যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দোহাই আর চলবে না!
জাহাঙ্গীর আলম আকাশ ।। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারটা সম্পন্ন হোক এটা আসলে আওয়ামী লীগ চায় কিনা সেটাই সন্দেহ! এই প্রশ্নের জবাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান সুইডেনপ্রবাসী শেখ তসলিমা মুন লিখেছেন, “অবশ্যই চায়, তবে এটাকে আবার নির্বাচনি প্রচার হিসেবে সংরক্ষণ করছে!”
পুলিশ, এলিট ফোর্সের নির্যাতন-গ্রেফতার এবং আদালতের ওপর বন্দুক রেখে সরকার বিরোধীদের ঘায়েল করবে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের সেই মুরোৎ নেই রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে মোকাবেলা করার। কারণ আওয়ামী লীগের এখন শুধু খাই খাই অবস্থা! সংগঠন বলতে কিছু নেই। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীই একমাত্র নির্ভরশীলতা! অথচ আওয়ামী লীগের আছে দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস। কিন্তু কালোটাকার প্রভাব, ব্যবসায়িদের দৌরাত্ম আর দলপ্রধানের একনায়কোচিত মনোভাব আওয়ামী লীগকে ক্রমেই দুর্বল করে তুলছে।
যাহোক দেশের সার্বিক পরিস্থিতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সরকারের অনুকূলে আছে বলে দলনিরপেক্ষ মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মনে করে না। বিশিষ্ট সাংবাদিক-কলামিষ্ট যুদ্ধাপরাধ আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা শাহরিয়ার কবিরও এমন আশংকা প্রকাশ করেছেন সম্প্রতি।
সরকার দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে পারছে না বা ব্যর্থ। কিন্তু বিরোধীদের ওপর পুলিশ এবং এলিট ফোর্স-পুলিশের পাশাপাশি সরকারি দলের ক্যাডারদের আক্রমণ করাতে এতটুকুও কুণ্ঠাবোধ করছে না।বিরোধী নেতাদের নামে চলছে সিরিজ মামলা দায়ের। এমন অবশ্য শুধু যে এই সরকারই করছে তা নয়। বিগত সরকারগুলিও একই কাজ করেছে। বিশেষ করে বিএনপি-জচামাত জোট সরকারও আজকের সরকারি দল ও জোটের নেতা-কর্মীদের ওপর একই বর্বরতা চালিয়েছিল।
এলজিআরডিমন্ত্রি ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক সমাবেশে বলেছেন, “ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর একমাত্র ভরসাস্থল হলেন প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনা। তাই ইলিয়াসের স্ত্রী প্রধানমন্ত্রির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইছেন।”
সৈয়দ আশরাফের জন্য প্রধানমন্ত্রি ভরসাস্থল হলেও হতে পারে। কিন্তু শেখ হাসিনা কারও আশ্রয় ও ভরসাস্থল হয়ে ওঠতে পারেননি আজও। তিনি যদি ভরসাস্থলেই হবেন তবে ইলিয়াস আলী কেন উদ্ধার হচ্ছেন না? কেন সাগর-রুনির খুনিদের ধরা হচ্ছে না? শেখ হাসিনাতো সাগর-রুনির সন্তান শিশু মেঘেরও ভরসাস্থল হবার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু তার খোঁজও রাখেন না প্রধানমন্ত্রি আজকে। সাগর-রুনির খুনিদের শনাক্ত করতে এবং খুনিদের গ্রেফতার করতে হাসিনা সরকারের পুলিশ, বিশেষ বাহিনী, রাষ্ট্রীয় হত্যা-নির্যাতনের বিশেষ বাহিনী সবাই ব্যর্থ। বস্তাভর্তি টাকা কেলেংকারির ঘটনার সংশ্লিষ্ট সেই গাড়িচালক আজম কোথায়, তারও সন্ধান দিতে পারছে না মহাজোট সরকার। প্রধানমন্ত্রি যদি মানুষের ভরসাস্থলেই হবেন তবে তিনি কী করে বলেন যে সরকারের পক্ষে কারও বেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়?
ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছেন। এর আগে তিনি বিশেষ বাহিনীর সঙ্গে পূবাইলের অভিযানে অংশ নিয়েছেন। তারপরও সরকার বলছে, ইলিয়াস আলীর পরিবারের পক্ষ থেকে সহেযাগিতা করা হচ্ছে না। তাহলে ইলিয়াস আলীর পরিবারকে কী করে সহযোগিতা করতে হবে তাও কিন্তু সরকার খোলাসা করে কিছু বলছে না।
সৈয়দ আশরাফ আরও বলেন, “তার স্বামীকে সত্যিকার অর্থে উদ্ধার করতে হলে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ইলিয়াস আলী উদ্ধার হোক- তার দল তা চায় না।” বিরোধীদল নাহয় চাইছে না যে ইলিয়াস উদ্ধার হোক। সরকার কী চাইছে? সরকার যদি চাইতো তবে এতদিনেও ইলিয়াস আলী কেন উদ্ধার হ্চ্ছেন না। সমস্যাটা কোথায়? নাকি পুলিশ, এলিট ফোর্স সবাই ব্যর্থ তাকে উদ্ধার করতে? যদি তাই হবে তো এই বিশাল পুলিশ ও এলিট বাহিনী পোষা হচ্ছে কার স্বার্থে? আশরাফ সাহেবরা কী ভুলে গেছেন যে দেশে একজন ইলিয়াসই গুম হননি। তার সরকারের আমলে ১১৬ জন নিখোঁজ/গুম হয়েছেন। এরমধ্যে মাত্র ২১ জনের লাশ পাওয়া গেছে। বাকিদের হদিস মেলেনি আজও। এরমধ্যে ঢাকার একজন ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমও আছেন। এই যে শতাধিক মানুষ এখনও নিখোঁজ আছেন তাদের উদ্ধারে আশরাফদের সরকার কী উদ্যোগ নিয়েছে?
সরকার কী কলেজ ছাত্র লিমনকে পঙ্গু (প্রতিবন্ধি) করে দেয়ার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিয়েছে আজও? নাকি লিমনের বিরুদ্ধে দায়ের করা কাল্পনিক অভিযোগের মামলাগুলি তোলা হয়েছে? সরকারি দলের কিংবা মহাজোট সমর্থকদের শথ শত মামলাকে রাজনৈতিক অভিহিত করে তুলে নেয়া হচ্ছে, কিন্তু লিমনদের মামলাগুলি তোলা হচ্ছে না। খালেদা বা বিরোধীদলের মামলাগুলি নাহয় তোলা হচ্ছে না রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য! কিন্তু লিমনের জীবনটাকে যারা বদলে দিলো তাদের বিরুদ্ধে কবে এবং কী ব্যবস্থা নেবে হাসিনার সরকার? মানুষের ভরসার জায়গাটা কাউকে উপহাস করলে বাড়েনি, বরং ভালো কাজ জননিরাপত্তা মানুষের কল্যাণ এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার মধ্যেই নিহিত থাকে। শুধু সুন্দর সুন্দর রসিয়ে রসিয়ে বিরোধীপক্ষকে দোষারোপ আর উনারাই সব চুরি করেছে তাই আমরা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি এমন কথায় কোন কাজ হবে না। দেশবাসি বোকা বা অবিবেচক নন। দেশের মানুষ ব্যালটের মাধ্যমে তার জবাব দেবেন। এটা মাথায় থাকলেই ভালো!
রাজনৈতিক বক্তৃতা আর মিথ্যাচার ছেড়ে সত্যাচারে নিবিষ্ট হয়ে সরকার তার কথা ও কাজের মধ্যে মিল রেখে দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করবে বলেই জাতি আশা করে। জাতি ৩০ লাখ মানুষ হারিয়েছে, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম খুইয়েছে কোন প্রতীকী বিচার নয় সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার চায় জাতি। হাসিনা, আশরাফ এবং হানিফদের মনে রাখা উচিৎ হাতে আর সময় খুব একটা বেশি নেই। জনমত কিন্তু বিএনপির না বাড়লেও আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের কমেছে এবং কমছে ক্রমশ:! খুনিদের থরুন, অপহৃত, গুম হওয়া মানুষদের জীবীত উদ্ধার করুন সেটা ইলিয়াস হোক আর চৌধুরী আলমই হোক। কারও বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে দেশে আইন ও আদালত কী কামে রাখা হয়েছে?
মাহাবুব উল আলম হানিফ বস্তত: যার ক্ষমতা শেখ হাসিনার পরই! তিনি কী দেখতে পারছেন না ছাত্রলীগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বিবদ্যালয়ে কী বর্বরতা, নৃশংসতা চালাচ্ছে সংস্কৃতিকর্মীদের ওপর। এমন নিষ্ঠুরতা চালাতো ছাত্রদল, শিবির। তার খেসারত বিএনপি-জামায়াত এখন দিচ্ছে, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ওরা ওদের শাসন-দু:শাসনের পরিণতি! সেই পরিণতি কিন্তু আপনাদেরকেও ছাড়বে না! সময় থাকতেই শোধরান, ছাত্রলীগকে সামলান, পুলিশ ও বিশেষ বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ যে লাঠি-দা-কাস্তে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে বিরোধীদের ওপর, তার ফল ভাল হবে না। এটা বিএনপি-জামায়াত এখন বুঝতেছে। হাতে ক্ষমতা না থাকলে আপনারাও একদিন তা টের পাবেন। কাজেই দোষারোপ আর নির্যাতনের রাজনীতি নয় মানুষ রক্ষার মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার রাজনীতি করুন। দেখবেন দেশবাসির ভালবাসা পাচ্ছেন!
আজ এখানেই ইতি টানতে চাই। পরিশেষে বলবো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দোহাই একবার, দু’বার দেয়া যায়! কিন্তু বারবার নয়। মানুষ অনেক সচেতন ও চালাক। দেশে আইনের শাসন, সংবিধানের শাসন, দুর্নীতি বন্ধ করুন। কাউকে দোষারোপ নয় নিজেরা কী করতে পারছেন বা পারলেন না তার হিসেব-নিকেশ করুন। বিএনপি-জামায়াত জোট কী করেছে তা দেশের মানুষ ভালোভাবেই জানেন। ক্যাসেটের একই রেকর্ড বারবার শুনতে কিন্তু কারোরই ভালো লাগার কথা না। সাগর-রুনির খুনিদের গ্রেফতার করুন, ইলিয়াসসহ সকল অপহৃত-নিখোঁজ ও গুম হওয়া মানুষদের উদ্ধার করুন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ করুন, সর্বোপরি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করুন। হাতে সময় নেই আবারও স্মরণ করিয়ে দিলাম। সুতরাং সাধু সাবধান!
লেখক:- জাহাঙ্গীর আলম আকাশ, ইউরোপ প্রবাসী সাংবাদিক, মানবাধিকারবিষয়ক অনলাইন সংবাদপত্র ইউরো বাংলা’র সম্পাদক।