শ্রমিক দিবসে শ্রমিক নারীর শ্রমকাহন

শ্রমিক দিবসে শ্রমিক নারীর শ্রমকাহন

মোমিন মেহেদীঃ

আমাদের এই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি পর্বে নারী, পুরম্নষের সাথে সাথে দেশ তথা পৃথিবীকে গড়ায় বিশেষ অবদান রাখা স্বত্বেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে পদে পদে। বিশেষ করে বেতন-ভাতা ও মুজুরীর দিক থেকে। নারী পুরম্নষের পাশাপাশি এগিয়ে চলেছে প্রায় প্রতিটি সত্মরে সমানতালে। রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি-কূটনীতির সাথে সাথে মাটি কাটা, ইট ভাঙা, কৃষি কাজ করা, বোঝা টানা, নির্মাণ কাজে নারী, গৃহকর্ম, ম…ৃশল্প, গার্মেন্ট শিল্পকারখানা, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির টুকরো কাপড় অর্থাত্ জুট বাছার কাজ, চা বাগানগুলোতে চা তোলার কাজ, চিংড়ি রফতানি প্রকল্প, শুঁটকি প্রকল্পসহ বিভিন্ন শ্রমবাজারে সর্বত্রই রয়েছে এ দেশের নারীদের বলিষ্ঠ পদচারণা। কিছু কিছু সত্মর ব্যতিত অধিকাংশ সত্মরের কাজেই নিয়োজিত শ্রমজীবী নারীদের প্রায় অধিকাংশই অশিক্ষিত। এসব শ্রমজীবী নারীর মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগই অশিক্ষিত, বাকি ১০ ভাগ সামান্য লেখাপড়া জানে। ফলে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজের ন্যায্য পাওনা বুঝে নিতে পারে না। অথচ নারী-পুরম্নষের এই শ্রমের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ১৮৮৬ সালে শিকাগো শহরে শ্রমজীবী মানুষের ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে সোচ্চার হয়ে ওঠে শ্রমিক নেতারা। আন্দোলন চলাকালে বোমা বিস্ফোরণে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর শ্রমিক নেতা স্পাইজ, পার্সনসের ও ম্যাটসনকে ফাঁসি দেয়া হয়। আর তারই সূত্র ধরে ১৮৯০ সালের ১ মে থেকে প্রতিবছর এ দিবস শ্রমজীবী মানুষের দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধামত্ম গৃহীত হয়। সেই থেকে যথাযোগ্য মর্যাদায় এ দিবসটি পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে পালিত হয়ে আসছে। ১ মে আমত্মর্জাতিক শ্রমিক দিবস। মেহনতি মানুষের শোষণ আর নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার দিন। মূলত শ্রমিকের দাবি-দাওয়া, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাসহ সমস্যা সমাধানের বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলাই এ দিবসের লক্ষ্য। বহু জায়গায় এমন বহু শ্রমিক আছেন যারা ১ মে কী জানেন না। শ্রমিক দিবস কী তা কখনও শোনেননি। তাদেরও যে দাবিদাওয়া থাকতে পারে সে কথাও তারা বেমালুম ভুলে থাকে। ১ মে এসে গেলেই শ্রম দিবস বা শ্রমিকের যথার্থ মজুরি বা ন্যায্য পাওনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় সর্বত্র। আমরা যারা লিখি তাদের কলমও সোচ্চার হয়ে ওঠে মেহনতি মানুষের পক্ষে। কিন্তু শ্রমিক বিশেষ করে নারী শ্রমিক কী তাদের যথার্থ পাওনা পাচ্ছে? পাচ্ছে কি তাদের আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা? তারা কি পুরুষের সমান মজুরি পাচ্ছে? পাচ্ছে না। দৈহিকভাবে দুর্বল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করার সাহস না পেয়েও তারা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নিম্ন আয়ের এসব শ্রমজীবী নারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত কিংবা কোনো রকম লিখতে পড়তে পারে। এই অশিক্ষার কারণেও তারা পদে পদে ঠকে যাচ্ছে। যদিও  ১৯৭৫ সালের আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনে নারী শ্রমিকদের প্রতি সমআচরণ ও সমান সুযোগের ‘আইএলও’ ঘোষণা গৃহীত হয়। এতে নারীর কাজের ও শ্রমের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী শ্রমিকের প্রতি পুরুষ শ্রমিকের মতো সমান সুযোগ কিংবা সমান মজুরি দেয়া হচ্ছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী শ্রমিক তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মাটি কাটার কাজে একজন পুরুষ শ্রমিক যেখানে পায় ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, সেখানে একজন নারী শ্রমিক পাচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এসব নারী শ্রমিক নিজেরাও জানে না তাদের বৈষম্যের কথা। কোনো কোনো নারী শ্রমিককে বলতে শুনেছিত‘বেটা মানুষ, ম্যাইয়া মানুষের চাইয়া বেশি কাম করে তাই তাগো বেশি টাকা দেয়।’ আসলে কী  তাই? একজন পুরুষ শ্রমিক যদি ১০ ঘণ্টা কাজ করে নারী শ্রমিকও সেই একই সময় এবং সমপরিমাণ কাজ করছে। তবে কেন এ বৈষম্য? এই বৈষম্য দূর করতে নারীদেরকে হতে হবে আরো বলিষ্ঠ সাহসী। আর পুরম্নষদেরকে হতে হবে নারীর প্রতি আরো প্রত্যয়ী। ‘নারী অধিকার, সম অধিকার বলে বলে শুধু কথার খই ফোটানো নয়; নারীদের আজ জীবনের জন্য, আগামীর জন্য প্রয়োজন ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবীতেও সোচ্চার থাকা। এ প্রসঙ্গে আলাপকালে তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেছেন,‘ নারী অধিকারের নামে কোন প্রহসন নয়; প্রয়োজন সঠিক পদÿÿপ।’ কেননা, নারীর কোমল হাত এসব কঠিন এবং ভারী কাজে লিপ্ত থাকে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে ছুটে চলাই যেন তাদের লক্ষ্য। কোথাও এতটুকু অবসর নেই। নেই কোনো বিনোদন, নেই ভালো খাবার-দাবার। সংসারের কঠিন ঘানি টানা এসব শ্রমজীবী নারীর সন্তানরা ভালো স্কুলে পড়তে পারে না। ছোট্ট দুধের শিশুকে নিয়েও নারীকে কাজে বের হতে হয়। এ চিত্র আরও করুণ। এসব খেটেখাওয়া নারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্য সচেতন নয়। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কমর্রত নারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্য সচেতন নয়। দুপুরের খাবারের সময় ছোট-বড় ফ্যাক্টরিগুলোর সামনে দাঁড়ালে দেখা যায়, তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে চালতা, তেঁতুল, আম, বরই প্রভৃতির আচার, বাদাম ভাজা বড়জোড় সিঙ্গারা খাচ্ছে। এই সামান্য খাবার খেয়ে তারা বিকাল পর্যন্ত কাজ করে। কেউ কেউ আবার ওভারটাইম করে রাতে বাড়ি ফিরে ভাত খাবে। কথা বলছিলাম গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কমর্রত নারীদের সঙ্গে। অনেকেই বললেন, টুকটাক হালকা নাশতা খায়। আবার অনেকে বললেন, বাড়ি থেকে ভাত-তরকারি, রুটি, নাশতা নিয়ে আসি। বাড়ি থেকে আনা টিফিনই তাদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত। তাই নারীশ্রমিকদের স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করতে নারীদেরই এগিয়ে আসতে হবে। শ্রমজীবী নারীর শ্রম বৈষম্য এবং কঠিন কর্মের কথা যতই বলবো শেষ হবে না। শ্রমজীবী এসব নারী মজুরিভিত্তিক কাজ করে তার নিজ গৃহে গিয়ে সামান্যতম বিশ্রামটুকু কী নিতে পারে? এখানেও রয়েছে নারীর ঘর-গৃহস্থালীর কাজ। বাড়ি ফিরে তাকে করতে হয় রান্না-বান্না, ছেলেমেয়েদের নাওয়া-খাওয়াসহ অন্যান্য কাজ। শুধু শ্রমজীবী নারীর ক্ষেত্রে নয় সচ্ছল পরিবারের নারীরাও বাইরে চাকরি না করলেও ঘরের হাজারও কাজে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। এসব কষ্টসাধ্য কাজের মূল্য কখনও পরিমাপ করা হয় না। অন্যদিকে জাতিসংঘের তথ্য মতে, নারীর বিনা মজুরির গৃহস্থালী শ্রমের দাম ১১ লাখ কোটি ডলার। জাতিসংঘ সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে, ‘নারী সংসারে যে শ্রম দেয় তা বাজার মূল্যে জাতীয় আয়ে যুক্ত করলে বিশ্বের মোট উত্পাদন আরও প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়াতে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ উলে­খযোগ্যভাবে বেড়েছে। শ্রমবাজারে নারীর এই অংশগ্রহণ এবং পুরুষের সমানে সমান কাজ করা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবশ্যই সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তা নারীর কোমল হাত দুটি যেভাবেই পরিশ্রম করুক না কেন। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে আমরা আশা করব, নারীশ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা বুঝে নেবে। অন্তত তাদের শ্রমের ন্যায্য হিসাবটুকু বুঝে নিতে পারে সে লক্ষ্যে তারা যেন নৈশ বিদ্যালয়ে কিংবা অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমগুলোতে অংশ নিতে পারে সে লক্ষ্যে তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে নানামুখী নারী উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘যেসব নারী কারখানায় কাজ করেন তারা যাতে কারখানা আইনে নারীশ্রমিকের অধিকারটুকু পান। পুরুষের সমান মজুরি পান। নিজের ন্যায্য মজুরি বুঝে নিতে পারেন। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সমাজ এবং সংসারের প্রতিটি সচেতন ব্যক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে।’ কেননা, নারীর শ্রমের মূল্য সঠিকভাবে দিলে নারী হয়ে উঠবে দেশের অর্থনৈতিক চাকার দূরমত্ম গতি। যা উন্নত দেশগুলোর মত আমাদের মত একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুবই প্রয়োজন। অতএব নারীর শ্রমের সঠিক মূল্য দেয়ার মানসিকতা তৈরি হোক কঠিন মনের মালিকদের। এগিয়ে আসুক নারী নেতৃত্বে পরচালিত বর্তমান সরকারের সংশিস্নষ্ট মহলও…

mominmahadi@gmail.com

প্রধান সম্পাদক