সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কিংবদন্তি শেরে বাংলা’র জন্য…
কিংবদমিত্মর কথা বলছি/ আমি আমার পূর্ব পুরম্নষের কথা বলছি… আমার পূর্ব পুরম্নষের কথা বলতে গেলে বলতেই হবে যে কথা। সে কথা হলো- প্রাক্তন বাকেরগঞ্জ জেলা পূর্ব বাংলায় অবস্থিত ছিলো। যে চারটি কালেক্টরেট নিয়ে ঢাকা বিভাগ বা কমিশনারশিপ গঠিত এটি তারই একটি। গঙ্গা বা পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার সম্মিলিত জলরাশি বাহিত পলিমাটি দ্বারা গঠিত ব-দ্বীপের নিম্নভাগে এ জেলার অবস্থান, আর এটি ২১ ডিগ্রি থেকে ২৩ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯ ডিগ্রি থেকে ৯১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমায় অবস্থিত। সংক্ষেপে এর সীমারেখা হচ্ছে: উত্তরে ফরিদপুর, পশ্চিমে ফরিদপুর ও বালেশ্বর নদী ( এ নদী জেলাটিকে যশোর থেকে পৃথক করেছে), দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং পূর্বে মেঘনা ও তার মোহনা। উত্তর থেকে দক্ষিণে এ জেলার দৈর্ঘ্য হচ্ছে প্রায় ৮৫ মাইল আর দক্ষিণ শাহবাজপুর দ্বীপসহ এর প্রশস্ততা হচ্ছে প্রায় ৬০ মাইল। এর আয়তন হচ্ছে প্রায় ৪,৩০০ বর্গমাইল। বাকেরগঞ্জে ম্যাজিস্ট্রেসি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৭৯৭ সালের রেগুলেশন-৭ অনুযায়ী ওই সালেই সেটিকে জেলা করা হয়। তবে ১৮১৭ সাল পর্যন্ত এটি একটি কালেক্টরেটে পরিণত হতে পারেনি। বরিশাল হচ্ছে প্রধান শহর এবং সেখানেই রয়েছে আদালত ভবন। এটি কলকাতা থেকে প্রায় ১৮০ মাইল পূর্বে অবস্থিত। এ জেলায় গ্রাম ও শহরের সংখ্যা ৩৩১২ টি হবে বলে মনে হয়। ভূমি রাজস্ব হচ্ছে প্রায় ১৩ লাখ ৭০ হাজার রুপি (১৩৭,০০০ পাউন্ড) এবং সব উৎস থেকে প্রাপ্ত মোট রাজস্বের পরিমাণ হচ্ছে ১৬ লাখ রুপি। স্থানীয় প্রশাসনের ব্যয় তিন লাখেরও কম।বরিশাল মেট্রোপলিটন শহরে বসবাসরত জনসংখ্যা ২,১০,৩৭৪ জন। মহানগরীয় অঞ্চলে বসবাসরত জনসংখ্যা ৩,৮৫৩,০৯৩ জন। মোট জনসংখ্যার ৫৩.২৮% পুরুষ এবং নারী ৪৬.৭২%। বরিশালের মোট জনসংখ্যার ৯০.৬৪% মুসলিম, ৮.৩৮% হিন্দু, খ্রিষ্টান ০.৯৮%। মসজিদ এর সংখ্যা ১৫০, চার্চ এর সংখ্যা ৫, মন্দিরের সংখ্যা ২০০-র উপর।বরিশালের চিত্তাকর্ষক স্থানসমূহ হলো: এবাদুলvহ মসজিদ, অশ্বিনী কুমার টাউনহল, দুর্গাসাগর দীঘি, মুকুন্দ দাসের কালিবাড়ী, বিবির পুকুর , গুঠিয়া মসজিদ, মাহিলারা মঠ, ত্রিশ গোডাউন, বঙ্গবন্ধু উদ্যান ইত্যাদি। বরিশাল দক্ষিণ বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা এবং বরিশাল বিভাগের সদর দপ্তর। কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত এ শহরের পুরাতন নাম চন্দ্রদ্বীপ। দেশের খাদ্যশস্য ও মৎস্য উৎপাদনের অন্যতম মূল উৎস বরিশাল। একে বাংলার ভেনিস বলা হয়। বরিশাল দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর। আর এই বরিশালের সমত্মান শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল ঘশ ছিলেন সারা বিশ্বের কাছে ‘বাংলার বাঘ’ হিসেবে পরিচত। কারণ তিনি তাঁর সততার নীতি থেকে কখনোই সরে যাননি। যার ধারাবহিকতায় আজ বাংলাদেশেকে এবং এদেশের রাজনীতিকে জানতে হলে, বুঝতে হলে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে জানতে হয়। কেননা বাংলাদেশের অতীত মানেই শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। উনিশ শতকের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও সংস্কৃতির অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন তিনি। প্রায় সাত দশকের মত সময় ধরে তিনি এদেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যদিয়ে স্বীয় আদর্শ- দর্শন অনুসারে অটল ছিলেন। এজন্য বার বার তাঁকে নানা বাধা-বিগ্ন অতিক্রম করে হয়েছে। কোথাও তিনি আপোষ করেননি। এদেশের ইতিহাস ও তাঁর জীবন আলাদা করা সম্ভব নয়। তিনি হলেন বাংলার অবিস্মরণীয় নেতা। এ বাংলার মানুষ তাঁকে কখনো ভুলবে না। শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের জন্ম ১৮৭৩ সালে ২৬ অক্টোবর। বরিশাল জেলার সাতুরিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে। পিতা কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ এবং মাতা সাইদুন্নেসা খাতুন। পড়াশুনার হাতেখড়ি পিতা-মাতার কাছে। তারপর গ্রাম্য পাঠশালায়। তিনি আরবি, ফার্সি এবং বাংলা ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করেন গৃহ শিক্ষকদের । ১৮৮১ সালে কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ তার সমত্মানকে বরিশাল জেলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করেন। ওই স্কুল থেকে ১৮৮৬ সালে ফজলুল হক অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পান। ১৮৮৯ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ফজলুল হক তৎকালীন ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম হন। প্রবেশিকা পাশ করার পর উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য কলকাতায় যান। ১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ওই কলেজ থেকে ১৮৯৩ সালে তিনি তিনটি বিষয় অনার্সসহ প্রথম শ্রেণীতে বি.এ. পাশ করেন। এরপর ওই কলেজে থেকে ১৮৯৪ সালে এম এস সি’তে (অংকে) প্রথম শ্রেণিতে অর্জন করেন। আজন্মকাল তিনি শিল্প-সাহিত্য চর্চার সাথে যুক্ত ছিলেন। এ সময় তিনি ‘বালক’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এ ছাড়াও যুক্ত ছিলেন আরো কয়েকটি সাপ্তাহিক পত্রিকাতে। ১৮৯৭ সালে তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বি এল পাশ করেন। এরপর তিনি স্যার আশুতোষ মুখাজির্র শিক্ষানবিশ হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে দুবছর শিখানবিশ হিসেবে কাজ করেন। ১৯০০ সালে তিনি নিজেই আইন ব্যবসা শুরু করেন। বাবার মৃত্যুর পর কলকাতা থেকে ১৯০১ সালে তিনি বরিশালের চলে আসেন। বরিশাল আদালতে ওকলতি শুরু করেন। ১৯০৩-০৪ সালে বরিশাল বার এসোসিয়েশনের সহকারী সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময়ই তিনি বরিশাল রাজচন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ ডক্টর হরেন্দ্রনাথ মুখাজির্র অনুরোধে ওই কলেজে অঙ্কশাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯০৬ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন। কিছুদিন ঢাকা ও ময়মনসিংহ কাজ করার পর তিনি জামালপুর মহকুমার এস ডি ও হিসেবে নিযুক্ত হন। বঙ্গভঙ্গের কারণে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা শুরু হয়। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় জামালপুরে দাঙ্গা বন্ধ হয়। সাধারণ মানুষের উপর ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর ও জমিদারদের আমানবিক আচরণের কারণে ১৯০৮ সালে তিনি সরকারী চাকুরী ছেড়ে দেন। ১৯১১ সালে ফজলুক হক কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। কমরেড মুজাফফর আহমেদের প্রস্তাবে ফজলুক হক নবযুগের প্রকাশনাতে সাহায্য করেন। নজরুলের আগুণঝরা লেখার কারণে ‘নবযুগ’ বেশী বেশী করে বিক্রি হতে শুরু করলো। এক পর্যায়ে ‘নবযুগ’ প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যেত। কলকাতা হাইকোটের্র ইংরেজ বিচারপতি টিউনন ফজলুল হককে ডেকে নিয়ে ব্রিটিশবিরোধী লেখার জন্য হুশিয়ার করে দেন। কিন্তু ফজলুল হক ভয় না পেয়ে নজরুলকে বলেন, ‘আরো গরম লিখে যাও’। ব্রিটিশ সরকার ‘নবযুগ’ পত্রিকায় ব্রিটিশবিরোধী লেখার জন্য ওই পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করে। ১৯১২ সালে তিনি কলকাতায় কেন্দ্রিয় মুসলিম শিক্ষা সমিতি নামে একটি শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরপর তিনি বরিশাল পৌরসভার কমিশনার পদে নির্বাচন করে নির্বাচিত হন। ১৯১৩ সালে ফজলুক হক বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৪ সালে ঢাকায় আহসানুলvহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল প্রাঙ্গনে এক অবিস্মরণীয় ভাষণ দেন। এতে সভাপতিত্ব করেছিলেন স্যার সলিমুলvহ। এ দিন ড. মুহাম্মদ শহীদুলvহ তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ফজলুক হক প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯২২ সালে তিনি খুলনা উপনির্বাচনে প্রতিদ্বনি্দ্বতা করে নির্বাচিত হন। ১৯২৪ সালে খুলনা অঞ্চল থকে তিনি পুনরায় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় বাংলার গভর্ণর লিটন ফজলুল হককে বাংলার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। ১৯৪০, ১৯৪১, ১৯৫১ম ১৯৫৩ পর্যমত্ম তিনি বাঘের মত গর্জন করে আদায় করেছেন বাংলা মানুষের অধিকার, লড়েছেন সকল দেশ বিরোধী চক্রের সাথে। শেরেবাংলা সারা জীবন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য ভেবেছেন, যে কারনে আর্থিকভাবে তাঁর আহামরি কোন স্বচ্ছলতা ছিল না। বাংলার আপামর জনসাধারণ তাকে ভালোও বেসেছিল তাই প্রাণের সবটুকু আমত্মরিকতা দিয়ে। যে কারণে আজ শত বছর পরেও তাঁর কীর্তি নয়ে কথা হয়, লেখা হয়, হয় আলোচনা আর আলেখ্য। অবিভক্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা বলেছিলেন, দেশ ও দেশের মানুষ আমার কাছে সবচেয়ে আগে। কেননা আমার রাজনীতি তাদের জন্যই। ১৯৬২ সালের ২৭ জুলাই জীবনের অমিত্মম মূহুর্তের মুখোমুখি হন তিনি। তাঁর একামত্ম সেণহধন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষ্য অনুযায়ী- শেরে বাংলা বাংলাদেশের মানুষের একজন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আর রাজনৈতিক কিংবদমিত্ম। এই কিংবদমিত্ম পুরম্নষের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা শুধু জন্ম বা মৃত্যুর দিনেই নয়, সারা বছর চাই আর তাই প্রয়োজন প্রতিটি ক্লাসের পাঠ্য বএত শ্রেণী অনুযায়ী তার জীবন কথার আলোচনা; পাশাপাশি সরকারের কাছে বিনীত প্রার্থণা শেরে বাংলা’র নাম অনুসারে আমাদের দেশের যে কোন একটি বিমান বন্দরের একটির নাম করন করা হোক…
মোমিন মেহেদী : কলামিস্ট ও মেয়র প্রার্থী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন
Email:mominmahdi@gmail.com; website: www.mominmahadi.com