ভুমিকম্প এবং সুনামি আতংক : বাঁচার উপায় কি?
দেশ কি শক্তিশালী ভূমিকম্পের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ? ঘন ঘন ভুমিকম্পে এ এক অজানা শংকা তৈরি হয়েছে সবার মনে। বাংলাদেশ একটি বড় মাত্রার ভূমিকম্পের দ্বারপ্রামেত্ম বিশেষজ্ঞদের এমন সতর্কবাণী পর এ বিপদাশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না কিছুতেই । এ অবস্থায় কখন যে ভুমিকম্প আঘাত হানে; কখন যে কে তার শিকার হয়, অজানা এ ভয়ে সবার বুক ধুরম্ন ধুরম্ন। আর এ ভয যেন জয় করার কোন উপায় নেই। কখন হবে ভূমিকম্প ? এ আতংক যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। এ আতংক গোটা দেশবাসীকে পেয়ে বসেছে । ভূমিকম্প কোথায় হবে ? কখন হবে এবং তা কত মাত্রায় হবে তা আগবাড়িয়ে কেউ বলতে পারে না। ভূমিকম্পের বিষয়টি সম্পূণর্ই অনুমেয়। তবে ভূমিকম্প হওয়ার কিছু পূর্বলক্ষন আছে। যা বাংলাদেশে বেশ লক্ষণীয়। এর লক্ষন হিসেবে প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও মৃদু ও মাঝারি মাত্রায় ভুমিকম্প হচ্ছে। সর্বশেষ ১১ এপ্রিল ৩ টা ৩৮মিনিটে সারা দেশে দফায় দফায় ভহমিকম্প সঙ্গে সুনামি সতর্কতায় জনমনে আতংক তৈরি হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় ২৮ মার্চ সকাল পাঁচটা ৪০ মিনিট ১৩ সেকেন্ড ৪.৮ মাত্রায় ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। এর ঠিক ১০ দিন আগে ১৮ মার্চ সকালে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। ৩.৮,৪.৮ এবং ৪.৬ মাত্রার ভুমিকম্প হলেও বাড়ি ঘর এমনকি নালা,পুকুরের পানি পর্যমত্ম থরে থরে কেঁপে ওঠে। আতঙ্ক তৈরি হয়। এ অতংক ছড়িয়ে পরে সারা দেশে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল ভূমিকম্পই নয়, দেশের উপকূলীয় এলাকা ঘিরে ভয়াবহ সুনামি সৃষ্টির জন্য সাইসমিক গ্যাপ বিরাজমান রয়েছে। এ গ্যাপ থেকে যে কোন সময় সুনামিও হতে পারে। তাঁদের মতে বঙ্গোপসাগরের উত্তরে আন্দামান থেকে টেকনাফ পর্যমত্ম সাবডাকশন জোন বরাবর ৬শ’ কিলোমিটারের একটি সাইসমিক গ্যাপ রয়েছে। আমাদের দেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তি এই সাইজমিক গ্যাপে জমা হয়ে আছে। এই সাইজমিক গ্যাপ আমাদের জন্য অশনিসঙ্কেত। এখান থেকে ৮ মাত্রার মতো শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তা যদি সাগরতলে হয় তাহলে সেই ভূমিকম্প সুনামি সৃষ্টি করতে পারে।বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প এবং সুনামিরই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পত্রিকামেত্ম বিশেষজ্ঞদের যে মতামত পাওয়া গেছে তাতে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই আমাদেও দেশে সুনামি ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি। তাদের মতে ৩টি পেস্নটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। বঙ্গোপসাগারের মাথা ঘেঁষে বেঙ্গল বেসিনের প্রধান অংশে বাংলাদেশের অবস্থান। তবে বড় ভূমিকম্প হবেই তা কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যাবে না। সম্প্রতি যেভাবে দেশে ঘনঘন ভুমিকম্প অনুভূত হচ্ছে তাতে আতংক বাড়ে বৈকি ? কিন্তু এ থেকে বাঁচার উপায় কি ? অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছবাস, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম খবর অনুযায়ী জানমাল রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়া যায়। কিন্তু ভূমিকম্পের বেলায় সে সুযোগ নেই। ভূমিকম্প ঘটে হঠাৎ করে। ফলে জানমাল রক্ষার প্রস্ত্ততি গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তা হলে কি ভূমিকম্পে শুধুই অকাতরে প্রাণ দিতে হবে? জীবন রক্ষার কি কোন উপায় নেই। এ দুর্যোগে কি কোনই সুযোগ নেই পূর্ব প্রস্ত্ততির? ভূমিকম্পের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়া অধিক জরম্নরি। তাই ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা এবং সে অনুযায়ী প্রস্ত্তত থাকা প্রয়োজন। যারা ঢাকায় থাকেন তাদের কথাতো কথা বলাই বাহুল্য। ইতিহাসে প্রথম সুনামির প্রমাণ পাওয়া যায় ৩২৩ খৃষ্টপূর্বাব্দে আবর সাগরের পশ্চিমে। এরপর আরও তিনটি সুনামি ১৫২৪, ১৮১৯ এবং ১৯৪৫ সালে ভারতের পশ্চিম উপকূলে বিপর্যয় ঘটিয়েছে। বঙ্গোপসাগরে প্রথম সুনামি সৃষ্টি হয় ১৭৬২ সালের ২ এপ্রিল চট্টগ্রাম উপকূলে। এ অঞ্চলে আর দুটি সুনামি ১৮৪৭ ও ১৮৮৩ সালে নিকোবর দ্বীপ ও মাদ্রাজে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত করে। আর ২০০৪ সালের এশিয়া সুনামি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর নিষ্ঠুরতা শুধু বঙ্গোপসাগরেই সীমাবদ্ধতা ছিল না, সুদূর আফ্রিকার মাদাগাস্কার ও সোমালিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সুমাত্রার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের ভারত ও বর্মা পেটের সংঘর্ষের ফলেই সৃষ্টি হয়েছিল এ সুনামির।একটি সুনামি যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে তা এ অঞ্চলে জনসাধারণ প্রত্যক্ষ করেছে ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর। শুধুমাত্র এ সুনামির আঘাতে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়াসহ এ অঞ্চলে প্রাণহানি হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার। বঙ্গোপসাগরে সুনামি সৃষ্টি হলে তা ভারতের উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কঙ্বাজার, সন্দ্বীপসহ উপকূলের সব অঞ্চলে সরাসরি আঘাত হানবে। বাংলাদেশের সমতল ভূমি নিচু এলাকা হওয়ায় এই সুনামির প্রভাব অনেক ভিতরে চলে আসবে। গত কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে ঘনঘন ভূমিকম্প হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালের এপ্রিল হইতে ডিসেম্বর পর্যমত্ম ৫১টি এবং ২০০৮ সালে ৫৩টি, ২০০৯ সালে ৩০ টি, ২০১০ সালে ৪১ টি এবং চলতি সনে বড় ধরনের ২ টিসহ বেশ কটি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। জাতিসংঘের তৈরি ভূমিকম্পজনিত দুর্যোগের তালিকায় ঢাকা এখন দ্বিতীয় অবস্থানে। ভূবিদদের এক পরিসংখানে দেখা গেছে সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে কেবল রাজধানী ঢাকার প্রায় ৩ লাখ ২৬ হাজার অবকাঠামোর মধ্যে ৭২ হাজার ভবন ধসে যাবে। এতে প্রায় ৯০ হাজার লোকের প্রাণহাণী হবে।
রাজধানী ঢাকা ছাড়াও বিশেষজ্ঞরা দেশের ৬৪ টি জেলারমধ্যে ৪৭ টিই ভুকম্পন এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। বাংলাদেশের ছয়টি স্থানে মাটির নিচে বড় ধরনের ফাটল রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় ফাটলটি প্রায় ১০০ কিলোমিটার লম্বা। এ ফাটলের কারণে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, রংপুর এবং দিনাজপুর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে । মধুপুর এলাকায় অবস্থিত ফাটলের কারণে ঢাকা এবং এর পাশ্ববর্তী এলাকা ভূমিকম্প বা ভূমিধসে যে কোনো সময়ে ব্যাপক ভবন ধসে ভয়াবতির সম্মুখীন হতে পারে। এ অবস্থায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানী ঢাকাই। আমরা যে বিল্ডিংয়ে বসবাস করি অনেকেই জানিনা বড় মাত্রায় ভুমিকম্পন হলে সে বিল্ডিংটি দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম হবে কি না। তবে শংকার বিষ হচ্ছে বড়াবরই এদেশ ভুমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকলেও ভুমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতা, স্ব্যাস্থ সেবা নিশ্চিত করা, ধ্বংস্ত্তপ শহর জনপদকে জাগিয়ে তোলার তেমন কোন প্রস্ত্ততি নেই সরকারের। আবহাওয়াবিদদেও বারবার তাগিদের পরও সরকারী তৎপরতা না থাকায় উদ্বিগ্ন দেশের মানুষ। এ ক্ষেত্রে অণুসরণীয় বিষয়সমূহ হলো- ভূকম্পন অনুভূত হলে যথাসম্ভব শান্ত থাকতে হবে, আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করা বা সাথে সাথেই বাড়ি থেকে বের হবার চেষ্টা করা উচিত নয়। কারণ ভূমিকম্প সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ সেকেন্ড স্থায়ী হয় এবং তা বুঝে উঠতেই ৫-১০ সেকেন্ড সময় চলে যায়। তাই ভূমিকম্পের সময় ভবন থেকে দৌড়ে বের হওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ভূমিকম্পের সময় বিছানায় থাকলে বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে নিতে হবে এবং টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কোন আসবাবপত্রের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। যার নিচে আশ্রয় নেবেন তা এমনভাবে ধরে থাকতে হবে যাতে সেটি মাথার ওপর থেকে সরে না যায়। এ সময়ে শক্ত দরজার চৌকাঠের নিচে অথবা পিলারের পাশে আশ্রয় নেয়া উত্তম। বারান্দা, ব্যালকনি, জানালা, বুকশেলফ, আলমারি, কাঠের আসবাবপত্র, বাঁধানো ছবি বা অন্য কোন ঝুলমত্ম ভারি বস্ত্ত থেকে দূরে থাকতে হবে, যাতে ঐ সকল জিনিস গায়ের ওপর না পড়ে। রান্নাঘরে থাকলে যত দ্রম্নত সম্ভব গ্যাস লাইন বন্ধ করে বের হয়ে আসতে হবে। সম্ভব হলে দ্রম্নত বাড়ির বিদ্যুতের মূল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে এবং গ্যাসের চাবি বন্ধ করতে হবে। উচু বাড়ির জানালা, বারান্দা বা ছাদ থেকে লাফ দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করা বোকামি, কোনভাবেই এ কাজ করা যাবে না। এ সময়ে কোনভাবেই লিফ্ট ব্যবহার করা যাবে না। ঘরের বাইরে থাকলে গাছ, উঁচু বাড়ি, বিদ্যুতের খুঁটি থেকে দূরে খোলাস্থানে আশ্রয় নিতে হবে।
ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের মূল লক্ষ হওয়া উচিত দুইটি। প্রথমত, ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে নিম্নতম পর্যায়ে রাখা এবং দ্বিতীয়ত, ভূমিকম্পপরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেওয়া। দীর্ঘদিন যাবৎ ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকির কথা বলা হইলেও উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের অবস্থা এখনও খুবই শোচনীয়। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিম্নতম পর্যায়ে রাখতে হলে বাড়িঘর ও হাসপাতালসহ সরকারি-বেসরকারি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে মেনে চলা উচিত। অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সরকারের তরফ হতে যন্ত্রপাতি ক্রয় ও স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণের কথা বলা হলেও ভূমিকম্পপরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেয়ার ন্যূনতম প্রস্ত্ততিও যে আমাদের নাই তা স্পষ্ট । ব্যাপক অভাব রয়েছে জনসচেতনতারও। ইতোমধ্যে অনেক মূল্যবান সময় অপচয় হয়েছে। আর বিলম্ব করা সমীচীন হবে না। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্ত্ততি গ্রহণের প্রকৃত সময় এখনই। আর কাল ক্ষেপন না করে এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের জরম্নরী পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও নিউজ বাংলাদেশ ডট কমের সম্পাদক। newsstore09@gmail.com ) .