ঝিলমিলের প্লট বনাম সাংবাদিক মর্যাদা
রাজধানী উন্নয়ণ কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে প্লট দেয়ার লক্ষ্যে লটারির মাধ্যমে সাধারণ আবেদনকারীদের ফলাফল ঘোষণা করেছে। বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় সংলগ্ন এ প্লটে তাদের ৫২০টি প্লট দেয়া হবে। প্রকল্পে পস্নট ১২০০টি। এরমধ্যে ১০ শতাংশ সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। শুধু মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-সংসদ সদস্য ও বিচারপতি শ্রেণীতে আবেদনকারী সকলকে প্লট দেয়া হবে। আইনজীবী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ ও সাংবাদিক এ শ্রেণীর বরাদ্দ দেয়া হবে পরে ।
তথ্য ও প্রযুক্তির বর্তমান দুনিয়ায় দ্বিতীয় রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত সংবাদপত্রে কর্মরতদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা হচ্ছেন রিপোর্টার ও সাংবাদিকরা। সাংবাদিকরা দেশ ও সমাজের মধ্যমনি এবং প্রাণশক্তি। যে সাংবাদিকদের পণ্য দিয়ে দেশের সকল জনগণের মধ্যে তথ্যের সেতুবন্ধন রচিত হয় সেই সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা বাংলাদেশে বেশ উপেক্ষিত। সদ্য প্রয়াত স্বপ্নবাজ মেধাবী সাংবাদিক মিনার মাহমুদের শেষ লেখায়ও তা স্পষ্ট। স্ত্রী লাজুকের কাছে ৫ পৃষ্ঠার চিঠিতে তিনি বলেছেন, তিনি সর্বহারা, কিছু নেই তার, তিনি শুধু একজন মানুষ। নির্ভীক সাংবাদিকতার আধুনিক ধারা বিনির্মাণে সমাজকে তিনি শুধু দিয়েই গেছেন। অথচ কি নিষ্ঠুর জাতি আমরা, বিলেত ফেরত মিনারকে দেইনি একটি কর্মের আশ্রয় কিংবা ঠিকানা। মিনারের আত্নহননকে মৃত্যু বলি কিভাবে ? সাগর-রুণির মতো তাকেও আমরা হত্যা করেছি।
ঝুঁকিপূর্ণ এ পেশায় আমাদের দেশে সাংবাদিকদেরদের কোনো নিরাপত্তাই নেই। সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রশাসন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কর্মী, সন্ত্রাসী, মাস্তান, প্রভাবশালীদের হাতে নিগৃহীত এবং নির্যাতিত হতে হয় এ আর নতুন বিষয় নয়। সত্য প্রকাশে অবিচল এ দৃষ্টিভঙ্গীর সাংবাদিকরা আর যাই হোক বর্তমান স্বার্থবাদী সমাজ ব্যবস্থায় কারো বন্ধু হতে পারেন না। দিনের বেশির ভাগ সময় রোদ, বৃষ্টি, শীত, বৈরি আবহাওয়া এবং পথঘাটের নৈরাজ্য ও দুর্যোগ উপেক্ষা করে সংগৃহীত সংবাদ সারাদেশের মানুষের কাছে উপস্থাপন করেন সাংবাদিকরা। অথচ এ সংবাদকর্মীদের নেই আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা।
স্বাধীন বাংলাদেশের ৪০ বছরে সংবাদপত্র শিল্পের প্রসার বেশ বিসত্মৃত হলেও পেশাদারিত্ব এবং আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি এখনো অসম্পূর্ণই বলা যায়। দেশের বড় বড় কর্পোরেট গ্রুপগুলোর অধিকাংশই মিডিয়া ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। নতুন নতুন দৈনিক বেরুচ্ছে। টিভি চ্যানেল হচ্ছে। অনলাইন সংবাদপত্র এবং সংবাদ এজেন্সীর আধিক্যে বাজার সয়লাব। কিন্তু হাতেগোনা ৫/৬টি হাউজ ছাড়া প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার ক’টি প্রতিষ্ঠান সাংবাদিকদের নিয়মিত বেতন ও অন্যান্য ভাতা দেয় ? দেশের ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির বর্তমান অর্থনীতিতে একজন সাংবাদিককে নিদিষ্ট অংকের ওপর খুব কষ্ট করেই মাস চলতে হয়। সংসারের কোনো বাড়তি খরচ ছাড়াও সাংবাদিককে প্রায় সময়ই সহকর্মী বা অন্য কারো কাছে ঋণগ্রস্ত থাকতে হয়। আমাদের বিলাস বলতে কিছু নেই। উচ্চমূল্যের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বাজার সামাল দিতে গিয়ে যেখানে নাভিশ্বাস সেখানে ব্যস্তময় সাংবাদিকদের পারিবারিক জীবনে বিনোদন যেন হারিয়ে গেছে। কেননা অর্থের কাছে আনন্দ পরাভূত।
ঢাকার বাড়ীওয়ালাদের কাছে সাংবাদিকরা ভাড়াটিয়া হিসেবে অনেকটা উপেক্ষিত। সাংবাদিকরা আইন-কানুন এবং শৃংখলার মধ্যে জীবন যাপন করতে অভ্যস্থ। অগ্রিম প্রদান এবং মাসের ১০ তারিখের আগে ভাড়া দেয়ার শর্ত পরিপালনে অসমর্থ বলেই বাড়ীওয়ালাদের কাছে অপচ্ছন্দের মানুষ আমরা। তাছাড়া ছ’ মাস বা ফি বছর বাসা ভাড়া বৃদ্ধির যৌক্তিকতা, বাসস্থানের নানান কাজের মেরামত নিয়ে প্রশ্ন তোলা এসব বিষয় তাদের অপচ্ছন্দ। তাছাড়া সচেতন বলে ভাড়াটিয়া হিসেবে সাংবাদিকদের ভয় পান অধিকাংশ বাড়ীওয়ালা। এ তো গেলো আমাদের সামাজিক অবস্থান।
বিশ্ব বসতি দিবস উপলক্ষে গেলো বছর একটি বেসরকারি সংস্থার জরীপে উপস্থাপিত পরিসংখ্যানে দেখা যায় রাজধানীর প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৩৬ হাজার লোক বাস করে। যা দেশের সমগ্র জনসংখ্যার ঘনত্বের ৩৫ দশমিক ২০ গুন। প্রায় দেড় কোটি বিশাল জনগোষ্ঠীর এ মেগাসিটিতে ১৭ শতাংশের রয়েছে নিজস্ব বাড়ী বা আবাসস্থল, ১৪ শতাংশ বস্তিতে, ১৫ শতাংশ থাকেন চাক্রিসূত্রে বরাদ্দকৃত কলোনীতে, ৩৪ শতাংশ ভাড়াবাড়িতে বসবাস করেন। বাকী ২০ শতাংশ মানুষ রাজধানীতে ভাসমান।
কসমোপলিটন মহানগরে সারি সারি আকাশচুম্বী সুউচ্চ ইমারতে আমাদের ঠাঁই নেই। পেশা হিসেবে সাংবাদিকতার আর্থিক নিরাপত্তা জোরদার না হওয়ায় ঢাকা শহরে ৯৫ শতাংশ সংবাদকর্মীর নিজস্ব আবাসন নেই। আর মহানগরে বসবাসকারীর মধ্যে ৯৮ শতাংশ সাংবাদিককে বাস করতে হচ্ছে ভাড়াবাড়িতে। সাংবাদিকদের তীব্র এ আবাসন সমস্যার একমাত্র সমাধান দিতে পারে সরকারি খাস জমি কিংবা রাজউকের আবসিক প্রকল্প। তাই সাংবাদিকদের কাছে সুলভ মূল্যের নিষ্কণ্টক জমির চাহিদা থাকবেই।
শোনা যাচ্ছে সাংবাদিকদের জন্য রাজউক ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে মাত্র ২০টি পস্নট বরাদ্দ দেবে। সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের দাবী কমপক্ষে ১২০টির।
মহামান্য বিচারক, মাননীয় মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই রাজউককে বলছি সাংবাদিকদের এ ক্ষেত্রে অবহেলা করা হবে কেন ? সার্বক্ষণিক দেশ ও রাষ্ট্র সেবায় ব্রত মহান সাংবাদিকতা পেশার প্রার্থীদের কি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-সংসদ সদস্য ও বিচারপতি শ্রেণীর মর্যাদায় ফেলা যায় না ? ইচ্ছে করলে সরকার ও রাজউক সেটা করতে পারে। গৃহায়ন ও পূর্ত মন্ত্রী সাংবাদিকদের নিরাপত্তায় ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনা করবেন কি ? আর সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তাহীন সাংবাদিকরা চোখ রাঙানো ঢাকার বাড়ীওয়ালাদের শেকল থেকে কবে পরিত্রাণ পাবে ?
লেখকঃ অর্থনীতি বিষয়ক সাংবাদিক
reporterpranab@gmail.comর্