ইউ স্যাটআপ! তোমাকে চিনি, তোমার সম্পাদককেও চিনি…
কোন আমলেই সাংবাদিক হত্যা বা নির্যাতনের বিচার হয়নি, হয়নি এ পেশার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করাও। অথচ বলা হয়ে থাকে সাংবাদিকরা জাতির দর্পন। তারা জাতির ভালো মন্দ শাসকদের কাছে তুলে ধরবে। এই বলা কথাটুকুর জন্যই হয়তো এই সাংবাদিকরা সব সময় ঝুকি নিয়ে কাজ করে থাকে। আর তাদের উপরে সব সময় শাসক গোষ্ঠীর কালো হাত লেগেই থাকে। সেই ১৯৭১ সালে যেমন পাক হায়েনারা সাংবাদিকদের উপর কালো হাতের আঁচড় দিয়েছিল; একাত্তরের পর মুক্তিযোদ্ধারাও কম যাননি। ইতিহাসের আয়নায় মুখ রাখলে দেখা যাবে যে, দেশ স্বাধীন হবার পরে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এ জাতি যখন নতুন করে বাচাঁর বীজ বপন করেছিলো। সব কিছুই চলল ঠিক ভাবে। কিন্তু এ চলার পথে বাঁধা আসল। ১৯৭৪ সালে কোন কালো মানুষের পরামর্শে বঙ্গবন্ধু দেশে ২২২টি পত্রিকা বন্ধ করে দেন। আর ৪ টি পত্রিকা চালু রাখেন। সে সময় পত্রিকা বন্ধ করে দমে যাননি সাথে সাথে পত্রিকা সম্পাদকদেরকেও গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হল ,গনকন্ঠ পত্রিকার সম্পাদক আল মাহমুদ , সাপ্তাহিক হক কথার সম্পাদক মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানি সহ আরো অনেকে। সেই ভয়ংকর সময় অনেক সাংবাদিক গণ না খেয়ে দিন যাপন করেছেন,আবার কেউ মুদি দোকান দিয়েছেন। সেই থেকে সাংবাদিক দের ওপর দমন পীড়ন শুরম্ন করে আজও তা বন্ধ হয়নি। এরশাদ আমলে বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিক রেহমানকে দেশামত্মর হতে হয়েছিল। বিএনপি যখন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে প্রথম ক্ষমতায় আসলো সে সময় সাংবাদিকদের দমন নিপীড়ন চলে। সে সময় এর একটিরও বিচার হয়নি। ১৯৯৬ থেকে ২০১২ পর্যমত্ম অনেক সাংবাদিক নিহত হয়েছে। এর একটিরও বিচার আমরা পাইনি। একটি হত্যা কান্ড ঘটলে আমরা কিছু দিন প্রতিবাদ করি আবার একটি ঘটনা ঘটলে সেই ঘটনাটি ধামা চাপা পড়ে যায়। ইতিহাসের আয়নায় আমাদের অতিত ছিল এমন যে, আওয়ামী লীগের আমালে সাংবাদিক হত্যা (১৯৯৬-২০০০), ১.১৯৯৬ সালের ৮ জুন সাতক্ষীরার পত্রদূত সম্পাদক শ.ম আলাউদ্দীন খুন হন। ২.১৯৯৮ সালের ৩০ আগস্ট যশোরের দৈনিক রানার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল খুন হন। ৩.২০০০ সালের ১৬ জুলাই দৈনিক জনকন্ঠের যশোর প্রতিনিধি শামছুর রহমান কেবল তার কার্যালয়ে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন। বিএনপি জামাত জোট সরকারের আমলে সাংবাদিক হত্যা (২০০১-২০০৬), ১. ২০০৪ সালের ২ মার্চ কেরানীগঞ্জে দি নিউ এজের সাংবাদিক আব্দুল লতিফ পাপ্পু নিহত হন; ২. ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারী খুলনা প্রেসক্লাবের সামনে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় নিহত হন দৈনিক সংবাদের খুলনা ব্যূরো প্রধান এবং প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মানিক সাহা। ৩. ২০০৪ সালের ২৭ জুন নিজের অফিসে নিহত হন খুলনার দৈনিক জন্মভূমির সম্পাদক হুমায়ূন কবির বালু; ৪. ২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক দুর্জয় বাংলার নির্বাহী সম্পাদক দীপাংকর চক্রবর্তী নিজ বাসায় নিহত হন; ৫. ২০০৪ সালে আরো খুন হন দৈনিক সংগ্রামের খুলনা প্রতিনিধি বেলাল হোসেন; ৬.২০০৫ সালেল ২৯ মে কুমিলস্নার দৈনিক মুক্তকন্ঠের রির্পোটার গোলাম মাহমুদ নিহত হন; ৭. ঠিকাদারী চক্রের বিরম্নদ্ধে লাগাতার রিপোর্ট করে ২০০৫ সালের ৫ নভেম্বর দৈনিক সমকালের ফরিদপুর ব্যূরো প্রতিনিধি গৌতম দাস খুন হন। অন্যদিকে বিএনপির পাষন্ড সরকারের সময় যেভাবে সাংবাদিকদের উপর কালো হাত নেমে এসেছিল; ঠিক সেভাবেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাংবাদিক হত্যাসহ বিভিন্ন নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। ২০০৯-২০১২, এই সময়ের ঘটনাগুলো হলো- ১. ২০১১ সালের ২৮ জানুয়ারী পল্টনের নিজ বাসায় খুন হন প্রবীন সাংবাদিক দৈনিক জনতার সহ-সম্পাদক ফরহাঁদ খাঁ ও তার স্ত্রী রহিমা খাতুন; ২.২০১২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী নিজ বাসায় খুন হলেন এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরেম্নন রুনি ও মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার; ৩.২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ কুকরাইল এলাকায় গলা কেটে হত্যা করা হয় দৈনিক ভোরের ডাকের গোবিন্দগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম রঞ্জুকে; ৪. ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল ঢাকার উত্তরা ও চট্টগ্রামর পোর্টকলোনিতে খুন হয়েছেন ২ সাংবাদিক; ৫. ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের পোর্টকলোনি এলাকায় দৈনিক আজকের প্রত্যাশা, সাপ্তাহিক সংবাদচিত্র ও আজকের সূর্যোদোয় পত্রিকার সাংবাদিক মাহবুব টুটুলকে হত্যা করা হয়েছে; ৬. ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কে ১০ নম্বর বাসার বাসিন্দা সাপ্তাহিক বজ্রকন্ঠের সাংবাদিক আলতাফ হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়; ৭. ২০১০ সালের ৯ মে গুপ্তহত্যার শিকার হন বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার সিনিয়র ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম টুটুল; ৮. ২০১০ সালের ২৮ এপ্রিল খুন হন বিশিষ্ট সাংবাদিক সাপ্তাহিত ২০০০ এর সিলেট প্রতিনিধি ফতেহ ওসমানী; ৯. ২০১০ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে দিবালোকে খুন হন বরিশালের মুলাদী প্রেসক্লাবের সভাপতি মনির হোসেন রাঢ়ী; ১০. ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকায় খুন হন এনটিভির ভিডিও এডিটর আতিকুল ইসলাম আতিক; ১১.২০০৯ সালের জুলাই মাসে ঢাকার পাক্ষিক মুক্তমনের স্টাফ রিপোর্টার নুরুল ইসলাম ওরফে রানা খুন হন; ১২.২০০৯ সালের আগস্ট মাসে গাজীপুরে ঢাকার সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক সময় এর নির্বাহী সম্পাদক এমএম আহসান হাবিব বারি; ১৩. ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে রূপগঞ্জে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার সংবাদদাতা ও রূপগঞ্জ প্রেসক্লাবের সহসভাপতি আবুল হাসান আসিফ খুন হন। এত জীবন এত রক্ত দেয়ার পরও সাংবাদিক সমাজ কোন হত্যাকান্ড বা নির্যাতনের বিচার আজ অবধি পায়নি। বরং যা পেয়েছে তা হলো হতাশা-যন্ত্রণা আর দারিদ্রতার নির্মম আঘাত। তবুও যখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকতা করছেন তারা তখন সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের কাছ থেকে জোটে অপমান আর হুমকি-ধামকি। এÿÿত্রে আইনজীবি হয়েও যারা সরকার দলের নেতাকর্মী; তাদের উচ্চারণ শুনে শুধু সাংবাদিক মহল-ই নয় হতবাক হয়ে যায় টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যমত্ম প্রতিটি সচেতন মানুষ। বিশেষ করে ‘সাংবাদিককে ধমকালেন আ.লীগ নেতা’ শিরোনাম দেখার পর কোন সভ্য মানুষ, সচেতন মানুষ আর নরব থাকতে পারে না; যেমন পারিনি আমি। সংবাদ শিরোনামের সূত্র ধরে ভেতরে প্রবেশ করতেই উঠে আসে-‘‘ইউ স্যাটআপ! আমি তোমাকে চিনি, তোমার সম্পাদককেও চিনি।’ বরিশালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমন উপলক্ষে ১৪ দলের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিককে এভাবেই ধমক ও হুমকি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। নগরের বরিশাল ক্লাব মিলনায়তনে সাংবাদিকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের ওই নেতা বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক ইত্তেফাকের ব্যুরোপ্রধান লিটন বাশারকে এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বক্তব্য দেওয়ার সময় লিটন বাশার জানতে চান, ‘আমাদের আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় নাকি সংবাদ সম্মেলনে ডাকা হয়েছে।’ এই প্রশ্ন শুনে তিনি উপরোক্ত কথা বলেন। সাংবাদিকেরা এই ঘটনার প্রতিবাদ করলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং মহানগর আওয়ামী লীগের আহবায়ক ও সিটি মেয়র শওকত হোসেন সাংবাদিকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং বিষয়টি ভুলে যাওয়ার অনুরোধ করেন।’ এই হলো সরকার দলীয় আইনজীবি- নেতা কাম সাংবাদিক। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলির সদস্য হওয়ার পাশাপাশি পয়সা কামানোর জন্য হয়ে আছেন বাংলাদেশ সরকারের পরিচালিত সংবাদ সংস্থা বাসসের চেয়ারম্যানও। শুধু এখানেই শেষ নয় তিনি সাংবাদিক পেটানোর জন্য জন্ম দিয়েছেন আওয়ামী শিশু-যুব সাংস্কৃতিক জোট নামক একটি সংগঠনও। যে সংগঠনটি ক’দিন আগেও ছিল শিশু-যুব সাংস্কৃতিক জোট। সংগঠনের পর সংগঠন তৈরি করে সেই সব সংগঠনের অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বিরম্নদ্ধে একের পর এক বিষদগার করে যাচ্ছেন; যা বিভন্ন সংবাদপ্রত্রের পাতায় চোখ রাখলেই দেখা যায়। অথচ আমরা আমাদের আলোকিত সময়ের সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রম্ননি হত্যাকান্ডের বিচার পাইনি; বিচার পাইনি এই সরকারের সময় সংগঠিত সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ দম্পতি হত্যান্ডেরও বিচার। বিএনপি-জামায়াত জোট অথবা আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে আমরা যা পেয়েছি, তা হলো হত্যা-হুমকি আর নিরাপত্তাহীন জীবন। যার প্রমাণ প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তিনিতো বিশাল অনুষ্ঠান বিশাল কন্ঠে উচ্চারণ-ই করেছেন, ‘বেডরম্নমের নিরাপত্তা সরকার দিতে পারবে না।’ কি আর করা আমাদের-সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা না পেলেও প্রধানমন্ত্রী- প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার জন্য গর্ভবতী মায়ের নিদারম্নণ চিৎকার শুনতে থাকি ইস্কাটনের মোড়ে, শাহবাগ অথবা বঙ্গ ও গণ ভবনের কাছাকাছি কোথাও আটকে থাকা এম্বুলেন্সে; আর প্রার্থণা করতে থাকি, প্রভু বলে যদি তুমি থেকেই থাকো আগত সমত্মানকে সুস্থ রেখো, ভালো রেখো আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত বা সাংবাদিক নয় মানুষ হওয়ার জন্য… মোমিন মেহেদী : কলামিস্ট ও মেয়র প্রার্থী, ঢাকা দÿÿণ সিটি কর্পোরেশন Email:mominmahdi@gmail.com; website: www.mominmahadi.com