পত্রপত্রিকায় প্রথম পর্বে….
সাযযাদ কাদিরঃ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর পাঁচ দশক কাটলো আমার। এ প্রকাশ ঘটেছে সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতার সূত্রে। মাঝেমধ্যে পিছন ফিরে দেখি জীবনের হারানো সময়। অনেক ঘটনা এখনও স্পষ্ট হয়ে ভাসে চোখের সামনে। সে সব কেবল ব্যক্তিগতভাবে আমার নয়, অনেক ঘটনা আজ দেশ ও জাতির ইতিহাসের অংশ। ভাবি, এর কিছু লিখে রেখে যাওয়া উচিত। কিন্তু সারা জীবন বহুজনের কথা লিখলেও নিজের কথা লেখার বিষয়টি মাথায়ই আসে নি কখনও। তাই লিখি নি তেমন কিছু। এখন এই এতগুলো বছর পাড়ি দিয়ে আসার পর (এই সামনেই ১লা বৈশাখে পা রাখবো ৬৫ বছরে) মনে হচ্ছে, এ তো আমার কথা নয় শুধু, আরও অনেকের কথা, বিভিন্ন সময়ের কথা। তাই কিছু-কিছু লিখছি, তবে অভ্যাসবশত লিখছি নিজেকে যথাসম্ভব প্রচ্ছন্ন রেখে। সে সব লেখার একটি অংশ, পত্রপত্রিকায় আমার সংশ্লিষ্টতার প্রথম পর্বের, বিশেষ করে টাঙ্গাইল পর্বের কিছুটা বিবরণ তুলে ধরলাম এখানে।
টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত যে পত্রিকায় আমার প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে তার নাম “বাতায়ন”। ঘটনাটি ১৯৫৮ সালের। আমি তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। কবি আল মুজাহিদী সম্পাদিত “বাতায়ন” ছিল হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা। আমাদের বিন্দুবাসিনী স্কুলের নোটিশ বোর্ডে ছিল তার স্থান। মাঝেমধ্যে টাঙ্গাইলের অন্যান্য স্কুলে, বিবেকানন্দ ও শিবনাথ-এ, আবার করটিয়ার সা’দত কলেজেও যেতো।
সেবার কৃষি, শিল্প, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রদর্শনী উপলক্ষে শহরে ছিল খুব তোড়জোড়। করোনেশন পার্কে প্রতি বছর আয়োজিত ওই প্রদর্শনী ছিল সেকালে শহরবাসীর কাছে বছরের সেরা আকর্ষণ। আমাদের স্কুলের স্টলে সেবার স্থান পেয়েছিল আমার আঁকা দু’টি ছবি। এর একটি পুরস্কারও পেয়েছিল। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার দিয়েছিল প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যা “বাতায়ন” ? ১১ বছরের এক বালকের ‘আধুনিক গদ্য কবিতা’কে তার বুকে স্থান দিয়ে।
সা’দত কলেজের দেয়াল পত্রিকার নামও ছিল “বাতায়ন”। নামটি রেখেছিলেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ (১৮৯৪-১৯৭৮)। তখন ওই নামে তিনি ধারাবাহিক স্মৃতিকথা ‘মাসিক মোহাম্মদী’তে। ১৯৬২ সালে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কিছু দিন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি পত্রিকাটির। এ সুযোগ আমাকে দিয়েছিলেন অধ্যক্ষ তোফায়েল আহমেদ ? কলেজ বার্ষিকী “মালঞ্চ”তে আমার একটি লেখা পড়ে। লেখাটি ছিল এডগার এলান পো’র কবিতার শিল্পবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে।
ওই সময়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয় পাক্ষিক হিতকরী। এর সম্পাদক ছিলেন টাঙ্গাইলের ‘থার্ড অফিসার’ মির্জা আ মু আবদুল হাই (১৯৭৬ সালে আমার পীড়াপীড়িতে ‘মিরজা আবদুল হাই’), কার্যকরী সম্পাদক ছিলেন কাগমারী মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার আবদুর রহিম। দু’জনেই ছিলেন খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক। টাঙ্গাইল থাকতে মিরজা আ মু আবদুল হাই-এর কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয় ঢাকার নামী পত্রিকায়। সেগুলোর মধ্যে মাহে নও-এ প্রকাশিত “কিসের বাদ্য বাজে” এবং পূবালী-তে প্রকাশিত “রাজদর্শন”-এর কথা মনে আছে এখনও। আর মাসিক মোহাম্মদী-তে ওই সময় প্রকাশিত হচ্ছিল খন্দকার আবদুর রহিমের ধারাবাহিক উপন্যাস “যমুনাচরের বাসিন্দা”।
হিতকরী-তে কবিতা ও গল্প লিখেছি। ছোটদের বিভাগেও লিখেছি। আমার কবিতা “তারা নেই আকাশে” প্রথমে অমনোনীত করেছিলেন খন্দকার আবদুর রহিম। বলেছিলেন, বালক বয়সে এত নৈরাশ্য ভাল নয়। হতাশা-নিরাশাকে আমরা নীতিগত ভাবে উৎসাহিত করতে পারি না।
পরে কবিতাটি পড়ে মিরজা আ মু আবদুল হাই প্রশংসাই করেন। খন্দকার আবদুর রহিমকে ছাপতে অনুরোধ করে বলেন, ১৪-১৫ বছরের একটি ছেলে নিখুঁত ভাষা ও ছন্দে একটি কবিতা লিখেছে ? এই বিষয়টিকে আমাদের উৎসাহিত করা উচিত।
১৯৬৩ সালে আমার লেখা গল্প “বৃষ্টি এলো” প্রকাশিত হয় হিতকরী-তে। সুবোধ ঘোষের রচনারীতির দ্বারা বেশ প্রভাবিত ছিলাম তখন। লেখায় সেই প্রভাবের ছাপ ছিল যথেষ্ট। ২০০৮ সালে প্রকাশিত “দুই প্রজন্মের গল্প” (সম্পাদক: পপি চৌধুরী; প্রিতম প্রকাশ, ঢাকা) নামের একটি সঙ্কলনে পুনর্মুদ্রিত হয় গল্পটি। তবে কেউই বলতে পারেন নি গল্পটি ৪৫ বছর আগে লেখা।
একই বছর হিতকরী-র ছোটদের বিভাগ “কিশোর প্রাঙ্গণ”-এ ছাপা হয় আমার লেখা “টিয়া কেন এত বাঁচে”। লেখাটি এক বিদেশী লোকরচনার ভাবানুবাদ। ১৬ বছর পর প্রকাশিত আমার শিশুতোষ রচনার সঙ্কলন “তেপান্তর”-এ স্থান পেয়েছে ওই মজাদার গল্পটি।
বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনে যথেষ্ট সক্রিয় ছিলাম আমি। ওই সময়ে টাঙ্গাইলের মিছিল-সভা-সমাবেশে ব্যবহৃত বেশির ভাগ পোসটার-ফেসটুনে ছিল আমার হাতে লেখা স্লোগান। অনেক স্লোগানের ভাষাও রচনা করেছি আমি। দেয়াল লিখন-ও যে লিখেছি কত! এসব কাজে ফজলুর রহমান ফারুক (বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের প্রশাসক) ছিলেন আমার মূল উৎসাহদাতা। ছাত্রলীগের একুশে সঙ্কলন “ওরা আর ফিরে আসবে না” এবং পরে ছাত্র ইউনিয়নের একুশে সঙ্কলন “ডাক দিয়ে যাই” ? উভয়েরই সম্পাদক ছিলাম আমি। পাড়ায় গড়ে তুলেছিলাম ‘সমন্বয়’ নামে এক সাহিত্য সংঘ। এর সাধারণ সম্পাদক ছিলাম আমি। সংঘের মুখপত্র “সমন্বয়”-এরও সম্পাদক ছিলাম আমি। এতে জড়িত ছিলেন সিরাজুল ইসলাম শাহজাহান (আমার পীড়াপীড়িতে নাম পরিবর্তন করে শাজাহান সিরাজ, সাবেক মন্ত্রী), আবদুল লতিফ সিদ্দিকী (বর্তমানে পাট মন্ত্রী), আনোয়ার-উল-আলম শহীদ (আমার পীড়াপীড়িতে হয়েছিলেন ‘শহীদ আনোয়ার’, সাবেক রাষ্ট্রদূত), আমীরুল ইসলাম (বর্তমানে বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজের অধ্যক্ষ, নূরুন্নবী সাঈদ, আসাদ তালুকদার (সাবেক চেয়ারম্যান, বিসিক), রফিকুল ইসলাম মন্টু, বদরুল আমীন, রুহুল আমিন ও আরও অনেকে। এছাড়া কবিতাপত্র “শব্দরূপ”-এরও সম্পাদক ছিলাম আমি। দু’টি সংখ্যা বেরিয়েছিল এ সঙ্কলনটির।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর-পরই “পূর্বদেশ” পত্রিকা উদযোগ নেয় টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলীর ওপর বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের। পত্রিকার পক্ষ থেকে মাহফুজ সিদ্দিকী (তোতা ভাই) দায়িত্ব নিয়ে আসেন টাঙ্গাইলে, যোগাযোগ করেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের সঙ্গে। তিনি সম্মতি দেয়ার পর তাঁর নির্দেশ ও পরিকল্পনা অনুযায়ীই প্রকাশিত হয় ক্রোড়পত্রটি। ওই সময় মাহফুজ সিদ্দিকী সমন্বয় করেন প্রকাশনার গোটা কাজ। সঙ্কলন, সম্পাদনা, এমন কি রিটাচিং-এর কাজও করি আমি। টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় এখনও অনেকের মূল অবলম্বন ওই ক্রোড়পত্র।
এর পর এসে পড়ে সাপ্তাহিক রণাঙ্গন সম্পাদনার কাজ। মুক্তিযুদ্ধ কালে সাইক্লোস্টাইলের মাধ্যমে কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল, এবার উদযোগ নেয়া হয় মুদ্রিত আকারে প্রকাশের। এই উদযোগের নেপথ্যে ছিল হিলালী। পুরো নাম খন্দকার ইমামুল হক হিলালী। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে এ ব্যাপার আলাপ-আলোচনা করেছিল সে, পরে যাবতীয় যোগাযোগও রক্ষা করেছে। ‘রণাঙ্গন’ সম্পাদনায় হিলালী-ই ছিল আমার প্রধান সহযোগী। ছিল আরও কয়েকজন প্রতিভাদীপ্ত তরুণ ? আনোয়ার ইকবাল, রেজাউল হাসান, আলমগীর মনজুর, আকবর কবীর। রণাঙ্গন-এ আমার নাম ছাপা হয়েছে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে।
১৯৭৩ সালে টাঙ্গাইলের বরেণ্য রাজনীতিবিদ শামসুর রহমান খান শাহজাহানের উদযোগে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সংকেত। সম্পাদনার দায়িত্ব তিনি অর্পণ করেন আমার ওপর। পত্রিকার প্রকাশ উপলক্ষে শুভেচ্ছাবাণী পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আবদুল মান্নান।
সাপ্তাহিক সংকেত ছাপা হতো কল্লোল মুদ্রায়ন-এ। ওই প্রেসে তখন মওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক হক-কথা-ও ছাপা হতো। রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তখন “হক-কথা”য় আমি ‘আওরঙ্গজেব চৌধুরী’ নামে লিখতাম আন্তর্জাতিক বিষয়াদি নিয়ে। মনে পড়ে বায়াফ্রা’য় দুর্ভিক্ষ ও ভারত মহাসাগরে পরাশক্তির রণসজ্জা সম্পর্কে দু’টি লেখার কথা।
টাঙ্গাইলের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাসে এ দু’টি সাপ্তাহিকেরই রয়েছে গৌরবজনক ভূমিকা। এজন্য হক-কথা-র পাশাপাশি সংকেত-এর নামও সমমর্যাদায় উচ্চারণ করা উচিত বলে আমি মনে করি। সেই সঙ্গে বিশেষ সম্মান সহকারে তুলে ধরা উচিত শামসুর রহমান খান শাহজাহানের অবদানের ইতিহাসটি। সেদিন সংকেত-এ শিক্ষানবিশি করে অনেকেই পরে কেরিয়ার গড়ে তুলতে পেরেছেন জাতীয় পত্রপত্রিকায়। দু’-একজন তা স্বীকার না করলেও প্রকৃত সত্য আড়াল হবে না কোনও দিন।
স্বাধীনতার পর টাঙ্গাইলে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল “ধানসিঁড়ি”। এ সংগঠনের নেতৃত্বে ছিল আনোয়ার ইকবাল, রেজাউল হাসান, আলমগীর মনজুর, রহিমা সিদ্দিকী প্রমুখ। ওদের সঙ্গে আমিও যুক্ত ছিলাম ওতপ্রোতভাবে। আরও একজন তখন বিশেষ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ধানসিঁড়ি-র। তিনি টাঙ্গাইলের তৎকালীন জেলার ও খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন (১৯১৭-১৯৮১)। তাঁর লেখা উপন্যাস “অবাঞ্ছিত” (১৯৫০), “কি পাইনি” (১৯৫২), “মোহমুক্তি” (১৯৫৩) এক সময় ছিল পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে। টাঙ্গাইল থাকতে তিনি লিখছিলেন “নতুন পৃথিবী” নামের একটি উপন্যাস। পরে, ১৯৭৪ সালে, প্রকাশিত হয়েছিল এটি।
১৯৭৬ সালে টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের মাধ্যমে উদযোগ নেয়া হয় “টাঙ্গাইল সমাচার” নামে এক পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশের। উদযোক্তা ছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক শেখ হাবিবুল্লাহ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবদুল আউয়াল ও জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী (পরে মহকুমা প্রশাসক) অরবিন্দ কর (সাবেক বিদ্যুৎ সচিব)। আমার ওপর এসে পড়ে সম্পাদনার দায়িত্ব। তখন কবি ও সাংবাদিক আবু কায়সার বেকার অবস্থায় দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছিলেন টাঙ্গাইলে। আমি সম্পাদনার দায়িত্ব তাঁকেই দিতে অনুরোধ করি। আমার এ অনুরোধ রক্ষা করে প্রশাসন। এরপর উপদেষ্টা হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন করি “টাঙ্গাইল সমাচার”-এর।
সাযযাদ কাদিরঃ সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।।