ভালোবেসে বিয়ে ও স্ত্রীর পরিবার কর্তৃক একটি জালিয়াতি মামলা
প্রেম স্বর্গীয়। সেই স্বর্গীয় সুধা পানে প্রেমিক-প্রেমিকারা অনেক সময় বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সাবালক-সাবালিকা হিসেবে এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ও আইনগত অধিকার তাদের আছে। সেই অধিকারের ভিত্তিতে তারা স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এতে বাঁধ সাধে উভয় পরিবারের পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন। শেষমেশ বিষয়টি অনেক সময় থানা-কোর্ট কাচারীতে গিয়ে পৌঁছায়।
আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন একজন সুদর্শণ যুবক। জালিয়াতি ও প্রতারণার একটি মামলার সাক্ষ্যপর্ব চলছে। সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে জবানবন্দি প্রদান করছেন। মেয়েটির ভাষায় ছেলেটি একজন প্রতারক ও জালিয়াত। ছেলেটি তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, জালিয়াতি করেছেন। তাকে ভুল বুঝিয়ে ভুয়া নিকাহনামা তৈরি করেছেন। বিচারক মেয়েটির জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করছেন। ছেলেটির নাম সুজন (ছদ্মনাম)। মাঝারি গড়নের, চিকন ও ফরসা। ডাগর ডাগর দুটি চোখ জুড়ে যেন সরলতার প্রতিচ্ছবি। ওই দুটি চোখই বলে দেয়, তার হৃদয়ের গহীনে জমে থাকা যন্ত্রণার ঢেউ। সাক্ষীপর্ব শেষ হলো। আমি অনুসন্ধানের চেষ্টা করি ছেলেটির হৃদয়ের গহীনে জমে থাকা কষ্টের কাহিণী।
আদালত থেকে সংগ্রহ করি মামলার সকল কাগজপত্রাদি। কথা বলি অস্থির চেহারার মেয়ে রুণা (ছদ্মনাম) ও তার পিতামাতার সাথে। কথা বলি আসামির কাঠগড়ায় দুই হাত প্রার্থনাবেশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ওই ছেলেটির সাথে। আলাপচারিতা অবশেষে বেরিয়ে আসে মামলার আসল রহস্য।
ছেলেটি বর্তমান একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাষ্টার্সের ছাত্র। মেয়েটিও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। তাদের অনেক দিনের পরিচয়। কলেজ থেকে একই সঙ্গে পড়াশুনা করেছে। তখন থেকেই তাদের মধ্যেই গড়ে উঠে নিবিড় সম্পর্ক। অবশেষে তাদের দুজনের সিদ্ধান্তে বিয়ে হয়। সাক্ষী ছিলেন সমবয়সী দুবন্ধু। কিন্তু তখন তারা কেউই সাবালক ছিলেন না। অথচ ১৯৬১ সালে প্রণীত মুসলিম বিবাহ আইন অনুযায়ী, বিবাহ করতে ইচ্ছুক পক্ষদ্বয়কে অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্ক-বয়স্কা এবং সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুরুষের বয়স ন্যূনতম ২১ বছর এবং স্ত্রীলোকের বয়স ন্যূনতম ১৮ বছর হতে হবে। ওরা কাজীকে ম্যানেজ করে কোর্টে এসে হলফনামা তৈরী করে পরে বিয়ের কাবিননামা তৈরী করিয়ে নেয়। বিয়ে সম্পন্নের পর দুজন দুজনের বাসায় চলে যায়। কথা ছিল দুজন প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিষয়টি পরিবারকে জানাবে। সবাই তখন অবশ্যই এ সম্পর্ক মেনে নেবে। এভাবেই চুপি চুপি কেটে গেল অনেক দিন। হঠাৎ মেয়েটির বাবা-মা বিষয়টি জেনে যায়। এরপর থেকেই বদলে যায় পুরো প্রেক্ষাপট। পারিবারিক চাপে মেয়েটিও ছেলেটির সাথে আগের মতো যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ছেলেটি তার ভালবাসার মেয়েটির মধ্যে একটি পরিবর্তনের আভাসও খুঁজে পায়। এদিকে যোগাযোগের চেষ্টা করলে মেয়েটির মা-বাবা এবং ভাই ছেলেটিকে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। এরই মধ্যে ছেলেটি জানতে পারে মেয়েটির বিয়ে ঠিক হয়েছে অন্য কোথাও। এটা শোনার পর ছেলেটি পাগলের মতো হয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় মেয়েটির বাসায়। তখন ওর বাবা ছেলেটিকে মারধর করেন। একটি বিশেষ মাধ্যমে ছেলেটি একসপ্তাহ পর মেয়েটির সঙ্গে দেখা করে আর্তনাদ করে জিজ্ঞেস করেন, কেন এমন হলো। মেয়েটি মা-বাবার দোহাই দিয়ে বলে, ওর কিছু করণীয় ছিল না।
এর কিছুদিন পর ছেলেটি বিয়ের কাবিননামা, হলফনামার ফটোকপি করে মেয়েটির বাসায় নিয়ে যাই। তখন মেয়েটির বাবা আর ভাই এগুলো জালিয়াতি, প্রতারণা আর মেয়েটিকে ভুল বুঝিয়ে তৈরী করিয়েছে বলে শাসান। ঘটনার দু-এক দিন যাওয়ার পরই মেয়েটির এক দুলাভাই ছেলেটিকে ফোন করে বাসস্ট্যান্ডে আসতে বলেন। ছেলেটি সরল বিশ্বাসে সেখানে উপস্থিত হওয়া মাত্র দুজন পুলিশ এসে তাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। পরের দিন জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগ এনে তাকে কোর্টে চালান করে দেয়া হয়। কয়েকদিন হাজতবাসের পর ছেলেটি জামিনে মুক্তি পায়।
ছেলেটিকে সহায়তা করার জন্য আর এখন কেউ নেই। বন্ধুবান্ধবেরা মামলা-মোকদ্দমার কথা শুনে দূরে দূরে থাকে। তাই নিজের ঝুট-ঝামেলা নিজেই মিটিয়ে নিতে ছেলেটি মরিয়া হয়ে ছুটছে। যেহেতু মেয়েটির ওই ছেলেটির সাথে বিয়ে হয়েছে, বিয়ের সব দলিল আছে; সেক্ষেত্রে তালাক না দিয়ে মেয়েটি অন্যত্র বিয়ে করতে পারবে না। করলে ছেলেটির পক্ষ থেকে ফৌজদারি মামলা করার সুযোগ আছে মেয়েটির মা-বাবার বিরুদ্ধে। আবার দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার চেয়ে পারিবারিক আদালতেও ছেলেটি যেতে পারেন। তবে মেয়েটির সম্মতি না থাকলে তো খুব একটা প্রতিকার পাবেন না। কারন দাম্পত্য পুনরুদ্ধার মোকদ্দমার ক্ষেত্রে স্বামীরা এ প্রতিকার বেশি চাইলেও ৯০ শতাংশ ডিক্রিই স্ত্রীর পক্ষে যায়। আর এ ধরনের প্রতিকার স্বামী বা স্ত্রীকে দাম্পত্য অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ডিক্রি কোনো পক্ষ পেলেও সাধারণত ডিক্রি কার্যকর হয় না। এ ডিক্রি প্রাপ্তির ফলে কেবল স্বামী বা স্ত্রীর উপর দাম্পত্য অধিকারটি স্থাপিত করা যায়, যাতে অপর পক্ষ দ্বিতীয় বিয়ে কিংবা বিনা কারণে তালাক না চান। তবে তাঁকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপরে জোর করা যায় না। এতে সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকার লংঘিত হয়। তবে কেউ যদি তালাক চান, তাহলে আলাদাভাবে তা কার্যকর করতে হবে। আর স্বামী-স্ত্রীর ঘর-সংসার করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যদি শ্বশুরবাড়ির লোকজন এতে বাঁধা দেয়, তাহলে ফৌজদারী আদালতের আশ্রয় নেওয়া যায়।
পাঠক! পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় ছেলেরাও কত অসহায়ভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছে, তা বুঝতে আর বাঁকী রইলো না। বাঙালী জাতি হিসেবে আমরা অনেক আবেগ প্রবণ। আবেগের তাড়নায় জীবনের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে জীবন সম্পর্কে না বুঝে এভাবে ছেলেমেয়েরা ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। তারা দুজন ছিল অপ্রাপ্ত বয়স্ক, তবুও টাকার বিনিময়ে কাজি তাদের বিয়ে পড়ালেন। কাজি যদি ছেলে ও মেয়ে দুজনের পরিবারের মতামত নিয়ে বিয়ে পড়াতেন, তাহলে ছেলেটিকে এত বড় প্রতারণার শিকার হতে হতো না। তাই বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজিদের প্রতি সরকারের উচিত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর করা।
লেখকঃ আইনজীবী ও কলামিষ্ট।।