সংবাদশিল্পের সন্ধানে…..
সাযযাদ কাদিরঃ সংবাদ আমাদের সবসময়ের সঙ্গী। আমরা নিঃশ্বাস নেই সংবাদে, আমরা বাঁচিও সংবাদে। আমাদের জীবন-সংসার চলন বলন ভাবনা সবই সংবাদময়। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত অসংখ্য সংবাদে ডুবে থাকি আমরা সবাই। আমাদের আবেগ আগ্রহ আকাঙক্ষা সবই সংবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমাদের সকলের দেখা শোনা চেনা জানা, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে যা কিছু সবই সংবাদবিজড়িত। যখন কথা বলি বা শুনি – সামনাসামনি বা সেলফোন-টেলিফোনে তখনও আদানপ্রদান করি সংবাদের। তারপর আছে কত শত সংবাদমাধ্যম। রেডিও, টেলিভিশন, ইনটারনেট, সেলফোন, সংবাদপত্র। বাংলাদেশী শ্রোতাদের জন্য সংবাদবিশ্ব উন্মুক্ত হয়ে গেছে তথ্যপ্রযুক্তি প্রসারের সঙ্গে-সঙ্গে। রেডিওতে, এফএম ব্যান্ডে সারা দিনই খবর দেশী-বিদেশী নানা চ্যানেল থেকে। টেলিভিশনেও দেশী-বিদেশী অসংখ্য চ্যানেলে ঘণ্টায়-ঘণ্টায় পরিবেশিত হয় সংবাদ। আর আছে আমাদের দুই শতাব্দী প্রাচীন বিশ্বস্ত সঙ্গী সংবাদপত্র। অডিও-ভিসুয়াল মাধ্যমগুলোর বৈপ্লবিক উৎকর্ষে অনেকেই আশঙ্কা করেছেন, এর আকর্ষণ বুঝি যায়-যায়। কিন্তু সে সব আশঙ্কা অমূলকই প্রমাণিত হয়েছে। সংবাদপত্র স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে আছে এখনও। তাই আমরা সংবাদপত্রের চোখ দিয়ে দেখি, তার কান দিয়ে শুনি, তার বিবরণ থেকে বুঝি, এমনকি কথা বলি ও লিখি তার ভাষায়ই। সংবাদপত্রের আকর্ষণ কতখানি তা একটু মজা করেই লিখেছেন প্রখ্যাত মারকিন সাংবাদিক-সাহিত্যিক হেলেন রাওল্যান্ড (১৮৭৫-১৯৫০) -“Before marriage, a man declares that he would lay down his life to serve you; after marriage, he won’t even lay down his newspaper to talk to you.”
এমন তীব্র আকর্ষণের কারণ সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য প্রভৃতির মতো সংবাদও এক শিল্প। সাহিত্যে যেমন ভাব ভাষা নির্মাণ, সংবাদেও তেমন তথ্য ভাষা উপস্থাপন। এ তিনটি ক্ষেত্রে যিনি যত শিল্পিত তিনি তত কৃতী সাহিত্যিক বা সাংবাদিক। সমস্যা একটিই। সেটা বলেছেন বৃটিশ কবি-সমালোচক ম্যাথু আরনল্ড (১৮২২-১৮৮৮) – “Journalism is literature in a hurry.” এই চটজলদি কাজের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সংবাদশিল্প নির্মাণ সহজ নয় কোনও সাংবাদিকেরই পক্ষে। তবে ওই মোকাবেলাটাও এক শিল্প। সে পথে দুই শতকে অনেকখানি পথ হেঁটে এসেছে সংবাদপত্র। তবে আরও পথ হাঁটতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এখন সে হাঁটা-চলা কেমন তা একটু সন্ধান করা যেতে পারে।
গত ২১শে এপ্রিল একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দিলে চালক পুড়ে মারা যান – এ খবরটি পরদিনের এক পত্রিকায় ছাপা হয়েছে এভাবে:
“আট বাসে আগুন / চালক জীবন্ত দগ্ধ… বিএনপির সকাল-সন্ধ্যা হরতালের আগের দিন দুর্বৃত্তরা রাজধানীর খিলগাঁও, গুলিস্তান, আবদুল্লাহপুর, আজিমপুর, ভিক্টোরিয়া পার্ক, মিরপুর ও ফার্মগেট এলাকায় ৮টি বাস আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। এ ঘটনাগুলোর মধ্যে খিলগাঁও খিদমাহ হাসপাতালের সামনে বদর আলী বেগ (৪০) নামের এক চালক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। নিহত বদর আলী ঈগল পরিবহনের একটি বাসের চালক ছিলেন। এছাড়া এসব ঘটনায় ৪জন আহত হয়েছেন। তবে বাসগুলোতে কারা কীভাবে আগুন দিয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে তা জানাতে পারে নি পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। বাস ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের চেষ্টা চালানোর অভিযোগে ৮জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এছাড়া হরতালের সমর্থনে গতকাল বিকালে রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় মিছিল বের করেছে বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এদিকে বিভিন্নস্থানে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক প্রায় যানবাহনশূন্য হয়ে পড়ে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন বাড়ি ফেরা সাধারণ মানুষ। উল্লেখ্য, সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে ‘গুম’ করেছে – এমন অভিযোগে বিএনপি রবিবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে।…”
অন্য এক পত্রিকায় উপস্থাপনা এ রকম:
“রাজধানীতে ৬ যানবাহনে আগুন / ১ জন নিহত… গতকাল শনিবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত রাজধানীর ছয়টি স্থানে ছয়টি বাস-মাইক্রোবাসে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়ার ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তির নাম বদর আলী (৪০)। তিনি বাসচালক। গতকাল দুপুর ২টার দিকে খিলগাঁও, আজিমপুর, গুলিস্তান ও উত্তরার আবদুল্লাহপুরে চারটি বাসে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ফকিরাপুলে আগুন দেয়া হয় সরকারি জনপ্রশাসনের এক মাইক্রোবাসে। এর আগে দুপুরে খিলগাঁওয়ে ঈগল পরিবহণের বাসে দেয়া আগুনে বাসটির চালক বদর আলী জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যান এবং হেলপার মোতালেব আহত হন। ঈগলের বাসটি (যশোর-ব-১১-০০১৯) ঢাকা-খুলনা রুটের। খিদমা হাসপাতালের সামনে ওই বাসটিকে আগুন ধরিয়ে দেয় কয়েকজন যুবক। এ গাড়ির ভেতর থেকেই উদ্ধার করা হয় গাড়িচালক বদরের মৃতদেহ।…”
অন্য আরেক পত্রিকায় খবরটি এসেছে এভাবে:
“বাসে আগুন, দগ্ধ হয়ে চালক নিহত… রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় গতকাল দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত আটটি যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে একটি বাসের চালক নিহত হয়েছেন। দুপুর থেকে একের পর এক বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর রাজধানীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তাঘাট ফাঁকা হতে শুরু করে। বিশেষ করে রাস্তায় দুপুরের পর থেকে যাত্রীবাহী বাসের সংখ্যা কমে যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় অফিস ফেরত নগরবাসীকে। গতকাল দুপুরের পর থেকে রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়িও কম দেখা গেছে। দুপুরে ।াধ ঘণ্টার ব্যবধানে চারটি বাসে দুর্বৃত্তরা অগ্নিসংযোগ করে। এর মধ্যে খিলগাঁও গভর্নমেন্ট কলোনির সামনে পার্কিং করা বাসে আগুন লাগিয়ে দেয়ায় চালক বদর উদ্দিন (৪০) অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ওই বাসের চালকের সহকারী আবদুল মোতালেব। কে বা কারা কি কারণে বাসে অগ্নিসংযোগ করেছে, তা নিশ্চিত জানা যায় নি। তবে পুলিশ দাবি করছে, বিএনপি’র ডাকা হরতালকে কেন্দ্র করেই বাসে আগুন লাগিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে।…”
ইংরেজি একটি পত্রিকায় খবরটি এ রকম:
“Bus was parked, driver asleep… A driver was burned to death and his assistant suffered injuries as their bus was set alight at the capital’s Khilgaon yesterday on the eve of the opposition-called hartal. Nine more buses, including three with passengers, were torched at Mirpur-1 and 10, Baridhara, Azimpur, Abdullahpur Beribadh, Gulistan, Darus Salam, Farmgate and near Bahadur Shah Park, fire brigade officials said. The latest was around 8:15pm. Police identified the ill-fated bus driver as Badar Ali Beg, 48. They took the injured, Abdul Motaleb, 26, to Khilgaon Police Station for interrogation. Motaleb, who suffered burns on his neck and back of his head, told The Daily Star that the two were sleeping on the isle in the afternoon; Motaleb was closer to the doors. Excessive heat woke him up, and seeing fire and smoke, he jumped out of a window. All the doors were locked. For the moment, he had forgotten that Badar was inside, he said. None in the area could say how and by whom the bus was set on fire….”
কোনও রকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়াই আমরা বুঝতে পারি তথ্য, ভাষা ও উপস্থাপনের দিক থেকে প্রকাশিত খবর চারটির শুরু চার রকম। আহরিত ও পরিবেশিত তথ্য প্রায় একই রকম। গাড়িচালকের নাম ও বয়স দু’টি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ভিন্ন। একটি পত্রিকায় আহত আবদুল মোতালেব অনুল্লিখিত। একটি পত্রিকায় স্থানটি সুনির্দিষ্ট করা হয় নি, অন্যান্য পত্রিকায় সুনির্দিষ্ট করা হলেও ভিন্নতা রয়েছে। একটি খবরে প্রাক-হরতাল বিষয়টির উল্লেখ নেই। অগ্নিসংযোগকারীরা দু’টি পত্রিকায় ‘দুর্বৃত্ত’ হিসেবে উল্লিখিত হলেও একটি পত্রিকায় তাদের উল্লেখ করা হয়েছে স্রেফ ‘যুবক’ হিসেবে। উপস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি পত্রিকায় বাসচালকের জীবন্ত দগ্ধ হওয়ার বিষয়টিই গুরুত্ব পেয়েছে অন্যান্য পত্রিকায় গুরুত্ব পেয়েছে রাজধানীর পরিস্থিতি ও হরতাল প্রসঙ্গ। কোনও উপস্থাপনায়ই মর্মান্তিক ঘটনাটির প্রকৃত বেদনা প্রকাশ পায় নি। ভাষায় ক্রিয়াপদের শুধু কথ্য রূপ দেখা যায়, কিন্তু শব্দচয়নে সাধু ভাষার মিশ্রণই বেশি। বাক্যগঠনেও প্রভাব বেশি সাধুরীতির। সংবাদশিল্পের জন্য আমাদের চাই – অল্প কথায় অধিক বলার দক্ষতা। চাই ছোট-ছোট শব্দে ছোট-ছোট বাক্য।
লেখকঃ সাংবাদিক।।