মে দিবসঃ আজকের দিনে অঙ্গীকার হোক সকল শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠার

মে দিবসঃ আজকের দিনে অঙ্গীকার হোক সকল শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠার

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ আমাদের জীবনের এমন কিছু বিশেষ দিন থাকে, যেটি সারা বিশ্বের কাছে সুপরিচিত। ভিন্ন মত কিংবা ভিন্ন পথের অনুসারী হলেও এই সকল দিনের গুরুত্ব সবার কাছে-ই সমান ভাবে গ্রহণযোগ্য। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই সকল দিবসের আপন মহিমায় ঘুচে যায় শ্রমিক-মালিকের মধ্যেকার ভেদাভেদ। দূর হয়ে যায় রাগ-অভিমান আর রেষারেষির সর্ম্পক। তেমনি একটি বিশেষ দিন হলো ‘মে দিবস’। যেটি সারা বিশ্বে একই সাথে শ্রমিক আন্দোলনের দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে বহুকাল ধরে।

সকল ঘটনার অন্তরালে কিছু ইতিহাস থাকে। ১ মে কে ‘মে দিবস’ হিসেবে রূপায়িত করার পেছনে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু কারণ আছে। সময়ের সাথে সাথে এ সকল কারণের সত্যতা নষ্ট করে শ্রুতি মধুর করার জন্য প্রকৃত ইতিহাস অনেকাংশে বিকৃত হয়। ফলে এই সকল গুরুত্বপূর্ণ দিনের আর্বিভাবের সঠিক ইতিহাস নবীণদের কাছে তো দূরের কথা, অনেক প্রবীণদের কাছেও স্পষ্ট নয়! অথচ ঐতিহাসিক মে দিবসের স্মরণীয় ঘটনা আমাদের সকলের সঠিকভাবে জানা উচিত। ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, প্রাচীন যুক্তরাষ্ট্রের শহর গুলোতে কৃতদাস প্রথার চল ছিলো। অর্থাৎ একটি মানুষকে কিনে নিয়ে তাকে দিয়ে করানো হতো সীমাহীন পরিশ্রম। এই সকল ক্রীতদাসদের আহার-নিদ্রা সব কিছু-ই নির্ভর করতো স্বীয় তথাকথিত প্রভুদের ওপর। প্রভুর নির্দেশের অপারগতা প্রকাশ করলে ক্রীতদাসদের করা হতো একাধারে শারিরীক ও মানসিকসহ বিবিধ নির্যাতন। প্রভু শেণীর এই শোষকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস কারো ছিলো না। সকলে-ই জানতো প্রতিবাদের অর্থ-ই হলো অনিবার্য মৃত্যু। সকল নির্মমতা সত্ত্বেও মানুষ চায় বেচেঁ থাকতে। খোলা আকাশের নীচে সবাই নিজেকে যাযাবর ভাবতে পছন্দ করে। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের সবচেয়ে বড় সাফল্য বা ব্যর্থতা হলো, মানব জাতি সহজে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে চায় না কিংবা পারে না! কিন্তু অত্যাচারের কালো থাবা ক্ষেত্র বিশেষ মানুষের বেচেঁ থাকার ইচ্ছাটুকুকেও গ্রাস করে নেয়। সেরকম-ই একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে। প্রতিদিন ১৮-২০ ঘন্টা কাজ করে উপযুক্ত পারিশ্রমিক না পেয়ে, অত্যাচারের আগুণে ফুলে-ফেঁপে এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে মেতে উঠেছিলো শ্রমিকরা। এই আন্দোলনে শ্রমিকদের দাবি ছিলো তারা দিনের অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার মধ্যে তিন ভাগের একভাগ কাজ করবে। সুতরাং দাবি অনুযায়ী তাদের কাজের পরিধি দাঁড়ায় ৮ ঘন্টা। বাকি ১৬ ঘন্টার মধ্যে ৮ ঘন্টা সুস্থ্য বিনোদন এবং ৮ ঘন্টা ঘুম ও পরিবারের অন্যান্য কাজের পিছনে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। তাদের দাবির মধ্যে আরো ছিলো সপ্তাহের যে কোন একটি দিন তাদেরকে পূর্ণ ছুটি দিতে হবে। কিন্তু শ্রমিকদের এই দাবি মেনে নিলে স্বৈ^রাচারী মালিকদের স্বার্থের যথেষ্ট ক্ষতি হবে বিবেচনা করে মালিক পক্ষ এই দাবি মানতে সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি জানায় এবং তারা নানান ধরনের অত্যাচার ও নিপীড়নের মাধ্যমে শ্রমিকদের এই আন্দোলনে রণে ভঙ্গ দিতে চেষ্টা করে। মালিক পক্ষের অসহনীয় ব্যবহার এবং অত্যাচার শ্রমিকদের সকল ধৈয্যের বাঁধ ও সহ্যের সীমাকে অতিক্রম করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকরা সৃষ্টিকর্তার নামে শপথ নেয়, যে কোন মূল্যে-ই হোক তারা তাদের দাবি আদায় করবেই। সেই শপথকে মনের অন্তরালে পুঞ্জিভূত করে শিকাগো শহরে হাজার হাজার শ্রমিক একত্রিত হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয় মৌন মিছিলের মাধ্যমে তারা রাজপথে তাদের প্রতিবাদ জানাবে। ক্ষমতা ও অর্থ মানুষকে ক্ষেত্রবিশেষ হিতাহিত জ্ঞান শূণ্য করে দেয়। আর সেই শূণ্য জ্ঞানে শোষক শ্রেনীর শাসকরা শ্রমিকদের মিছিলে নির্বিচারে গুলি বর্ষণের নির্দেশ দেয়। সেই গুলিতে নিহত হয় নাম না জানা একাধিক শ্রমিক। সেই ঘটনায় সারা পৃথিবীতে নেমে আসে শোকের ছায়া। স্তম্ভিত হয়ে পড়ে সাধারণ জনগণ। আর এই নিষ্ঠুরতম ঘটনাটি ঘটে ১৮৮৬ সালের ১ মে।

পরবর্ত্তীতে নানা প্রতিবন্ধকতার মাঝে ১ মে’র শ্রমিক আন্দোলনকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। কাগজে-কলমে তাদের দাবি মেনেও নেয়া হয়। ১৮৯০ সাল থেকে এই দিবসটি সারা বিশ্বে অধিকার আদায়ের দিবস হিসেবে পলিত হয় এবং এই দিন সারা পৃথিবীতে একই সাথে সরকারি ছুটি পালন করা হয়। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া,       উজবেকিস্তান, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশ এটিকে ছুটির দিন হিসেবে পালন করলেও আমেরিকা অদ্যাবধি এটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেনি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ‘মে দিবস’ যথাযথ মর্যাদার সাথেই আমাদের দেশে পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা সেই সকল শ্রমিকের আত্নবলিদান কতোটুকু স্বীকৃতি দিতে পেরেছি? ৮ ঘন্টা কর্ম দিবস হিসেবে পালনের রীতি কি আমরা মানতে পারছি? একটি নিয়ম হয়েছিলো এবং এখনো প্রচলিত আছে, সেটি হলো ৮ ঘন্টার বেশি পরিশ্রম করলে অতিরিক্ত সময়ের জন্য ‘‘ওভারটাইম’’  হিসেবে অতিরিক্ত পারিশ্রমিক প্রদান করা হবে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই সকল রীতি-নীতি অনেকাংশেই ফসিল। এগুলোর বাস্তবিক প্রয়োগ একেবারে নেই বললে-ই চলে। শ্রমিকদের দিয়ে করিয়ে নেয়া হয় অতিরিক্ত পরিশ্রম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বল্প উন্নত দেশ বা উন্নয়নশীল দেশ থেকে শ্রমিক ভাড়া নেয়ার রেওয়াজ চালু রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশও পড়ে। বাংলাদেশের শ্রমিকরা বিদেশের মাটিতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হয়। প্রাপ্ত সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের এই বঞ্চনা শুধু বিদেশের মাটিতেই নয়। বরং দেশের মাটিতে আরো বেশি। শরীরের রক্ত পানি করে, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেও শ্রমিকের মনে নেই   শান্তি। ঘরে নেই নিশ্চিত অন্ন সংস্থান। নেই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। স্বাভাবিক মৃত্যুর কথা এ কারণে বলছি, আমাদের র্গামেন্টস্ বা ট্যানারী শিল্প কল-কারাখানা গুলোয় প্রায়-ই অগ্নিদগ্ধ বা দুরারোগ্য ব্যাধির শিকার হয়ে প্রাণ হারাতে হয় অগণিত শ্রমিকের। এদের মৃত্যুর সঠিক কোন তদন্ত হয় না। এমনকি এদের মৃত্যু পরবর্ত্তী সময়ে কর্তৃপক্ষ এদের পরিবারের জন্য তেমন কোন সাহায্য বা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় না। এটাই হচ্ছে বর্তমান শ্রমিকদের বাস্তব প্রেক্ষাপট।

১ মে অধিকার আদায়ের দিন। রক্তরাঙ্গা দিন। আমাদের দেশে ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও এর পরবর্ত্তী যে কোন আন্দোলনে মে দিবসের কিঞ্চিৎ ভূমিকা রয়েছে। সকলে একত্রিত হয়ে স্বীয় অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে মে দিবসের তাৎপর্য আমাদের প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। একটি দেশের উন্নয়নের অন্তরালে থাকে শ্রমিক-মজুরদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ব্যথা-বেদনা। সেক্ষেত্রে আজকের দিনে আমাদের অঙ্গীকার হতে হবে সকল শ্রমজীবী মানুষের অধিকার হোক সুপ্রতিষ্ঠিত, পৃথিবী হোক শান্তিময়…!

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।।

jsb.shuvo@gmail.com

প্রধান সম্পাদক