বৃষ্টি কড়চা ও কিছু অশুভ পরিবর্তন…
স্কুলে পড়া কালে বৃষ্টি দেখলে আটাশ খানা দাঁত সোজা বেরিয়ে পড়তো।. ..
এ কি, প্রথমেই অবিশ্বাসের ভ্রুকুটি কেন? হে হে হে.. ..কি করবো বলুন। দাঁতের মতন সামান্য বস্ত্ত নিয়ে তো আর মিথ্যাচার করা যায় না। বত্রিশ খানা দাঁত আমার কোনো কালেই ছিল না। পিচ্চি কালে ছিল আটাশটা, এই বুড়ো কালে এসে হয়েছে ত্রিশ দশমিক পাঁচটা । (সাড়ে ত্রিশটা দাঁত আমার কোন হিসাবে,সে গল্প আরেকদিন। বড়ই ভেজালে হিসাব।)
যাই হোক, ছোট কালে আটাশ খানা দাঁত(দুটো আবার খরগোশের ইসটাইল) এই খুশিতে বেরিয়ে পড়তো যে বৃষ্টি হলে স্কুল যাওয়া লাগবে না। ছাত্রী ছিলাম ব্যাপক জঘন্য, তার উপরে মাশাল্লাহ গোল একটা ফুটবলের মতন ছিলাম দেখতে। স্কুল নামক বস্ত্তটা তাই আমার জন্যে অন্তত ছিল চরম বিভীষিকাময়। এই দিকে ঘরে ছিল রয়েল বেঙ্গল টাইগার (অর্থাৎ পিতাজান)। তার তর্জন-গর্জনে বাড়িঘরে টেকাই ছিল মুশকিল, স্কুল ফাঁকি দেয়া তো বিরাট দূরের ব্যাপার। কিন্তু বৃষ্টি হলে কারও বলার কিছু নেই, বর্ষার সামনে পিতাজানের গর্জন ধোপে টিকবে না। বৃষ্টির দিন ছিল সেই একমাত্র সময় যখন আমি আর ছোটবোন বীর দর্পে পিতাজানের সামনে নাচানাচি করে বেড়াতে পারতাম। সেই হিসাবে বলা যায়, এই আমারও কোনো এক কালে বৃষ্টি বস্ত্তটি ব্যাপক পছন্দ ছিল।
কিন্তু সব কিছুরই শেষ আছে। বাংলা লিংকের মতন বলতে হয়, সেই দিন কি আর আছে নাকি, দিন বদলাইছে না! যত বুড়ি হচ্ছি, থুক্কু.. ..যত বড় হচ্ছি, বৃষ্টির সাথে শত্রুতা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। তবে বোধহয় শুধু আমার একার নয়, অনেকেরই। যে বাঙালী আকাশে মেঘ দেখা মাত্র খিচুড়ী খাবার প্রস্ত্ততি নিতে শুরু করে,সেই বাঙালীইর মুখখানাই এখন পাংশুটে হয়ে যায় আকাশ থেকে পানি পড়বার সম্ভাবনা দেখলে। হ্যাঁ, বৃষ্টি আজকাল কেবলই আকাশ থেকে গড়িয়ে নামা অনাহুতো পানি। আর হবে নাই বা কেন? আমাদের এই সাধের রাজধানীর অধিকাংশ তলিয়ে যায় ১০ মিনিট বৃষ্টি হলে। টানা আধঘন্টা বর্ষনে জমে হাঁটু পানি। আর পানি জমে তো জমে, কিন্তু নিষ্কষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। ১০ মিনিটে জমে যাওয়া পানি সরতে সময় লাগে ১০ ঘন্টা কমপক্ষে। রাস্তায় রাস্তায় জমে যায় দৈনন্দিন চুইংগাম জ্যামেরও দ্বিগুন দৈঘ্যের জ্যাম, রিকশা-ট্যাক্সির ভাড়া বেড়ে দাঁড়ায় তিনগুণে। আজকাল তো দেখি আকাশ থেকে এক ফোঁটা পানি পড়লো কি পড়লো না, বাজারে মুহুর্তের ব্যবধানে বেড়ে গেলো নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের নাম। কারণ জানতে চাইলে দোকানীর সেই একই নির্বিকার উত্তর- ‘‘সাপ্লাই নাই’’।
এমন অবস্থায় ঢাকা বাসীর যদি বৃষ্টির সাথে শত্রুতা হয়েই যায়, তবে তাতে দোষটা কোথায় বলুন? যেভাবে চলছে, তাতে অচিরেই বৃষ্টির প্রতি এই বিতৃষ্ণা পরিণত হবে বাঙালরি জীবনের খানদানী শত্রুতায়। বৃষ্টি সম্ভাবনায় তখন আর বাড়ি বাড়ি থেকে মাছ ভাজা-বেগুন ভাজার গন্ধ আসবে না, খিচুড়ীর পাতে উঠবে না আচার, দফায় দফায় চা চলবে না বন্ধু বান্ধবের আড্ডায়। এমনকি বর্ষার প্রথম কদম হাতে কোনো প্রেমিক যাবে না পছন্দের মেয়েটির সামনে, কোনো প্রেমিকা নীল সাড়ি পরবার বিলাসিতা করবে না ভালোবাসার পুরুষটির জন্যে। বৃষ্টির জলে মন ভিজিয়ে কবিরা বুনবেন না শব্দের পরে শব্দ, গল্পকারেরা ভুলে যাবেন জলে ভেজা প্রেম কাহিনী লিখতে। মাঝে মাঝে তো মনে হয়, এমন এক সময় আসবে যখন বৃষ্টি দেখে ময়ূরের দলও পাগল হবে না, বরং নাচানাচি ভুলে হাই তুলবে ঘনঘন।
সময়ের সাথে সাথে আরও কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ছে আমার। এবং সম্ভবত আপনাদেরও। এবং আমার মনে হয় সেই পরিবর্তনটি ভীষণ ভীষণ অশূভ। খুন-জখম-ধর্ষণ-নির্যাতন এ সমস্তই আমাদের এই পোড়া সমাজ ব্যবস্থায় নতুন কিছু নয়। বরং এতটাই দৈনন্দিন এই সকল যে সংবাদপত্র খুলে এ সমস্ত দেখতে না পেলে আমাদের মন কেমন কেমন করে। মনে হয় কি জানি একটা বাদ পড়ে গেছে। একটু বুঝতে শেখার পর থেকে যেমনটা হচ্ছে দেখছি, এখনও হয়ে যাচ্ছে ঠিক সেভাবেই। ১০/১২ বছরে এইসব ঘটনার হার কমেনি এতটুকু, বরং বেড়েছে অবশ্যই। তবে, উল্লেখ্য যোগ্য একটা পরিবর্তন এসেছে অবশ্যই।
কেমন পরিবর্তন?
ঠিক আছে, ব্যাখ্যা করি চলুন। মনে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই নির্যাতিত শিক্ষিকা রুমানা, অথবা শিক্ষকের দ্বারা নির্যাতিতা ভিকারুন্নেসা স্কুলের সেই ছাত্রীর কথা? কিংবা একদম সাম্প্রতিক সাগর-রূনী হত্যা যজ্ঞের কথা?.. ..এমন ঘটনার ঠিক পরপরেই, বিশেষ করে নারী প্রজাতির প্রাণীরা জড়িত আছে এমন ঘটনার পরে সব সমসয়েই দুটো পক্ষের উদ্ভব হতে আমি দেখেছি। একটা পক্ষ, যারা এই অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে থাকেন। আর অপর পক্ষ, যারা কাপুরুষের মতন চুপ করে থেকে পাশ কাটিয়ে যান। আজকাল দেখতে পাচ্ছি নতুন একটা পক্ষের উদ্ভব ঘটেছে এবং ওই কাপুরুষ পক্ষটি থেকেই বোধকরি এদের জন্ম। এরা হচ্ছে, অন্যায়ের স্বপক্ষের পক্ষ।
হ্যা, আপনারা ঠিক শুনেছেন। এরা হলো অন্যায়ের স্বপক্ষের পক্ষ। সাধারণত এরা তাদের কাঠমোল্লাগিরি নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকে, আর কোনো একটা ‘‘মসলাদার’’ ঘটনার পরে এদের কাজ হয় দোষী পকোষর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। শুধু তাই নয়, দোষী ব্যক্তিকে নির্দোষ প্রমাণের খুব প্রবল একটা চেষ্টাও এদের মাঝে দেখা যায় বৈকি।
যেমন ধরুণ, রুমানা মেয়েটির ক্ষেত্রে কি ঘটেছিল? প্রাথমিক সমবেদনা জ্ঞাপনের পরে আলোচনার জন্যে আর্কষনীয় বিষয় কিন্তু হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর চরিত্রের চুলচেরা বিশ্লেষন। কোন জায়গায় প্রেমিক ছিল তাঁর, কয়টা প্রেমিক ছিল, আদৌ ছিল কিনা.. ..এ সমস্তই ছিল ওই কাপুরুষ দলটার আগ্রহের বিষয়। একসময় তো তারা একরকম প্রতিষ্ঠাই করে ফেললো যে, রুমানার স্বামী যা করেছে তা ঠিকই করেছে। চরিত্রহীন বউয়ের এমন সাজাই হওয়া উচিত।
ধর্ষিতা স্কুল ছাত্রী মেয়েটিকে নিয়েও দেখছি এখন ওসই একই কাহিনী। সেই কাপুরুষ গোত্রটি খুব সুন্দর ভাবে প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করছে যে ধর্ষণের জন্যে মেয়েটি নিজেই দায়ী। তার পোশাক-আশাক এমনই ছিল যে পরিমলের নাকি ধর্ষণ না করে কোনো উপায়ই ছিল না। আমারই এক পরিচিত লোক আমাকে শুনিয়ে গেলেন গতকাল- ‘মেয়েরা সেধে গিয়ে রেপড হয়, বুঝছো। ভালো করে ঢেকেঢুকে বোরখা পড়লেই তো আর পুরুষ মানুষের নজরে পড়ে না। মাইয়া এমনই ড্রেস পড়ছিল, পরিমল বেচারা কি করবে। পুরুষ মানুষতো। উত্তেজক জামা কাপড় পড়লে ব্যাটা ছেলে তো তাকাবেই।’’
বোরখা পড়াই যদি ধর্ষণের প্রতিরোধক হয়, তবে পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরাকে-সৌদি আরবে কেন ধর্ষিতা হচ্ছে নারী শরীর? রুমানার চরিত্র খারাপ কি ভালো, তা বিশ্লেষনের বিচারক আমরা কেউ নই। কিন্তু সত্য এটাই যে, তার একটি কেন ১০০ টি প্রেমিক থাকলেও কেউ তাঁর সাথে সেরকমটি করার অধিকার রাখে না, যা করেছে নরপিশাচ স্বামী। আর এই দেশে তো তিন বছরের শিশু ধর্ষিত হয়। তার মানে কি? সেই তিন বছরের শিশুও নিজের ধর্ষণের জন্যে দায়ী? তিন বছরের শিশুটি আর্কষনীয় পোশাকা-আশাকে সজ্জিত হয়ে প্রলুব্ধ করছে নরপিশাচের দলকে ধষণের জন্যে? এবং এইসব ঠেকানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে তিন বছরের শিশুটিকে বোরখা পরিয়ে দেয়া?
এবার আসি সাগর-রূনী প্রসঙ্গে। এই সাংবাদিক দম্পতিকে কেন বা কি কারণে হত্যা করা হয়েছে সেই রহস্য এখনও অনাবৃত। প্রসাসন এই বলে আশ্বাস দিয়ে চলেছে যে তদন্ত চলছে, খুনীরা একদিন গ্রেপ্তার হবেই। আমরা ভরসা করে বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছি সেই আশ্বাসে, হয়তো অনেকেই মনে মনে মেনে নিয়েছি যে খুনীরা কখনও গ্রেপ্তার হবে না। তারা চলে গেছে ধরা ছোঁয়ার অনেক অনেক উর্দ্ধে।
কিন্তু মজার ব্যাপারটা কি জানেন?
মজার ব্যাপারটা হলো এই সাগর-রূনীর নৃশংস হত্যা কান্ডটিকেও এখন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে সেই আদি ও অকৃত্রিম পথে- চরিত্রহীন নারী ও তার পরকীয়ার গালগল্পে। ফেসবুকের কথা বাদই দিলাম, নানানরকম ম্যাগাজিনও ছেপেছে নানানরকম কাল্পনিক গালগল্প। সাগর-রূনী হত্যাকাহিনীর সবচাইতে জনপ্রিয় থিওরীটা হলো এই রকম যে সাগর বাসায় ফিরে দেখেন যে স্ত্রী রূনীর সাথে পরকীয়া প্রেমিক। সেই প্রেমিকের সাথে বাত বিতন্ডায় সাগর খুন, প্রমাণ গায়েব করতে রুনীকেও খুন.. ইত্যাদি ইত্যাদি।
এবং এইসব মিথ্যাচারের প্রভাব যে কত ভয়াবহ তা টের পেলাম কদিন আগেই। আমার যে আম্মা সাগর-রুনীর জন্যে না জানি কত সহস্র অশ্রু বর্ষন করেছেন, সেই আম্মাই হঠাৎ বলে গেলেন- ‘‘শুনলাম রূনীর বয়ফ্রেন্ড নাকি মারছে সাগরকে? এটা কি সত্যি নাকি?’’ আমি ক্ষেপে উঠতেই একটা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বের করে দেখালেন, যাতে বিস্তারিত বর্ননা আছে ঘটনার নেপথ্যের সমস্ত কাহিনীর। পুঁজি সেই একটাই- নারীর পরকীয়া প্রেম! পুলিশ কিংবা র্যাব যে কাহিনীর জট ছাড়াতে পারে নি. সেই রহস্যের সমাধান উক্ত পত্রিকার রির্পোটার ভদ্রলোক ডেস্কে বসেই করে ফেলেছেন- ব্যাপারটা বাহবা কুড়ানোর মতোই, কি বলেন?
পরিশিষ্ট:-
গতকালের সেই লোকটির সাথে আজ একটু আগে আমার দেখা হলো আবার। একদল বখাটে তাঁর ক্লাস সেভেন পড়ুয়া মেয়েটিকে আজ রাস্তায় উত্যক্ত করেছে, মেয়ের মা সাথে থাকা অবস্থাতেই করেছে। ভদ্রলোক ভাবছেন থানায় একটি জি.ডি করিয়ে রাখবেন কিনা। ব্যাপারটা ঠিক হয়নি জানি, তবু ভদ্রলোক কাহিনীটি বর্ননা করতেই উদাস সুরে বললাম-
‘ পুরুষ মানুষতো। উত্তেজক জামা কাপড় পড়লে ব্যাটা ছেলে তো তাকাবেই।’’
নিজের সন্তানের উপর এসেছে বলে ভদ্রলোক এখন ভিন্ন সুর ধরেছেন। একটা জিনিস আমরা বারবার ভুলে যাই যে যাদের দুঃসময়ে আমরা কুৎসা রটিয়ে অবসর যাপন করছি, তারাও কারো পরিবারের অংশ। কারো মা, কারো বোন, কারো স্ত্রী। কখণও ভেবে দেখেছেন, এমন একটি ঘটনা আপনার-আমার কোনো কাছের মানুষের সাথে ঘটতে কতক্ষণ? এখন যেমন আপনি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে কুৎসা রটনা করে যাচ্ছেন, আপনার কোনো দুর্ঘটণায় ঠিক এমনি করেই কুৎসা রটনা করবে অন্য কেউ। সমাধান বোরখা পড়া নয়, সমাধান কুৎসিত রটনা রটিয়ে গা বাঁাচিয়ে চলা নয়, সব দেখেও চোখ-কান বুঝে বেঁচে থাকাটাও সমাধান নয় মোটেই। সমাধান অন্য কিছু। আর সেই অন্য কিছুটা খুঁজে নিতে হবে আমাদের নিজেদেরকেই। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে, নিজের আপন জনদেন নিরাপত্তার স্বার্থে। কেননা ভেবে দেখুন একবার- যা ঘটে চলেছে চারপাশে, তার দায় হতে আমারাও কি মুক্ত? এতটুকু কি দায় নেই আমাদের কারও?