশিয়ায় ১৯১৮ সালে, গ্রিসে ১৯২৩ সালে ও তুরস্কে ১৯২৭ সালে গ্রহণ করা হয়। জাপান, কোরিয়া ও চীন গ্রহণ করে যথাক্রমে ১৮৭৩, ১৮৯৫ ও ১৯১২ সালে। চীনে অবশ্য সার্বিক ভাবে চালু হয় ১৯২৯ সাল থেকে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, অঞ্চলে বা প্রতিষ্ঠানে এখনও রয়েছে নানা ধরনের বর্ষপঞ্জি। ‘গ্রেগরিয়ান’ ছাড়াও আছে চার্চ, হিবরু, হিজরি, চীনা প্রভৃতি বর্ষপঞ্জি। উপমহাদেশে আছে শকাব্দ, বঙ্গাব্দ ও অন্যান্য আঞ্চলিক পঞ্জি। আমাদের বঙ্গাব্দের সঙ্গে সাদৃশ্য মেলে চাকমাদের ‘বিজু’, ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’, অসম-এর ‘বিহু’, পূর্ব পাঞ্জাব-এর শিখদের ‘বৈশাখী’ প্রভৃতি পর্ব-পার্বণের। উপমহাদেশের বাইরে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, কমবোডিয়া প্রভৃতি দেশে রয়েছে প্রায় একই রকমের বর্ষপঞ্জি।
বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের নেপথ্যে রয়েছে বাংলায় ১৫৭৬ অব্দ থেকে মুগল শাসন। খাজনা আদায়ের সুবিধা হবে ? এই চিন্তা থেকে হিজরি সনের পরিবর্তে এ সন চালু করা হয় তখন ফসলের মওসুমের দিকে লক্ষ্য রেখে। সম্রাট আকবর (১৫৪২- ১৬০৫)-এর এ সংক্রান্ত নির্দেশ জারি করা হয়েছিল ১৫৮৫ অব্দের ১০ই মার্চ, তবে তা কার্যকর হয় সম্রাটের সিংহাসন আরোহনের স্মারক বর্ষ ১৫৫৬ অব্দ মোতবেক হিজরি ৯৬৩ চান্দ্র সনকে ৯৬৩ সৌর সনে রূপান্তরের মাধ্যমে। এ রূপান্তরে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন শাহি দরবারের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহ সিরাজি। এজন্য বঙ্গাব্দ ‘মুগলি’ বা ‘ফসলি’ সন হিসেবেও পরিচিত।
উপমহাদেশে পঞ্জিকা “পঞ্চাঙ্গ” নামেও পরিচিত। কারণ এতে থাকে পাঁচটি অঙ্গ ? বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ। এই পঞ্জিকা গণনাপদ্ধতি রচিত হয়েছিল আনুমানিক ১৫০০ পূর্বাব্দে। তখন বছরকে ভাগ করা হয়েছিল ১২ মাসে। সেই মাসগুলোর নাম ছিল ? তপঃ, তপস্যা, মধু, মাধব, শুক্র, শুচি, নভস্, নভস্য, ইষ, উর্জ, সহস্, সহস্য। বর্তমান ১২ মাসের নাম রাখা হয়েছে ওই সময়ে উদিত নক্ষত্রগুলোর নাম অনুসারে। যেমন, বিশাখা ? বৈশাখ; জ্যেষ্ঠা ? জ্যৈষ্ঠ; আষাঢ়া ? আষাঢ়; শ্রবণা ? শ্রাবণ; ভাদ্রপদা ? ভাদ্র; অশ্বিনী ? আশ্বিন; কৃত্তিকা ? কার্ত্তিক; পুষ্যা ? পৌষ (পউষ); মঘা ? মাঘ; ফল্গুনী ? ফাল্গুন; চিত্রা ? চৈত্র। অগ্রহায়ণ ছিল সেকালে পঞ্জির প্রথম মাস, এজন্য তার নামে রয়ে গেছে সেই পরিচয়।
বঙ্গাব্দের সঙ্গে গ্রেগরিয়ান অব্দের সাযুজ্য আনার একটা চিন্তা ছিল সবসময়েই। কারণ ১লা বৈশাখ কখনও হয় ১৩ই, কখনও ১৪ই, আবার কখনও ১৫ই এপ্রিল তারিখে। ২৫শে বৈশাখ, ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ২২শে শ্রাবণ ও অন্যান্য স্মরণীয় তারিখের অব্দগত হেরফের দূর করতে ১৯৬৩ সালে বিশিষ্ট ভাষাবিদ পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি গঠন করে বাংলা একাডেমী। কমিটি অন্যান্য সুপারিশের পাশাপাশি ১৪ই এপ্রিলকে নির্ধারণ করে ১লা বৈশাখ। পরে ‘বাংলা বর্ষপঞ্জী সংস্কার কমিটি’ নামে আরেকটি কমিটির সুপারিশে ১২ই সেপটেম্বর, ১৯৯৪ অনুষ্ঠিত সভায় ১৪ই এপ্রিলকে ১লা বৈশাখ ধার্য করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলা একাডেমী। এর পরের সভা হয় ১৯৯৫ সালের ১৩ই অগস্ট। ওই দুই সভার মাধ্যমে গঠিত টাস্কফোর্স এটি কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৯৫ সালের ১৪ই এপ্রিল থেকে। সেই থেকে ক্রমে-ক্রমে চালু হয়েছে বাংলা একাডেমী বর্ষপঞ্জি। তবে বাংলাদেশের বাইরে এ বর্ষপঞ্জি গ্রহণ করে নি কেউ। ফলে ১লা বৈশাখ, ২৫শে বৈশাখ, ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ২২শে শ্রাবণ ও অন্যান্য স্মরণীয় তারিখ পালিত হয় বাংলাদেশে এক দিন, বাংলাদেশের বাইরে অন্য দিন।
১লা বৈশাখ প্রথম ছুটি ঘোষণা করা হয় ১৯৫৪ সালে। এ ঘোষণা করেন যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক। ১০ বছর পর, ১৯৬৪ সালে, এ ঘোষণা কার্যকরের সিদ্ধান্ত জানায় তৎকালীন প্রাদেশিক সরকার। ১৯৬৭ সাল থেকে রমনা বটমূলে শুরু হয় নববর্ষ উৎসব।
বঙ্গাব্দের সঙ্গে কালক্রমে সম্পর্কিত হয়েছে আমাদের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ ও অঞ্চলের বর্ষপঞ্জি। ১লা বৈশাখে নববর্ষ উৎসব পালিত হবে ভারতের অসম, কেরল, ওড়িশা, তামিল নাড়ু, কর্ণাটক, রাজস্থান ও মিথিলা (প্রস্তাবিত) রাজ্যে এবং মিয়ানমার, কমবোডিয়া, লাওস, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে। আমাদের পার্বত্য রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা জাতি এ উৎসব পালন করে যথাক্রমে বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজু ? একত্রে বৈসাবি নামে। দেশ-অঞ্চল ভেদে এমন ভিন্ন-ভিন্ন নাম রয়েছে এই বৈশাখি উৎসবের। যেমন ? রঙ্গলি বিহু (অসম), বিষু (কেরল ও কর্ণাটক), মহাবিষুব সংক্রান্তি (ওড়িশা), পূতাণ্ডু (তামিল নাড়ু ও শ্রীলঙ্কা), জুদে শীতল (মিথিলা), থিঙ্গিয়ান (মিয়ানমার), চোল চ্নাম থ্মেই (কমবোডিয়া), সোংকান / পি মাই লাও (লাওস), বিক্রম সামওয়াত / বৈশাক এক (নেপাল), অলুত অবুরুদু (শ্রীলঙ্কা)।
যে নামই নিক নববর্ষ শুভ বার্তা নিয়ে আসুক ? এ কামনা সকলের। আমরাও স্বাগত জানাই ১৪১৯ বঙ্গাব্দকে। কিন্তু কেমন যাবে নতুন বছরটি?
এ লেখা লিখছি লোডশেডিংয়ে জেরবার হতে-হতে। আশঙ্কা করি, এ থেকে রেহাই মিলবে না আসছে বছরেও। পণ্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ায় রাশ টেনে ধরার লক্ষণ দেখছি না, কাজেই এ ঘোড়া বছর ধরেই ছুটতে থাকবে। রাজনীতিকদের বকাঝকা ও চড়-থাপ্পড় আরও জমবে। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে সমঝোতা হবে না। বিদেশী দাতা ও কূটনীতিকরা বুঝবেন, গতিক সুবিধার নয়। অনিয়ম ও অব্যবস্থার কারণে ধস নামবে বিভিন্ন খাতে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস প্রকট হয়ে উঠবে আরও। ঢাকার চার নদী মুমূর্ষু হবে আরও। ভূমিকম্পে থরথর করবে মানুষে। প্রশাসনিক / সরকারি নানা বিধিনিষেধে রুদ্ধ সমাজ হয়ে উঠবে বিস্ফোরণোন্মুখ। তবে ঢাকা সিটি নির্বাচন হয়ে যাবে হুড়হাঙ্গামার মধ্যে। আর একটির পর একটি ভারতীয় ছবির শুভমুক্তি ঘটতে থাকবে সগৌরবে। আরও একটা কথা। বড় দল দু’টো অত বড় দল নয়। জোট না করে নির্বাচনে যেতে পারেন না তাঁরা। ছোট-ছোট দল তাঁদের লাগেই। আসছে বছর এই ছোটরাই খেতে থাকবে বড়দের। তারপরও… হে ১৪১৯, স্বাগত তোমাকে!ঘটনাবহুল একটি বছর শেষে আসছে আরেকটি বছর। ক’দিন পরেই আমরা অভিনন্দন জানাবো নতুন বছরকে, উদযাপন করবো বছরের প্রথম দিন ? ১লা বৈশাখ ১৪১৯ বঙ্গাব্দ, ১৪ই এপ্রিল ২০১২ অব্দ (খ্রিষ্টাব্দ), ২১শে জুমাদা আল-আউয়াল ১৪৩৩ হিজরি সন ? বঙ্গাব্দ পালনকারী বাঙালির জন্য এ দিনটিতে শুরু হবে নতুন একটি বছর। কিন্তু খৃষ্টীয়, হিজরি বা অন্যান্য সন অনুসরণকারীদের জন্য নতুন বছরের প্রথম দিনটি নির্ধারিত হয়ে আছে ভিন্ন-ভিন্ন তারিখে। এর কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের বর্ষপঞ্জি।
সময়-গণনার এই বিশেষ পদ্ধতিটি সুপ্রাচীন, একই সঙ্গে সমস্যাসঙ্কুলও বটে। ওইসব সমস্যা এখনও আছে, পাশাপাশি আছে সমাধানেরও চিরন্তন প্রয়াস। বহমান সময়ের হিসাব সংরক্ষণের এই পদ্ধতির নাম “বর্ষপঞ্জি” (“পঞ্জিকা”) বা “ক্যালিনডার”।
প্রাচীনকালে মানুষ যখন বুঝতে পারে প্রকৃতি মূলত নিয়ম-শাসিত, আর প্রকৃতির নিয়মে ঋতুর যে পরিবর্তন ঘটে তা-ই নিয়ন্ত্রণ করে তাদের জীবন, চাহিদা ও খোরাক ? তখন তাদের জন্য দরকারি হয়ে ওঠে বর্ষপঞ্জি। কবে শীত নামবে, বর্ষা শুরু হবে ? তা জানতে হবে আগেভাগে, নইলে ওই বিপদকালের জন্য প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব কিভাবে! ঘড়ি আবিষ্কারের আগে মানুষ সময়ের হিসাব রেখেছে সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজির মাধ্যমে। সূর্যের উদয় ও অস্তের মাধ্যমে সে পেয়েছে সবচেয়ে সহজ ও স্বাভাবিক এক একক ? সৌর দিন । ঋতুগুলোর মাধ্যমে মোটামুটিভাবে পাওয়া গেছে আরও একটি সহজ একক ? সৌর বর্ষ।
সেকালের মানুষ অবশ্য জানতো না ঋতু পরিবর্তনের কারণ। সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী যে ঘোরে সে সত্য অজ্ঞাত ছিল তাদের কাছে। তবে চাঁদের আকার ও অবস্থানের পরিবর্তন তো চোখে পড়ে সহজেই। ফলে প্রাচীনতম বর্ষপঞ্জিতে এক পূর্ণিমা থেকে আরেক পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়ের হিসাব থেকে চান্দ্র মাস নির্ণয়ের ব্যাপারটি ঘটে। সৌর দিনের সঙ্গে সৌর বর্ষের হিসাব মেলাতে যুক্ত হয় এই মাসের হিসাব।
চান্দ্র মাসের হিসাব আমাদের সকলেরই জানা ? গড়ে ২৯.৫৩০৫৮৯ দিনে হয় এক চান্দ্র মাস। এ রকম ১২টি মাস মিলে হয় প্রায় ৩৪৫ দিন। ফলে সৌর বর্ষ থেকে তা হয়ে পড়ে ১১ দিন কম। এক সৌরবর্ষ হতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড। এই অসংগতি চলছে হাজার-হাজার বছর ধরে। চান্দ্র ও সৌর বর্ষপঞ্জিতে সাযুজ্য বিধান করা সম্ভব হয়নি এখনও।
প্রাচীনকালের বর্ষপঞ্জিতে চালু হয়েছিল সৌর ও চান্দ্র বর্ষে সমতা বজায় রাখার জন্য কোনও বছর ১২ মাসে, কোনও বছর ১৩ মাসে গণনা করার নিয়ম। তাই গ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর দক্ষিণ উপত্যকায় অবস্থিত বেবিলন-এর জ্যোতিষীরা যে বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করতেন তাতে অনেক আদিম বৈশিষ্ট্য ছিল। অনিয়মিতভাবে কোনও-কোনও বছরের শেষে তাঁরা জুড়ে দিতেন একটি অতিরিক্ত মাস। রাজজ্যোতিষীরা যখন বুঝতেন বর্ষপঞ্জির হিসাব অনুযায়ী আর কাজ চলছে না তখন একমত হয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা ঘোষণা করতেন তাঁরা। এ রকম ঘোষণা তিনবারও করতে হতো তাঁদের। কিন্তু এতে হিসাবের ভুল ও অন্যান্য বিভ্রান্তি এড়ানো যেতো না কোনও ভাবে। সম্ভবত মিশর-এর জ্যোতিষীরাই প্রথম ব্যবহার করেন একটি পূর্ণাঙ্গ সৌর বর্ষপঞ্জি। তাঁরা খেয়াল করেছিলেন কয়েক মাস অদৃশ্য থাকার পর সূর্যোদয়ের ঠিক আগে আকাশে দেখা দেয় লুব্ধক নক্ষত্র । তারা আরও খেয়াল করেছিলেন, লুব্ধক-এর পুনরুদয়ের পর-পরই নীলনদে আসে বাৎসরিক বন্যা। এই ঘটনাকে নির্দেশিকা হিসেবে রেখে ৩৬৫ দিনের এক সৌর বর্ষ নির্ণয় করেন তাঁরা। ওই বর্ষ হতো ১২ মাসে, আর প্রতিটি মাস হতো ৩০ দিনে। বছর শেষে যুক্ত হতো অতিরিক্ত পাঁচ দিন । দিনের অতিরিক্ত চতুর্থাংশ হিসাবে না রাখায় তাদের বর্ষপঞ্জিতে গরমিল ঘটতো নিয়মিত। মিশরের এই বর্ষপঞ্জি নিয়ে গবেষণা হয়েছে অনেক। গবেষকরা ধারণা করেন, অন্তত ৪২৩৬ পূর্বাব্দে প্রচলিত ছিল মিশরীয় বর্ষপঞ্জিটি।
রোম-এর জ্যোতিষীরা বর্ষপঞ্জির ধারণা পেয়েছিলেন গ্রিক জ্যোতিষীদের গণনা থেকে। তাঁদের পঞ্জিতে ছিল ১০ মাস, আর ৩০৪ দিনে এক বছর। বাকি ৬০ দিন তাঁরা হিসাবে রাখতেন না, ওই দিনগুলো ছিল শীতকালের মধ্যভাগে। রোম নগরীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উপকথায় বর্ণিত রোমালাস (আ. ৭৭১-৭১৮ পূর্বাব্দ) ৭৩৮ পূর্বাব্দে ওই বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন বলে কথিত আছে।
রোমালাস-এর উত্তরাধিকারী নুমা পমপিলিয়াস (৭১৫-৬৭৩ পূর্বাব্দ) ওই পঞ্জির শুরুতে একটি এবং শেষে আরও একটি মাস গণনার নির্দেশ দেন। এছাড়া সৌর বর্ষের সঙ্গে হিসাব মিলাতে তিনি ২২ ও ২৩ দিনের আরও একটি মাস নির্ধারণ করেন। ওই মাসটি এক বছর পর-পর যুক্ত হতো বছরের শেষ মাসটির ২২,২৩ তারিখের মধ্যে। ওই বর্ষপঞ্জির হিসাব বদলানো হয় ৪৫২ পূর্বাব্দে।
জুলিয়াস সিজার (১০০-৪৪ পূর্বাব্দ) রোম সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়ে লক্ষ্য করেন বিদ্যমান বর্ষপঞ্জির হিসাব তিন মাস আগে চলছে প্রত্যেক ঋতুর। তিনি তখন জ্যোতিষী সোসিনিজিনিস-কে নির্দেশ দেন পঞ্জিকা সংস্কারের। ওই সংস্কারের ফলে ৩১ ও ৩০ দিনের পর্যায়ক্রমিক ১২টি মাস নিয়ে গণনা করা হয় একটি বছর, তবে দ্বিতীয় মাসের জন্য নির্ধারিত হয় ২৯ দিন। চার বছর পর-পর ওই মাসটি গণনা করা হতো ৩০ দিন হিসাবে। একই সঙ্গে ৪৬ পূর্বাব্দে, অন্য এক নির্দেশে ৪৪৫ দিনে গণনার ঘোষণা দেয়া হয়। পরে সম্রাট অগসতাস (৬৩ পূর্বাব্দ – ১৪ অব্দ) দ্বিতীয় মাসের একটি দিন সরিয়ে নিয়ে যান অষ্টম মাসে ? যাতে সপ্তম মাসের সমান সংখ্যক দিন থাকে ওই মাসেও।
‘জুলিয়ান’ নামে খ্যাত এই বর্ষপঞ্জি ১৫০০’র বেশি বছর ধরে চালু ছিল। এই পঞ্জি অনুযায়ী প্রতিটি বছর ছিল ৩৬৫.২৫ দিন। অর্থাৎ প্রতিটি সৌরবর্ষ থেকে ১১ মিনিট ১৪ সেকেন্ড দীর্ঘ। ফলে ঋতুভিত্তিক তারিখে গরমিল দেখা দিতে থাকে। ১৫৮০ সালে মহাবিষুবের তারিখ দেখা দেয় ১১ই মার্চ হিসেবে অর্থাৎ ১০ দিন আগে চলে আসে তারিখটি (২০শে মার্চ)।
এর পর জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদযোগ নেন জ্যোতিষীরা। তাঁদের পরামর্শে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি (১৫০২-৮৫) ১০ দিন বাতিল করেন দশম মাস থেকে । ফলে ১৫৮২ সালের ৫ই অকটোবর পরিণত হয় ১৫ই অকটোবর। এছাড়া দ্বিতীয় মাসে একটি অতিরিক্ত দিন সংযোজনের নির্দেশ দেন ৪০০ দ্বারা বিভাজ্য শত বর্ষে। এ হিসেবে ১৬০০ সালে যুক্ত হয়েছে একটি অতিরিক্ত দিন, ২০০০ সালেও যুক্ত হয়েছে আরও একটি দিন।
এই বর্ষপঞ্জি ‘গ্রেগরিয়ান’ নামে খ্যাত। সৌরবর্ষের সঙ্গে এর ব্যবধান মাত্র ২৬ সেকেন্ড। প্রতি ১০০ বছরে এই ব্যবধান বাড়বে .৫৩ সেকেন্ড হারে। কারণ সৌরবর্ষ ছোট হয়ে আসছে ক্রমশ।
ইউরোপের বিভিন্ন রোমান ক্যাথলিক অধ্যুষিত দেশ ‘গ্রেগরিয়ান’ বর্ষপঞ্জি গ্রহণ করে সঙ্গে-সঙ্গে। জারমানি’র কয়েকটি রাজ্য ‘জুলিয়ান’ বর্ষপঞ্জি বহাল রাখে ১৭০০ সাল পর্যন্ত। গ্রেট ব্রিটেন ও আমেরিকান উপনিবেশগুলিতে ‘গ্রেগরিয়ান’ চালু হয় ১৭৫২ সালে। এই বর্ষপঞ্জি রাশিয়ায় ১৯১৮ সালে, গ্রিসে ১৯২৩ সালে ও তুরস্কে ১৯২৭ সালে গ্রহণ করা হয়। জাপান, কোরিয়া ও চীন গ্রহণ করে যথাক্রমে ১৮৭৩, ১৮৯৫ ও ১৯১২ সালে। চীনে অবশ্য সার্বিক ভাবে চালু হয় ১৯২৯ সাল থেকে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, অঞ্চলে বা প্রতিষ্ঠানে এখনও রয়েছে নানা ধরনের বর্ষপঞ্জি। ‘গ্রেগরিয়ান’ ছাড়াও আছে চার্চ, হিবরু, হিজরি, চীনা প্রভৃতি বর্ষপঞ্জি। উপমহাদেশে আছে শকাব্দ, বঙ্গাব্দ ও অন্যান্য আঞ্চলিক পঞ্জি। আমাদের বঙ্গাব্দের সঙ্গে সাদৃশ্য মেলে চাকমাদের ‘বিজু’, ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’, অসম-এর ‘বিহু’, পূর্ব পাঞ্জাব-এর শিখদের ‘বৈশাখী’ প্রভৃতি পর্ব-পার্বণের। উপমহাদেশের বাইরে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, কমবোডিয়া প্রভৃতি দেশে রয়েছে প্রায় একই রকমের বর্ষপঞ্জি।
বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের নেপথ্যে রয়েছে বাংলায় ১৫৭৬ অব্দ থেকে মুগল শাসন। খাজনা আদায়ের সুবিধা হবে ? এই চিন্তা থেকে হিজরি সনের পরিবর্তে এ সন চালু করা হয় তখন ফসলের মওসুমের দিকে লক্ষ্য রেখে। সম্রাট আকবর (১৫৪২- ১৬০৫)-এর এ সংক্রান্ত নির্দেশ জারি করা হয়েছিল ১৫৮৫ অব্দের ১০ই মার্চ, তবে তা কার্যকর হয় সম্রাটের সিংহাসন আরোহনের স্মারক বর্ষ ১৫৫৬ অব্দ মোতবেক হিজরি ৯৬৩ চান্দ্র সনকে ৯৬৩ সৌর সনে রূপান্তরের মাধ্যমে। এ রূপান্তরে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন শাহি দরবারের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহ সিরাজি। এজন্য বঙ্গাব্দ ‘মুগলি’ বা ‘ফসলি’ সন হিসেবেও পরিচিত।
উপমহাদেশে পঞ্জিকা “পঞ্চাঙ্গ” নামেও পরিচিত। কারণ এতে থাকে পাঁচটি অঙ্গ ? বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ। এই পঞ্জিকা গণনাপদ্ধতি রচিত হয়েছিল আনুমানিক ১৫০০ পূর্বাব্দে। তখন বছরকে ভাগ করা হয়েছিল ১২ মাসে। সেই মাসগুলোর নাম ছিল ? তপঃ, তপস্যা, মধু, মাধব, শুক্র, শুচি, নভস্, নভস্য, ইষ, উর্জ, সহস্, সহস্য। বর্তমান ১২ মাসের নাম রাখা হয়েছে ওই সময়ে উদিত নক্ষত্রগুলোর নাম অনুসারে। যেমন, বিশাখা ? বৈশাখ; জ্যেষ্ঠা ? জ্যৈষ্ঠ; আষাঢ়া ? আষাঢ়; শ্রবণা ? শ্রাবণ; ভাদ্রপদা ? ভাদ্র; অশ্বিনী ? আশ্বিন; কৃত্তিকা ? কার্ত্তিক; পুষ্যা ? পৌষ (পউষ); মঘা ? মাঘ; ফল্গুনী ? ফাল্গুন; চিত্রা ? চৈত্র। অগ্রহায়ণ ছিল সেকালে পঞ্জির প্রথম মাস, এজন্য তার নামে রয়ে গেছে সেই পরিচয়।
বঙ্গাব্দের সঙ্গে গ্রেগরিয়ান অব্দের সাযুজ্য আনার একটা চিন্তা ছিল সবসময়েই। কারণ ১লা বৈশাখ কখনও হয় ১৩ই, কখনও ১৪ই, আবার কখনও ১৫ই এপ্রিল তারিখে। ২৫শে বৈশাখ, ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ২২শে শ্রাবণ ও অন্যান্য স্মরণীয় তারিখের অব্দগত হেরফের দূর করতে ১৯৬৩ সালে বিশিষ্ট ভাষাবিদ পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি গঠন করে বাংলা একাডেমী। কমিটি অন্যান্য সুপারিশের পাশাপাশি ১৪ই এপ্রিলকে নির্ধারণ করে ১লা বৈশাখ। পরে ‘বাংলা বর্ষপঞ্জী সংস্কার কমিটি’ নামে আরেকটি কমিটির সুপারিশে ১২ই সেপটেম্বর, ১৯৯৪ অনুষ্ঠিত সভায় ১৪ই এপ্রিলকে ১লা বৈশাখ ধার্য করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলা একাডেমী। এর পরের সভা হয় ১৯৯৫ সালের ১৩ই অগস্ট। ওই দুই সভার মাধ্যমে গঠিত টাস্কফোর্স এটি কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৯৫ সালের ১৪ই এপ্রিল থেকে। সেই থেকে ক্রমে-ক্রমে চালু হয়েছে বাংলা একাডেমী বর্ষপঞ্জি। তবে বাংলাদেশের বাইরে এ বর্ষপঞ্জি গ্রহণ করে নি কেউ। ফলে ১লা বৈশাখ, ২৫শে বৈশাখ, ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ২২শে শ্রাবণ ও অন্যান্য স্মরণীয় তারিখ পালিত হয় বাংলাদেশে এক দিন, বাংলাদেশের বাইরে অন্য দিন।
১লা বৈশাখ প্রথম ছুটি ঘোষণা করা হয় ১৯৫৪ সালে। এ ঘোষণা করেন যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক। ১০ বছর পর, ১৯৬৪ সালে, এ ঘোষণা কার্যকরের সিদ্ধান্ত জানায় তৎকালীন প্রাদেশিক সরকার। ১৯৬৭ সাল থেকে রমনা বটমূলে শুরু হয় নববর্ষ উৎসব।
বঙ্গাব্দের সঙ্গে কালক্রমে সম্পর্কিত হয়েছে আমাদের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ ও অঞ্চলের বর্ষপঞ্জি। ১লা বৈশাখে নববর্ষ উৎসব পালিত হবে ভারতের অসম, কেরল, ওড়িশা, তামিল নাড়ু, কর্ণাটক, রাজস্থান ও মিথিলা (প্রস্তাবিত) রাজ্যে এবং মিয়ানমার, কমবোডিয়া, লাওস, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে। আমাদের পার্বত্য রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা জাতি এ উৎসব পালন করে যথাক্রমে বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজু ? একত্রে বৈসাবি নামে। দেশ-অঞ্চল ভেদে এমন ভিন্ন-ভিন্ন নাম রয়েছে এই বৈশাখি উৎসবের। যেমন ? রঙ্গলি বিহু (অসম), বিষু (কেরল ও কর্ণাটক), মহাবিষুব সংক্রান্তি (ওড়িশা), পূতাণ্ডু (তামিল নাড়ু ও শ্রীলঙ্কা), জুদে শীতল (মিথিলা), থিঙ্গিয়ান (মিয়ানমার), চোল চ্নাম থ্মেই (কমবোডিয়া), সোংকান / পি মাই লাও (লাওস), বিক্রম সামওয়াত / বৈশাক এক (নেপাল), অলুত অবুরুদু (শ্রীলঙ্কা)।
যে নামই নিক নববর্ষ শুভ বার্তা নিয়ে আসুক ? এ কামনা সকলের। আমরাও স্বাগত জানাই ১৪১৯ বঙ্গাব্দকে। কিন্তু কেমন যাবে নতুন বছরটি?
এ লেখা লিখছি লোডশেডিংয়ে জেরবার হতে-হতে। আশঙ্কা করি, এ থেকে রেহাই মিলবে না আসছে বছরেও। পণ্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ায় রাশ টেনে ধরার লক্ষণ দেখছি না, কাজেই এ ঘোড়া বছর ধরেই ছুটতে থাকবে। রাজনীতিকদের বকাঝকা ও চড়-থাপ্পড় আরও জমবে। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে সমঝোতা হবে না। বিদেশী দাতা ও কূটনীতিকরা বুঝবেন, গতিক সুবিধার নয়। অনিয়ম ও অব্যবস্থার কারণে ধস নামবে বিভিন্ন খাতে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস প্রকট হয়ে উঠবে আরও। ঢাকার চার নদী মুমূর্ষু হবে আরও। ভূমিকম্পে থরথর করবে মানুষে। প্রশাসনিক / সরকারি নানা বিধিনিষেধে রুদ্ধ সমাজ হয়ে উঠবে বিস্ফোরণোন্মুখ। তবে ঢাকা সিটি নির্বাচন হয়ে যাবে হুড়হাঙ্গামার মধ্যে। আর একটির পর একটি ভারতীয় ছবির শুভমুক্তি ঘটতে থাকবে সগৌরবে। আরও একটা কথা। বড় দল দু’টো অত বড় দল নয়। জোট না করে নির্বাচনে যেতে পারেন না তাঁরা। ছোট-ছোট দল তাঁদের লাগেই। আসছে বছর এই ছোটরাই খেতে থাকবে বড়দের। তারপরও… হে ১৪১৯, স্বাগত তোমাকে!