বিশ্বাসের ঘরে চুরি এবং দু’জন তোতা পাখিসম মন্ত্রী
আবারো প্রমাণিত হলো গ্রাম বাংলার সেই ঐতিহ্যবাহী কথাটি- ‘অতি সাধু চোরের লÿণ’। আমাদের এই বাংলাদেশে সময়ের স্রোতে ভেসে ভেসে অনেক কিছুই হয়েছে। যেমন- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলমন্ত্রী হওয়ার পূর্ব পর্যমত্ম বলেছেন বিভিন্ন উচিৎকথা-হককথা-সাহসকথা এবং ধর্মকথা। পাশাপাশি সচল ছিলেন একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা ওবায়দুল কাদেরও। এই দুই সত্যকথা বলা মানুষকে কঠিন দায়িত্বসহ মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। আর ঠিক প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছেমতই তোতাপাখি বনে যান এই দুই সাহসকথা বলা পাখি। কেন থেমে গেল তাদের উচিৎকথা? এমন প্রশ্ন যখন মানুষের মুখে মুখে ঠিক তখন-ই সরকারের শেষ সময়ে নিয়োগকৃত রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারম্নক তালুকদারের গাড়িতে নগদ ৭০ লাখ টাকা পাওয়া নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় শুরম্ন হয়েছে। এই তোলপাড় শুধু দেশেই নয় চলছে বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যেও। কেননা, তাদের পাঠানো রেমিটেন্সের টাকায় চলা দেশে মন্ত্রীর এপিএস এত টাকা কোথায় পেলেন, রেলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধার সঙ্গে গভীর রাতে এত টাকা নিয়ে তিনি কোথায় কাকে দিতে যাচ্ছিলেন এ ধরনের হাজারো প্রশ্ন উঠেছে তাদের মনের ঘরে। বিষয়টি আরো জটিল হয়ে উঠেছে অঘোষিত এই বিপুল অঙ্কের টাকাসহ বিজিবির হাতে তাদের ‘আটক’ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাদের ছাড়িয়ে নেয়া এবং পরে এপিএসের পক্ষে রেলমন্ত্রীর সাফাই গাওয়া নিয়ে। তবে এ ঘটনা তদমেত্ম পৃথক দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটি কমিটি জিএম ইউসুফ আলী মৃধার ব্যাপারে তদমত্ম করবে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) শশী কুমার সিংহ। আরেক কমিটি ওমর ফারম্নক তালুকদারের ব্যাপারে তদন্ত করবে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন মন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) আখতারুজ্জামান। দুটি কমিটিকেই ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এদিকে পুরো বিষয়টি গোপন রাখতে বিজিবির তৎপরতায় সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এর নেপথ্যে কি প্রভাবশালী এমন কেউ রয়েছেন, যাকে ঘাঁটাতে খোদ বিজিবিও সাহস হারিয়ে ফেলেছে। নাকি বিশেষ কোনো মহলের নির্দেশে তারা চুপ থাকতে বাধ্য হয়েছে। একটি সংবাদপত্র লিখেছে, গত সোমবার রাতে একটি নোয়া মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো-১৩-৭৯৯২) দ্রুত গতিতে বিজিবির সদর দপ্তর পিলখানার ৩ নাম্বার গেট পার হওয়ার সময় গেটে দায়িত্বরত সেনাসদস্যরা গাড়িটি থামানোর জন্য সংকেত দেন। কিন্তু চালক গাড়িটি না থামিয়ে বেপরোয়া গতিতে বিজিবির ৪ নাম্বার গেট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনাসদস্যরা তার আগেই গাড়িটি আটকিয়ে দেন। তারা ৩ নাম্বার গেটে সংকেত দেয়ার পর গাড়ি না থামানোর কারণ জানতে চান। কিন্তু এর কোনো সদুত্তর না দিয়ে গাড়িচালক জামশেদ মাইক্রোবাসের পেছনের আসনে বসা রেলমন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। বিষয়টি নিয়ে গেটে দায়িত্বরত সেনাসদস্যদের সঙ্গে চালকের বাকবিত-া শুরু হয়। এর এক পর্যায়ে ওমর ফারুকও গাড়ি থেকে নেমে এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেন। বিষয়টি বিজিবির উচ্চ মহলে পৌঁছলে তারা গাড়িটি আটক করে তাতে তলvশি চালানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু মন্ত্রীর এপিএস তাতে ঘোর আপত্তি তোলেন। তবে তাকে উপেক্ষা করে মাইক্রোবাসে তলvশি চালানো হলে গাড়ির বনেটের ভেতর থেকে বস্তাভর্তি ৭০ লাখ টাকা পাওয়া যায়। তবে প্রত্যক্ষদর্শী একজন বিজিবির সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গাড়িচালকই দ্রুত গতিতে মাইক্রোবাসটি চালিয়ে এনে গেটে কর্তব্যরত সেনাসদস্যদের সামনে দাঁড় করান এবং গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে চাবি নিয়ে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। তিনি দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তাদের জানান, গাড়িতে অবৈধ ৭০ লাখ টাকা রয়েছে। তাকে দিয়ে জোরপূর্বক ওই টাকা বহন করানো হচ্ছে। গাড়িচালকের এ কথা সেনা কর্মকর্তারা প্রথমে বিশ্বাস করতে চাননি। কিন্তু পরে তারা তলvশি চালিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে টাকার বস্তা উদ্ধার করেন। মুহূতের্র মধ্যেই এ খবর গোটা পিলখানায় ছড়িয়ে পড়ে। বিজিবির বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা উৎসুক হয়ে খোঁজ-খবর নিতে শুরু করেন। পরে তাদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর এ খবরটি সাংবাদিকদের কানে আসে। তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা পিলখানার ৩ ও ৪ নাম্বার গেটে ভিড় জমান। অনেকেই বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. মুহাসিনকে মোবাইল ফোনে কল করেন। কেউ কেউ বিজিবিতে কমর্রত ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার কাছেও বিষয়টি জানতে চান। শুরুতে তাদের অনেকেই খোঁজ-খবর নিয়ে স্পর্শকাতর এ বিষয়টি সাংবাদিকদের জানানো হবে বলে আশ্বাস দিলেও পরে তারা পুরোপুরি চেপে যান। পিলখানায় এ ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি বলেও বিজিবির কেউ কেউ দাবি করেন। এদিকে রহস্যজনকভাবে ভোর হওয়ার আগেই রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার এবং রেলওয়ের জিএম (পূর্ব) ইউসুফ আলী মৃধাকে ছেড়ে দেয়া হয়। জানা গেছে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। একই সঙ্গে তারা যাতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি না হন, সেজন্য তাদের কৌশলে ভিন্ন গেট দিয়ে পার করে দেয়া হয়। তাদের সঙ্গে থাকা ওই ৭০ লাখ টাকাও ফেরত দিয়েছে বিজিবি। অন্যদিকে রেল ভবন সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রেলমন্ত্রীর এপিএস ফারুক তালুকদারের ব্যক্তিগত গাড়িতে রেলের জিএম (পূর্ব) ইউসুফ আলী মৃধা এবং রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ঢাকার কমান্ড্যান্ট এনামুল হক রওনা হন। তবে তাদের গন্তব্য কোথায় ছিল, তা কেউ জানাতে পারেনি। বিজিবির একটি সূত্রে জানা গেছে, গাড়ি থেকে ৭০ লাখ টাকা উদ্ধার হওয়ার পর গাড়িচালক জামশেদ, এপিএস ওমর ফারুক, জিএম ইউসুফ আলী মৃধা এবং রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ঢাকার কমান্ড্যান্ট এনামুল হককে বিজিবির হেড কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখান থেকে বিষয়টি রেলমন্ত্রীকে জানানো হয়। এরপর শুরু হয় উচ্চ মহলে ছোটাছুটি। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনার পর রাতেই তাদের ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিজিবি। কিন্তু স্পর্শকাতর এ বিষয়টি নথিভুক্ত না করে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে কিনা, এ নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে আলোচনায় বেশ কিছুটা বিলম্ব হয়। পরে মঙ্গলবার সকালের দিকে বিজিবির ৫ নাম্বার গেট দিয়ে একে একে সবাইকে ছেড়ে দেয়া হয়। এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেল ভবনে পহেলা বৈশাখ ঢাকা-সিলেট রুটে নতুন আন্তঃনগর রেল সার্ভিস চালুর ব্যাপারে পূর্বনির্ধারিত এক সংবাদ সম্মেলনে ওই টাকা তার এপিএসের বলে স্বীকার করেন। ?সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জানান, গত সোমবার গভীর রাতে টাকা নিয়ে বাসায় যাওয়ার সময় ওমর ফারুকের চালক তাকে অপহরণের চেষ্টা করছিল। এ সময় ভয়ে জীবন বাঁচাতে তিনি বিজিবি সদর দপ্তরের ভেতরে প্রবেশ করেন। মন্ত্রী আরো জানান, গাড়িতে রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম, পূর্বাঞ্চল) ইউসুফ আলী মৃধাও ছিলেন। পরে তারা নিজ নিজ বাড়িতে চলে যান। ওমর ফারুকের কাছে এত টাকা কিভাবে এলোথ জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এটা তার ব্যক্তিগত টাকা। তবে তিনি শুনেছেন, ওমর ফারুককে অপহরণ করা হয়েছিল। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি কেনথ জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট হাতে পেলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তারা এখন বাসায় আছেন জানিয়ে রেলমন্ত্রী বলেন, নিজের টাকা নিজের সঙ্গে রাখার ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়। কারণ, তার টাকা তিনি কোথায় রাখবেন, নিজের সঙ্গে রাখবেন, নাকি বাসায় রাখবেন, সেটা তার ব্যাপার। তবে কোনো অন্যায় আছে কিনা, তা তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে। যদি তার অথের্র সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ কিছু থাকে, তাহলে তা খতিয়ে দেখবে এনবিআর। এটা তাদের বিষয় নয়। ওমর ফারুক তালুকদার ও ইউসুফ আলী মৃধা অফিস করবেন কিনা জানতে চাওয়া হলে মন্ত্রী বলেন, তারা অফিস করবেন না কেন? তাদের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগে শাস্তি দেয়া ঠিক হবে না। সাংবাদিকদের অপেক্ষা করার কথা বলে তিনি জানান, মাত্র কয়েকদিনের ব্যাপার। এর মধ্যে রিপোর্ট পেলেই স্পষ্ট হবে, তারা অপরাধী কিনা। তারপরই ব্যবস্থা। এ ঘটনার সঙ্গে জিআরপি পুলিশ এনামুল হকও ছিলেন কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, তিনি শুনেছেন দুইজনের কথা। তার কাজ শেষ হলে বাকি সময় তাদের নিজের। তারা কোথায় যান, কী করেন, সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনের কারণ সম্পর্কে রেলমন্ত্রী জানান, পহেলা বৈশাখে ঢাকা-সিলেট রুটে একজোড়া নতুন ট্রেন চালু করার কথা ছিল। কিন্তু সেদিন ট্রেনগুলো চালু করা যাচ্ছে না। এটা জানানোর জন্যই সাংবাদিকদের ডাকা।’ তবে ট্রেনটি বৈশাখ মাসের মধ্যেই চালু করার কথা রয়েছে। তিনি আরো জানান, ট্রেনের সবকিছুই সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তবে অনবোর্ড সার্ভিস বেসরকারি সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করবে। ‘যে যায় লঙ্কায় সে-ই হয় রাবন’ বাংলাদেশে বারবার প্রমাণত হচ্ছে চিরমত্মন এই সত্য কথাটি। তবুও আশায় বুক বাঁধে সবাই। সবার মনে একই কথা- ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মত কেউ আসবে, অবশ্যই আসবে বাংলাদেশের বর্তমানের অন্ধকার দূর করতে। যার বুকে-মুখে থাকবে প্রকৃত সত্য-সাহস আর মেধা। আমরা তথাকথিত এই ভন্ড নেতাদের নয়; তাঁর মত নেতার পথ চেয়ে বসে থাকবো, যার একটা কথায় সবাই সম্মিলিতভাবে দূর্নীতি দূর করতে যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়বে…
মোমিন মেহেদী : কলামিস্ট এবং মেয়র প্রার্থী, ঢাকা দÿÿণ সিটি কর্পোরেশন mominmahadi@gmail.com