বৈশাখের রঙিলা নাও পাল তুলেছে মন

বৈশাখের রঙিলা নাও পাল তুলেছে মন

মোমিন মেহেদীঃ

‘বোশেখে কীভাবে কাঁচা আম কেটে খাই?/ পেটানো লোহার ছোট্ট ছুরিটা চাই।/ চলো না এখন নাগরদোলায় চড়ি/ উত্তেজনায় এই উড়ি এই পড়ি।/ ওই যে ওখানে লাঠি খেলা জোড়ে জোড়ে,/ লাঠিতে লাঠিতে টক্কর লাগে জোরে।/ ওদিকে চলো তো চলো চলো তাড়াতাড়ি/  মোরগে মোরগে চলছে লড়াই ভারি!/ রঙিন ঘুড়ির খেলাটা দেখ না চেয়ে/ ঘুড়িতে ঘুড়িতে আকাশ গিয়েছে ছেয়ে।’ ছড়াকার ফয়েজ আহমদের বৈশাখকে নিয়ে এই ছড়া অথবা কবি শামসুল ইসলামের লেখা  ‘বৈশাখ বিদগ্ধ সময়ের সব দুঃখ মুছে দিতে বাতাসের রঙিন পাল উড়িয়ে আসবে/ ঠোঁটের পরে সাজানো ঠোঁটের মত তৈরি করবে বিপুল আদর/ পামত্মা-ইলিশের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলবে বাঙালির রাত-দিন… এই কবিতার এমন পঙতি যেমন লিখেছেন কবি তেমন লিখেছেন গীতিকার গানও। তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যায়’  বৈশাখের আবাহনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গানে রয়েছে এই পঙক্তি।  বাঙালির রঙিলা নাওয়ের বৈশাখ বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অজস্র লেখায় গান ও কবিতায় উঠে এসেছে, রয়েছে বৈশাখ-বন্দনা। নতুন প্রাণের উজ্জীবন, তারুণ্যের জয়গান ধ্বনিত হয়েছে নজরুলের লেখা বৈশাখসংক্রান্ত রচনাগুলোয়। স্বভাবসুলভ শক্তিমত্তা এবং সহজাত ঔদার্যে কেবল নজরুলই উচচারণ করতে পারেন এমন মহার্ঘ পঙক্তি- ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর।/ ঐ নূতনের কেতন ওড়ে/ কাল-বোশেখীর ঝড়।’ বৈশাখের গান যেমন রয়েছে তেমন রয়েছে ছড়া ও কবিতা।  ছয় ঋতুর প্রথম ঋতু গ্রীষ্ম আর প্রথম মাস বৈশাখ। বৈশাখে প্রকৃতি নতুন বিন্যাসে সজ্জিত হয়। সজল প্রকৃতির উল­vস ও অসীম নীলিমায় নানা বণের্র মেঘের বিস্তার আমাদের চৈতন্যে সঞ্চারিত করে সঞ্জীবনী মন্ত্র আমাদের চোখে প্রশান্তির কাজল পরিয়ে দেয় সর্ববিস্তৃত প্রকৃতির। এ ভূখন্ডের প্রতিটি মানব মনে এর প্রভাব পড়ে। যেহেতু শিল্পীরা তুলনামূলকভাবে অধিক সংবেদনশীল, তাই তাঁদের শিল্পীচৈতন্যে এর রেখাপাত প্রগাঢ় হয়ে পড়ে। কবিদের আমরা জানি যে কোনো চিত্তবিক্ষোভ বা আনন্দ আলোড়নকে একটি শিল্পিত ভাষ্যে রূপায়িত করার নৈপুণ্যভাস্বর স্রষ্টা হিসেবে। ফলে প্রকৃতি ও মানবপ্রকৃতিকে বিজড়িত করে বিকশিত যে সংস্কৃতি তার একটি বিশিষ্ট অভিব্যক্তি বৈশাখকেন্দ্রিক কবিতায় পাওয়া সম্ভব। আমাদের সংকলিত বৈশাখের কবিতা’য় ধরা পড়বে অনুভূতির বৈচিত্র্য, অভিজ্ঞতার প্রাখর্য ও প্রজ্ঞার প্রসার। ফলে আমাদের সংস্কৃতির একটি অনুষঙ্গকে মর্মমূলসমেত চিনে নিতে বা বুঝে নিতে চাইলে বাংলাদেশের কবিদের বৈশাখকেন্দ্রিক কবিতার অন্তর্জগতে প্রবেশ করলে ঋদ্ধ হওয়ারই সম্ভাবনা। কবি কায়কোবাদ থেকে শুরু করে হালের নবীন কবি শামত্মা ফারজানা পর্যমত্ম প্রায় সবাই-ই বৈশাখের রঙে রঙিন হয়েছেন। কবি কায়কোবাদ বৈশাখকে নিয়ে যেমন লিখেছেন; তেমন লিখেছেন পলস্নীকবি জসীম উদ্দীন,  বে-নজীর আহমদ, বন্দে আলী মিয়া, সুফিয়া কামাল, অনিল মুখার্জি, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, সিকান্দার আবু জাফর, আবদুল গণি হাজারী, সৈয়দ আলী আহসান, সানাউল হক, আতাউর রহমান, আবদুর রশীদ খান, আশরাফ সিদ্দিকী, জিল­yর রহমান সিদ্দিকী, মযহারুল ইসলাম, আহমদ রফিক, শামসুর রাহমান, আনোয়ারা বেগম, ফয়েজ আহমদ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, জাহানারা আরজু, সাইয়িদ আতীকুল­vহ, কায়সুল হক, মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল­vহ্, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, ইমরান নূর, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবুবকর সিদ্দিক, জিয়া হায়দার, দিলওয়ার, রফিকুল হক, নয়ীম গহর, সুকুমার বড়ুয়া, বেলাল চৌধুরী, হায়াত্ মামুদ, খালেদা এদিব চৌধুরী, ওমর আলী, ইমরুল চৌধুরী, মনজুরে মওলা, মাহবুব তালুকদার, নিয়ামত হোসেন, ফজল-এ-খোদা, আন্ওয়ার আহমদ, অরুণাভ সরকার, মোফাজ্জল করিম, শামসুল ইসলাম, কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী, হায়াত্ সাইফ, আল মুজাহিদী, মুস্তফা আনোয়ার, রফিক আজাদ, রবিউল হুসাইন, আসাদ চৌধুরী, আহমদ ছফা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, ফারুক আলমগীর, মোহাম্মদ রফিক, আনোয়ার করিম, মহাদেব সাহা, মাহমুদউল­vহ, নির্মলেন্দু গুণ, মাহমুদ আল জামান, আখতার হুসেন, সমুদ্র গুপ্ত, শাহাদাত বুলবুল, জুলফিকার মতিন, রুবী রহমান, সানাউল হক খান, ওবায়দুল ইসলাম, ফরহাদ মজহার প্রমুখ।  গ্রামীণ বাংলার জনজীবন ও লোকসংস্কৃতির অসামান্য রূপকার কবি জসীম উদ্দীন। সঙ্গত কারণেই তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে চিরায়ত বাংলার রূপ ঐশ্বর্য। সরল সাবলীল বর্ণনা, অকৃত্রিম দরদ ও সহজ ভঙ্গিতে অসামান্য নৈপুণ্যে তিনি পাঠকদের উপহার দেন গ্রাম জীবনের ছবি। তাঁর কবিতার নাম ‘বোশেখ শেষের মাঠে’  কবিতায় কবি জসীম উদ্দীন লিখছেন, ‘বোশেখ শেষে বালুচরের বোরো ধানের থান,/  সোনায় সোনা মেলিয়ে দিয়ে নিয়েছে কেড়ে প্রাণ।/ বসন্ত সে বিদায় বেলায় বুকের আঁচলখানি,/  গেঁয়ো নদীর দুপাশ দিয়ে রেখায় গেছে টানি।/  চৈত্র দিনের বিধবা চরের সাদা থানের পরে/ নতুন বরষ ছড়িয়ে দিল সবুজ থরে থরে/ না জানি কোন গেঁয়ো তাঁতি গাঙ চলিবার ছলে/ জল-ছোঁয়া তার শাড়ির কোণে পাড় বুনে যায় চলে।’  ছড়ার জাদুকর সুকুমার রায়ও কম যাননি; লিখেছেন, ‘আম পাকে বৈশাখে, কুল পাকে ফাগুনে,/ কাঁচা ইট পাকা হয় পোড়ালে তা আগুনে।/  রোদে জলে টিকে রঙ পাকা কই তাহারে।/ ফলারটি পাকা হয় লুচি দই আহারে।’  ‘জীবনের প্রতিটি দিন যেন হয় আরও সুন্দর পরিপাটি সে প্রত্যাশায় মানুষ এগিয়ে চলে কল্যাণের দিকে। আর কল্যাণের সানাই বাজাতে বাজাতেই আগমন ঘটে বৈশাখের। বৈশাখী ঝড়, বৈশাখী সুখ আর বৈশাখী স্মৃতি নিয়ে জমে ওঠে বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গন-ক্যাম্পাস। মুখরিত হয়ে ওঠে যুগযুগান্তের ধারায় বয়ে চলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। মেতে ওঠে চারুকলার বকুলতলা, টিএসসি, কলাভবন, স্বোপার্জিত স্বাধীনতাসহ পুরো শিক্ষাঙ্গন। আনন্দ জোয়ারে ছলাৎ ছলাৎ চলে বৈশাখী নাও। পাল তুলে দেয় হলুদিয়া হাত। পহেলা বৈশাখের বৈঠা ধরে এগিয়ে চলে ছন্দিত আনন্দ। নানা রঙের মুখ ও মুখোশ সেজে ওঠে প্রাণের আকুলতায়। জীবনের জলছবি জলকবি আঁকতে ভালোবাসেন। ভালোবাসেন বলেই আলো হাসেন বছরের প্রথমদিন। বাংলা নববর্ষ। জীবন্ত আনন্দ। আনন্দের ধিন তানা না…। পহেলা বৈশাখের পহেলা প্রহরজুড়ে থাকে নানা রঙের মুখ ও মুখোশ। ঢাবির ঐহিত্যবাহী চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দিতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়। পুরো শোভাযাত্রায় শোভা পায় বাংলা ও বাঙালির প্রিয় যত রঙ; প্রিয় যত ঢঙ। আকুল করা ব্যাকুল প্রাণে হাজার হাজার মানুষের মুখে মুখে রঙের প্রলেপ। একতারা আর তালপাখার ছবি। ‘সহজ কথা সত্যি করে বলতে গেলেই হাসা/জীবন জুড়ে বাংলা এবং অ-নে-ক ভালোবাসা।’ ভালোবাসার মেলবন্ধনে আবদ্ধ পৃথিবী। আবদ্ধ স্বপ্ন-বাস্তবতা। আগামীর স্বপ্নে বিভোর সবাই, সতত সময়জুড়ে নিয়ে আসে বৈশাখী বন্ধুত্ব। গ্রামবাংলার হাজার বছরের ঐহিত্য পান্তা-ইলিশ। ভালোলাগার দোলনায় দুলতে দুলতে ধাবিত হয় সবাই সেই দিকে। দৃষ্টি চলে চলনবিলে স্বপ্নজুড়ে। স্বাপ্নিক পথিকরা সবাই প্রেমে পড়ে পান্তা-ইলিশের। স্মরণীয় করে রাখতে বরণ করে পহেলা বৈশাখকে বিভিন্নভাবে। অনেক ধারার একটি ধারা তাই পান্তা-ইলিশ। অনবদ্য ভালোলাগার মায়ায় বন্দি হয়ে ভুলে যায় কাজের যত কঠিন কথা। গেয়ে ওঠে আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি/মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি।  অনন্য অসাধারণ একটি দিন। স্মরণের স্মারণিক শুদ্ধতায় আসন পাতে মনের আঙিনায়। আলোকলাগা সকালবেলা মমত্ববোধ জাগায়; মুগ্ধতা সুখ আর উন্মুক্ত সূর্যালোকে রাগায়। রাগতে থাকে সূর্য আবার রাখতে থাকে মেঘ; পান্তা-ইলিশ চলছে জোড়ে প্রচন্ড তার বেগ। লাল পেড়ে সাদা শাড়ির মেলা বসার দিন এই বৈশাখ। চারপাশে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, সাদা সাদা হাসি। ভালোবাসা ভালোলাগা নন্দিত মন; সারাক্ষণ গেয়ে যায় ধিন তানা গান। গানে গানে তালে তালে পা চলে; চলন্ত সুখ। ফুল, পাখি, প্রজাপতি আনন্দ মুখ। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি গাঁদাফুল মালা। সাথে থাকে প্রেম চোখ, প্রেমলোক আর থাকে পুষ্পিত ডালা। একতারা আঁকা থাকে। ঠোঁটে প্রেম ঢাকা থাকে। চোখ জুড়ে মায়া আর আদরের ঢেউ। সোহাগের সময়জুড়ে আমাদের বৈশাখী বৈদেহী ফুল। নাকে-কানে ফুল দিয়ে গড়া সুখদুল। হাসি আর আনন্দ সম্ভার নিয়ে এসে দিয়ে যায় আগামীর কথা। সেই কথা বৃষ্টি; সেই কথা দৃষ্টি; ঝড়ো হাওয়া হইচই ছন্দ। চারপাশে ফুল মানুষের গন্ধ। কবি হেলাল হাফিজের যে জলে আগুন জ্বলে’র মতো করে যদি কেউ বলে, এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। অন্য সময় মিছিলে বা যুদ্ধে গেলে তাতে কারও যায়-আসে না। কিন্তু এই দিনে না। এ দিনটি কেবল ভালোবাসার, ভালোলাগার, স্বপ্ন বোনার, স্বপ্ন বোনার অনমত্ম। পড়ালেখার অবিশ্রান্ত অবসরে বৈশাখ। শৈশবের আমকুড়ানো, কৈশোরের বৃষ্টি ভেজা, যৌবনের প্রেমজআভা। সব মিলিয়ে এখন যৌবন যার ভালোবাসা আর ভালোলাগার শ্রেষ্ঠ সময়। পহেলা বৈশাখ বছরের প্রথম দিন। আসে বছরে একবার। নেচে ওঠে বাংলাদেশ। নাচায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা। বকুলতলায় চলে গানের ম্যারাথন পর্ব। কবিগুরুর ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো…’ থেকে শুরু করে হাল আমলের গান। বৈশাখী এই হাওয়াতে/তোমার চাওয়া পাওয়াতে/পাগল পারা হলো আমার মন/বন্ধু তোমায়, বন্ধু তোমায় আমার আজ খুব প্রয়োজন… বন্ধুকে বন্ধুর প্রয়োজন। কারণ আজ পহেলা বৈশাখ। ছুটি না হলেও ছুটি। অবসরের অলস সময় নয়। সাহসের ষোলোআনা ক্ষণজুড়ে উল­vস। উল­সিত, উদ্ভাসিত পৃথিবী। উচ্ছ্বসিত আগামী। ছাত্রত্বমুক্ত বৈশাখে সাগরের ঢেউ। বয়ে চলে টিএসসি, বাংলা একাডেমী, চারুকলার বকুলতলা, পলাশী, নীলক্ষেত, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শহীদ মিনার আর ফুলার রোডের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রামত্ম। এতসব কথা-কবিতা-ছড়া আর গানের দ্বারা এই বিষয়টি-ই প্রমাণিত হয়  যে প্রতি বছরে ১লা বৈশাখের এই দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকে প্রতিটি বাঙালি।  যেইদিন প্রকৃত অর্থেই নিজেদেরকে বাঙালি বাঙালি মনে হয়।  চৈত্রসংক্রামিত্ম, চৈত্র মাসের শেষদিনটির গোধূলী লগ্নে ধূলো উড়িয়ে ঘরে ফেরা রাখাল। ইতিহাস বলে, যার হাত দিয়ে বৈশাখ কিংবা বাংলা নববর্ষের গোড়াপত্তন হয়েছে তিনি জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর। তাঁর শাসনভার গ্রহনের আগে মুঘল আমলের পুরোটা সময় ধরেই কৃষিখাজনা আদায় হতো হিজরী সনের হিসাবে। হিজরী সন নির্ধারিত হয় চাঁদের হিসাব অনুযায়ী, কিন্তু উপমহাদেশের সারা বছরের কৃষিকাজ চাঁদের সাথে অতোটা সম্পর্কায়িত নয়, যে কারণে কৃষকেরা তখন খাজনা প্রদানে নানা প্রতিকূলতার সন্মুখীন হতো। যথাসময়ে যথাযোগ্য খাজনা আদায়ের অভিপ্রায়ে তখন সম্রাট আকবর তাঁর সভার বিশিষ্ট গুণীজন ফাতেউলস্নাহ্ সিরাজীকে দিয়ে হিজরী চন্দ্রাব্দ এবং বাংলা পঞ্জিকার সমণ্বয়ে “বাংলা বছর”-এর প্রচলন করেন, যা “ফসলী সন” নামে ১৫৮৪ এর মার্চ মাসে প্রবর্তিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের দিনটি থেকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বছরের সূত্রপাত হয়। সম্রাট আকবরের আমল থেকেই বাংলা নতুন বছরাগমনের অর্থাৎ বৈশাখের প্রথম দিনটির উৎসবমূখর উদযাপন হয়ে আসছে। বছরের শেষদিন, চৈত্রসংক্রান্তির সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুব দেবার আগেই পুরাতন অর্থবছরের সকল হিসাব চুকিয়ে ফেলার নিয়ম। বছরের প্রথম দিন মহাজন, ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রেতা বন্ধুদের নিমন্ত্রন করে মিস্টিমুখ করানোর মাধ্যমে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবসায়ীক লেনদেনের পুনঃসূচনা করতেন “হালখাতা” বা হিসাবের নতুন খাতা খোলে। হালখাতার লুপ্তপ্রায় এই ধারাটা সোনা-ব্যবসায়ীরা আজও ধরে রেখেছে। সম্রাট আকবরের আমলে সর্বভারতে খাজনা আদায়ের নতুন বছরের সূচনা হলেও, পুরনো দিনের সকল হিসাব পেছনে ফেলে আনন্দের নতুন বছরে পদার্পন বাঙালীদের মাঝে ঐতিহ্য হিসেবে টিকে গেছে ‘পহেলা বৈশাখ’ হিসেবে। সবচেয়ে বর্ণাঢ্য বৈশাখ উদযাপন হয় ঢাকা শহরকে ঘিরে। বছরের প্রথম সূযের্র আলোকে বরণ করে নিতে দলে দলে লোক সমবেত হয় রমনার বটবৃক্ষের তলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের তত্ত্বাবধানে বের করা হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, যা সারা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বর প্রদক্ষিণ করে। পাঞ্জাবী পরিহিত ছেলেদের পাশে খোঁপায় বেলী ফুলের মালায় সজ্জ্বিত হয়ে, লাল পেড়ে সাদা শাড়ীর তরুণীরা মেতে ওঠে “ইলিশ-পান্তা” উৎসবে। গ্রামাঞ্চলও কোনদিক দিয়ে পিছিয়ে নেই “পহেলা বৈশাখ” উদযাপনে। জায়গায় জায়গায় বসে মেলা হরেক রকম জিনিষের পসরা সাজিয়ে। বাড়ি বাড়ি বিলানো হয় ঘরে তৈরী মিষ্টি, নতুন চালের পায়েস ইত্যাদি। আর সবকিছু ছাপিয়ে এ প্রজন্মের একজন বাঙালিকে বৈশাখ যা শেখায় তা হলো সংগ্রাম করার সংকল্প। বাংলা সংস্কৃতির ওপর কালো থাবা বিস্তারে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্বপাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে। পাকিস্তান সরকারের এই অন্যায় আচরণের জবাব দিতেই “ছায়ানট” ১৯৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল (১লা বৈশাখ, বাংলা ১৩৭২ সন) রমনার বটমূলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “এসো হে বৈশাখ এসো এসো” গানটি দিয়ে সর্বপ্রথম যাত্রা শুরু করে। বস্তুত এই দিনটি থেকেই “পহেলা বৈশাখ” বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম এক পরিচায়ক রূপ ধারণ করে। ১৯৭২ সালে (বাংলা ১৩৭৯ সন) ‘পহেলা বৈশাখ’ বাংলাদেশের জাতীয় পার্বন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবার আগ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার ২১এ ফেব্রুয়ারীর মতোই থামিয়ে দিতে চেয়েছে বৈশাখের উদযাপন। সেই সূত্র ধরেই ২০০১ (বাংলা ১৪০৮ সন) সালের বোমা-গ্রেনেড হামলা। কিন্ত অজেয় বাঙালির সামনে মাথা তুলে কোনদিনই দাঁড়াতে পারেনি কোন সাম্প্রদায়িক শক্তি। পহেলা বৈশাখের আবেদনও শেষ হয়ে যায়নি শত বাঁধার মুখেও। ঢাকার রমনা কিংবা গাঁয়ের সবচেয়ে প্রাচীন বটগাছটির গন্ডি পেরিয়ে বৈশাখ আজ পালিত হয় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি শহরে যেখানে ন্যূনতম সংখ্যক বাঙালিও বিদ্যমান। এইতো আমাদের বাঙালি ঐতিহ্য, এইতো আমাদের বৈশাখের ঐতিহ্য, যেকোনো বাধা বিপত্তি পেরিয়ে, সহস্র প্রতিকূলতা ছাড়িয়ে, রাস্ট্রীয় অস্থিতিশীলতার মাঝেও আমাদেরকে মাতিয়ে তোলে বর্ষবরণ উদযাপনে। যে কারণে বাউলের বৈশাখ একতারাতে, কবির বৈশাখ কবিতায়, শিল্পীর বৈশাখ গানে, মাঝির বৈশাখ  বৈঠায়, জেলের বৈশাখ জালে, রাজনীতিকের বৈশাখ রাজপথে আর অনমত্ম স্বপ্নবাজের বৈশাখ স্বপ্নে। এই বৈশাখ যে যার মত করে পালন করম্নক, তবে বৈশাখ থাকুক প্রাণের মাঝে, মনের মাঝে সকাল সাঝে।  বৈশাখের একটি গান দিয়ে প্রকৃতির সুন্দর সবুজ এই দিনটি সুখজ হয়ে উঠুক প্রত্যাশা করছি- রঙমাখা প্রজাপতি ফড়িং-এর ডানা/সময়ের ঘরে বুঝি দিল আজ হানা।/ চলে গেল চৈত্র এলো বৈশাখ/ গগনের সীমা জুড়ে তুফানের ঝাঁক।/ পাখ মেলে ধলবক চোখ টানা টানা/ ঝড় নামে ধুপধাপ টুপটাপ বাড়ি/  মেঘ আর সুরম্নজের চলে কাড়াকাড়ি/ গাছে গাছে সুবাসের খেলা/ হিজলের তলে ঐ বৈশাখী মেলা…

mominmahadi@gmail.com

ফিচার সম্পাদক