সুনীলকে খুব মনে পড়ে…
সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় সাংবাদিকদের লেখা-লেখির জোরে ল্যাব এইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার চিকিৎসার ভার নিয়েছে। তারা বলেছে, আমার আমৃত্যু চিকিৎসার ভার তাদের। ২০০৩ সালে আমার ব্রেইন স্ট্রোক হয়। সেই অসহায় মুর্হুত্বে আমার পাশে একজন এগিয়ে এসেছিলো। আর সেই একজন হচ্ছে সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জি। ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর দীর্ঘদিন আমার কোন জ্ঞান ছিলো না। আমাকে অবচেতন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো সিঙ্গাপুরে। সিঙ্গাপুরে প্রায় ২ মাস চিকিৎসা শেষে যখন দেশে ফিরলাম, তখন জানতে পারলাম সুনীলের কলমের জোরেই আমাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিলো। সে প্রতিদিন জনকন্ঠে আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন লিখত। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের বিবৃতি সংগ্রহ করেছে সে। আমাকে বাঁচানোর যেন মূল দায়িত্ব হয়ে গিয়েছিলো সুনীলের। ২০০৩ থেকে ২০১২। মাত্র ৯ বছরের ব্যবধান। কতো কিছু পাল্টে গেছে এই ৯টি বছরে। সুনীলের মৃত্যুর প্রায় ৬ বছর অতিক্রম করতে চলেছে। বিছানায় শুয়ে আজ সুনীলের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। আজ সুনীলের জন্মদিন। সুনীলের জন্মদিনে তাঁর আত্নার শান্তি প্রার্থনা করছি।
স্বাধীনতা পরবর্ত্তী সময়ে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় আমার সাথে পরিচয় হয় সুনীল ব্যানার্জির। সাতক্ষীরার ফুটফুটে এক তরুণের সাহসী, লোমহর্সক লেখা গুলো এক কথায় আমাকে মুগ্ধ করতো। ক্রমেই সুনীলের সাথে আমার সর্ম্পক গাঢ় হয়। কিন্তু সুনীল যে আমাকে এতোটা ভালোবাসতো সেটা ছিলো আমার ধারণার বাইরে। আমার অসুস্থ্যতার পর আমি আবিস্কার করলাম সুনীল আমাকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে ভালোবাসতো। আমি সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে আসার পর প্রতিদিন সুনীলের একটি ফোন পেতাম। ‘‘নির্মলদা শরীর এখন কেমন?’’ কথাটায় জড়িয়ে থাকতো আন্তরিকতা আর গভীর ভালোবাসার পরশ। সে সবই আজ স্মৃতি। স্মৃতি বড়ই বেদনাময়। সুনীলের কথা আমি একটি মুর্হুত্বের জন্যও ভুলে থাকতে পারি না। প্রায়ই সুনীলের কথা ভেবে চোখের জলে বুক ভাসাই। বিশেষত, সুনীলের জীবনের শেষ দিনগুলোর কথা মনে তীব্র বেদনার সঞ্চার করে। এসব কথা আমি একাধিক জাতীয় দৈনিকের কলামে লিখেছি; তাই সুনীলের সেই দুঃসহ স্মৃতির পুণরাবৃত্তি আজ আর লিখতে ইচ্ছে করছে না। দুই একটি পত্রিকা ছাড়া এমন কোন জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক নেই, যিনি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, সুনীল ব্যানার্জির জন্য তারা আমাকে আশ্বস্ত করেননি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই, সুনীলের জন্য কেউ কথা রাখেনি। সারা জীবন যে মানুষটি নিঃস্বার্থ ভাবে পরোপকার করেছে, সেই মানুষটির পরিবারের অবস্থা আজ কেমন, সে খবর রাখেন ক’জন? সুনীলের সুসময়ে বন্ধুর কোন অভাব ছিলো না। কিন্তু আজ? আজ কোন এক মরিচীকায় সেসকল বন্ধু কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সুনীলের একমাত্র পুত্র শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ চট্রগ্রামে মেডিকেল কলেজে পড়তো। নানান পারিপার্শ্বিক কারণে তার ডাক্তারী পড়া আর হয়নি। ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে, সুনীলের পুত্র শুভাশিসকেও আজ সাংবাদিকতা পেশায় নাম লেখাতে হয়েছে। শুভাশিসের লেখা-লেখির হাত ভালো। আমি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের কলামে তার লেখা পড়েছি। তার লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে, আমি যেন আরেক সুনীল ব্যানার্জির প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। শুভাশিস দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে চাকরিও করেছে। কিন্তু কোথাও তার মেধার মূল্যায়ন হয়নি। ২০০৭ সালে সুনীলের স্ত্রী ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছে। তাকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানো প্রয়োজন। কিন্তু সেটা শুভাশিসের কাছে দুরূহ সমস্যা। সে তার মায়ের চিকিৎসার জন্য আকাশ-পাতাল দৌড়-ঝাপ করছে। কিন্তু দৃশ্যত কোন লাভ আজও হয়নি। কি পাপ এই ছেলেটির? কোন দোষে আজ তাকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে? একটি ভালো চাকরির আশায় তাকে দুয়ারে দুয়ারে ধরণা দিতে হচ্ছে? আমি ব্যক্তিগত ভাবে আবেদ খানকে সুনীলের পুত্রকে একটি চাকরী দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। তিনি আমার অনুরোধ রাখেন নি। আর রাখবেন-ই বা কেন? আমি অসহায়-পঙ্গু, ঠিকমতো কথা বলতে পারি না, আমার কথা রেখে এদের কোন স্বার্থ উদ্ধার হবে না। আর স্বার্থ ছাড়া আজ মানুষ যে কতোটা অমানুষ তার ব্যাখ্যা সুনীলের পুত্রের কাছে স্পষ্ট। যে বয়সে এই তরুণের চোখ থাকবে স্বপ্নময়, মুখ থাকবে হাসিতে উজ্জ্বল, সেই বয়সে তার চোখে-মুখে বিষন্নতার ছাপ, মনে হতাশা আর ক্ষোভের জ্বালা। জনকন্ঠে সুনীলের টাকা পাওনা আছে, যা জনকন্ঠ কর্তৃপক্ষ আজও তাঁর পরিবারকে বুঝিয়ে দেয়নি। এই হচ্ছে আমাদের দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মানসিকতার পরিচয়। সুনীলের বাড়িটি নিয়েও রয়েছে সমস্যা। এই সমস্যা নিয়ে অনেক দেন-দরবার, মামলা-মকদ্দমা হয়েছে। কিন্তু সরকারের বরাদ্দপ্রাপ্ত বাড়িটির সুষ্ঠু কোন সুরাহা আজও হয়নি। এ ব্যাপারেও সরকারের কাছে আমি আবেদন করেছিলাম, কিন্তু ফলাফল শূণ্য!
পরিশেষে আমি বলতে চাই, আমি আমার জীবনে সুনীল ব্যানার্জির মতো তীক্ষ্ণ সাংবাদিক আর দেখিনি। সুনীল দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলো। বিসিএস পাশ করেও পুলিশের চাকরিতে যোগ না দিয়ে সে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলো। সুনীলের পরিচিতির গন্ডি ছিলো বিস্তৃত। যে রিপোর্ট কেউ লিখতে পারতো না সেই রিপোর্ট সুনীল লিখত। দুর্নীতি-সন্ত্রাস, সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং সমাজের বিভিন্ন অপকর্মের চিত্র সুনীল নিখুঁত ভাবে তাঁর লেখায় ফুটিয়ে তুলতে পারতো। কোন প্রতিবাদের ভয় না করে স্পষ্ট ভাবে আমি বলতে পারি সুনীল ব্যানার্জির মতো ব্যক্তি বা সাংবাদিকরা প্রতি নিয়ত সৃষ্টি হয় না। ২০০৬ সালের একুশে গ্রন্থ মেলায় সুনীলের একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছিলাম আমি। বইটির নাম সাংবাদিকতায় বিড়ম্বনা। কেউ যদি আমার বক্তব্যের চ্যালেঞ্জ করতে চান, তাহলে তারা সাংবাদিকতায় বিড়ম্বনা বইটি পড়বেন। এখন পত্রিকায় চোখ রাখলেই প্রতিদিন কোথাও না কোথাও সাংবাদিক নির্যাতনের খবর দেখি। সুনীল যদি আজ বেঁচে থাকতো তাহলে, তাকেও এসব খবর লিখতে হতো। সাংবাদিক নির্যাতনের খবর যখন দেখি, তখন ভাবি বিখ্যাত সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জিও কি নির্যাতনের শিকার নয়? তাঁর পরিবারটিও কি আজ এই বিভীষিকার বাইরে?
নির্মল সেনঃ প্রবীন কলামিষ্ট ও রাজনীতিক।।