অধঃপতন…

অধঃপতন…

জবরুল আলম সুমনঃ ক্যারেম খেলোয়াড় হিসেবে একসময় আমার সুখ্যাতি ছিলো। আমাদের পাড়ায় তখন আমিই সেরা ছিলাম। এক চান্সে সব কটি গুটি একে একে পকেটে বা গর্তে পাঠিয়ে দেবার গৌরবময় মুহুর্তও আমার ভাড়াড়ে ছিলো অনেক কিন্তু পড়াশোনাতে মনোযোগ দেবার কারণে ক্যারেমের ভূত আমার ঘাড় থেকে ছুতরার পাতা (একধরনের ঔষধী গাছের পাতা, যা শরীরে লাগলে প্রচন্ড চুলকানীর সৃষ্টি হয়) ঘঁষে তাড়ানো হয়েছিলো। সেই থেকে আজ অব্দি ক্যারেমের স্ট্রাইকে আর হাত দিইনি। ক্যারেম খেলার প্রধানত কৌশল হচ্ছে একটা গুটি মারতে গিয়ে অন্য আরো একটা গুটিকে নিজের আয়ত্বে নিয়ে আসা সেই সাথে অপর পক্ষের গুটিকে পকেট যেতে বাধাগ্রস্থ করা। আমি এসবে বেশ পারদর্শী ছিলাম। কেবল মাত্র একটা গুটির জন্য পারত পক্ষে আমি আস্ত একটা স্ট্রোক বরাদ্দ করাতাম না। ক্যারেম খেলা ছেড়ে দিয়েছি সেই কবে কিন্তু ক্যারেম খেলার এই কৌশলী আচরণ এখনো আমার ব্যবহারিক জীবনে কিছুটা হলেও রয়ে গেছে। আমি একই সময়ে একাধিক কাজ বা মাল্টি টাস্কিং করতে পছন্দ করি। যেমন ফেসবুক ব্যবহার করতে করতে গান শোনা, গোসল করতে করতে গুন গুন করে গান গাওয়াও (এটা অবশ্য আমার মতো অনেকেই করে থাকেন) রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে কম্পিউটারকে ডাউনলোডের কোন একটা কাজ দিয়ে যাই সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি কম্পিউটার তার কাজটি সেরে আপনা আপনি বিশ্রামে চলে গেছে। লেখা-লেখিতেও মাল্টি টাস্কিং ফর্মুলা কাজে লাগাই প্রায়শই। কোন একটা বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি, লেখার কোন একটা পর্যায়ে এসে হয়তো অন্য কোন একটা বিষয় মগজে ঢুকে পড়েছে তখন চলমান লেখাটাকে থামিয়ে দিয়ে নতুন বিষয় নিয়ে নতুন একটা লেখা লিখতে শুরু করি। এমনও হয়েছে নতুন বিষয়টি শুরু করে অন্য আরো একটা বিষয়ে লেখা মোড় নিয়েছে আমিও স্বাভাবগত ভাবে নতুন ভাবে লিখতে শুরু করে দিয়েছি। পেছনে পড়ে গেছে দুটো লেখা, কোনটাও অবহেলায় মরচে ধরেছে আবার কোনটাকে ঠিকই টেনে হিঁচড়ে বের করে এনেছি অন্য কোন একসময়।

অতি সম্প্রতি আমাদের প্রিয় মুখ আর্জুমান্দ আরা বাকুল আপুর কাছে থেকে উপহার হিসেবে পাঁচটি বই ডাক যোগে পাই। বইগুলোর মধ্যে প্রখ্যাত লেখক সমরেশ মজুমদারের “সাতকাহন”, আলী আকবর খানের “পরার্থপরতার অর্থনীতি”, ইমদাদুল হক মিলন সম্পাদিত “ছোটদের একশো রূপকথা”, প্রিয় মিলি সুলতানা আপুর “ওগো সুকন্যা” এবং ঝর্না রহমানের “নিমিখের গল্পগুলো”। সাতকাহন নিয়ে বসতে হলে অসীম ধৈর্য্যের পরিচয় দিতে হবে। এর আগে সাতকাহন পড়তে সাত বারেরও বেশি চেষ্টা চালিয়েছি কিন্তু সফলকাম হইনি, কোননা কোন কারণে বাধাগ্রস্থ হয়ে শেষতক আর পৌছাতে পারিনি। তাই এবার সাতকাহনকে আপাতত স্পর্শের বাইরে রাখলাম, সাতকাহনের জন্য সাত দিন সময় বরাদ্দ দিয়ে বসতে হবে। হাতে রইলো বাকি চারটি বই। কিন্তু মতবিরোধ দেখা দিলো কোন বইটা আগে পড়বো তা নিয়ে, একরকম সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে গেলাম। এই ক্ষেত্রে আমার ক্যারেম খেলা থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা কাজে লাগাম মানে মাল্টি টাস্কিংয়ের দিকে ঝুকলাম। প্রথমেই একশ রূপকথার মোটা সোটা স্বাস্থ্যবান বইটা হাতে নিয়ে বকুল আপুর লেখা “পারিজাত পরি” ছোট গল্পটা পড়ে নিলাম, বেশ উপভোগ্য ও মজাদার। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে নানান উপদেশের বাণী গল্পটাকে বেশ শানিত করেছে। গল্পটার মাঝে পঞ্চতন্ত্রের গন্ধ বেশ প্রবল, পড়ে মনে হলো গল্পটা কেবল রূপকথা নয় বরং গল্পের ফাঁকে ফাঁকে নীতি বাক্যে ভরপুর। এযুগের ছেলে পুলেদের জন্য বিশেষ বিনোদন মূলক শিক্ষার গল্প, এরকম গল্প প্রত্যেক শিশুদের পড়া উচিত বলেই আমি মনে করি। গল্পটা শেষ করে মিলি আপু’র সুকন্যার দিকে নজর দিলাম। প্রথম দুই পাতা পড়েই বুঝে নিলাম বইটার মধ্যে জিলাপীর প্যাঁচ আছে, বেশ ইন্টারেস্টিং হবে। আরিফকে নিয়ে ড্যাম কেয়ার সুকন্যা আর এলিনার স্নায়ূ যুদ্ধটা ভালোই জমবে। আরোও কিছু দূর এগিয়ে গেলাম যেখানে মনিন্দ্র জেলে পুকুরে জাল ফেলেছে মাছ ধরবে বলে। মনিন্দ্রকে পুকুরে আর সুকন্যা ও তার বাবা আফতাব আহমেদকে পুকুর পাড়ে রেখে আমি আলী আকবর খানের পরার্থপরতার অর্থনীতিতে ঢুকলাম। আপাতত বাবা-মেয়ে মিলে পুকুর পাড়ে গল্প করুক, গল্প করতে করতে মনিন্দ্রের মাছ ধরা হয়ে গেলে আবার তাদের কাছে ফিরবো। বড় সড় মাছ যদি কয়েকটা লেগে যায় তাহলে খাবারের জন্য দু একটা রেখে বাকিগুলোকে বাজারে চালান দিতে হবে। বাজার মানেই হচ্ছে অর্থনীতির মার প্যাঁচ, কিন্তু অর্থনীতিতে আমার জ্ঞান কম তাই আকবার স্যারের দুয়ারে ঠুকা মারা অতীব প্রয়োজন। ঠুকা না মেরেই ঢুকলাম পরার্থপরতার অর্থনীতিতে। শুরু থেকে শুরু করবো নাকি মাঝ খান থেকে শুরু করবো সেই সিদ্ধান্ত নিতে নিতে কয়েক পাতা উল্টাতেই আমার মগজ শুকিয়ে গেলো একটা অংশের শিরোনাম দেখে, শিরোনাম “শুয়রের বাচ্চাদের অর্থনীতি” !! ভাবাই যায়না আলী আকবর খানের মতো একজন জাতীয় পর্যায়ের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি এমন নিম্ন মানের শব্দ দিয়ে শিরোনাম কেন লিখবেন ? এর জট আমাকে খুলতেই হবে, আমি মাঝ খান থেকেই পড়া শুরু করে দিলাম… যতই পড়ছি ততই মজা পাচ্ছি, এক ঢোকে গেলার মতোই পড়ে নিলাম। ঘুষের কাজ কারবার নিয়ে অতি চমৎকার ভাবে লিখেছেন সাথে নানান রকমের তথ্য ও উপাত্ত দেয়া। বই পড়ার ক্ষেত্রে যেকোন তথ্যবহুল লেখা আমায় পয়লা পছন্দের তালিকায় থাকে। আমি পড়ছি আর চমৎকৃত হচ্ছি। এই অংশটা পড়া শেষে আমার মনে হলো শিরোনামটা আরোও নীচু হলে আরোও ভালো হতো। কিন্তু লেখক একজন নেহায়েত ভদ্রলোক বলে এর চেয়ে নীচে নামা তারপক্ষে হয়তো সম্ভব হয়নি। যাহোক শুয়রের বাচ্চাদেরকে (যারা ঘুষ নেয় কিন্তু কাজ করেনা) মনে মনে আমিও গালি দিয়ে বইটাকে মাথার এক পাশে রাখলাম। আরো একটা বই বাকি আছে এবার সেটার পালা। কয়েকটা পেজ পড়ে নিতে হবে আগে তারপর আবারো র‍্যান্ডমলি একটা একটা করে প্রত্যেকটা বইয়ের বাকি অংশ গুলো পড়া শুরু করবো। ঝর্না রহমানের নিমিখের গল্পগুলো বইটি হাতে তুলে নিলাম। আকার আয়তনে মধ্যবিত্ত টাইপের বই। বইয়ের পাতা উল্টাতেই “ডোন্ট ওরি উওম্যান” শিরোনামের তিন পৃষ্ঠার গল্পটি এক চুমুকেই পড়ে নিলাম। তার আগে বইয়ের ফ্ল্যাপে তার জীবনী পড়ে নিলাম যেহেতু এই লেখিকার লেখার সাথে আমার কোন পূর্ব পরিচয় ছিলোনা। “ডোন্ট ওরি উওম্যান” পড়েই বুঝে নিলাম তার লেখার হাত বেশ পরিপক্ষ, পড়তে বেশ আরাম লাগে। খুবই সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেন আমাদের চোখের সামনের বাস্তবতাগুলোকে বাজ পাখির মতো ছুঁ মেরে টেনে এনে। মোট আটচল্লিশটা ছোট ছোট গল্পে বইটাকে সাজিয়েছেন। প্রতিটা গল্পই দুই তিন পৃষ্ঠার বেশি নয় বলেই একেকটা গল্প এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়। তার চোখের সামনে ঘটা বিভিন্ন ঘটনাবলীর ঘাড়ে কলম রেখে প্রত্যেকটা গল্পের কাঠামো দাঁড় করিয়েছেন। আমি র‍্যান্ডমলি পড়ে যাচ্ছি, হঠাৎ তার একটা গল্প পড়ে আমি কিংকর্তব্যমিমূঢ় হয়ে যাই। আমি ভাবার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছি, কোথায় চলেছে আমাদের নবীন প্রজন্ম ? যাদের নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখি, তারা একদিন সুশিক্ষিত হবে, হবে দেশের কান্ডারী। স্লোগানে স্লোগানে দিন বদলের খেলা এখন চলছে। আমাদের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অরাজকতা দেখে আমি প্রায়ই মনে মনে আমাদের বর্তমান অসৎ রাজনীতিবিদদের উদ্দ্যেশে বলি তোদের দিন ফুরিয়ে আসছে। আর কতদিন, এবার কবরে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। আর ত মাত্র কিছু দিন, তারপর আমাদের নতুন প্রজন্ম আসছে, তোদেরকে ছেড়ে দিতে হবে ক্ষমতার আসন সেখানে বসবে আমাদের নতুন প্রজন্ম, তৈরী হবে নতুন বাংলাদেশ, একটি সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। কিন্তু দীর্ঘ দিন থেকে বুকের মনিকোটায় লালন করা নতুন প্রজন্মদের নিয়ে আমার কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নটা যেন একমুহুর্তে ধূলোয় মিশে গেলো ঝর্না রহমানের “বিশ্বাসগুলো” নামক ঘটনার বর্ণনা বা গল্প পড়ে। পাথুরে মুর্তির মতোন নিঃশব্দে কিছুক্ষণ উদাস হয়ে রইলাম… কি লিখেছেন ঝর্না রহমান তার “বিশ্বাসগুলো” নামক গল্পে, কি পড়ে আমি মুর্তিমান হয়ে রইলাম তা এক ঝলক দেখে নেয়া যাক, তার ভাষায়।

…রিকশায় বসে এসব নিয়ে নানা কথা ভাবছি। আশপাশ দিয়ে অসংখ্য গাড়ি রিকশা ও অন্যান্য যানবাহন চলে যাচ্ছে। হঠাৎ পাশ দিয়ে যেতে একটা রিকশা থেকে কেউ আমার প্রতি মন্তব্য ছুঁড়ে দিলো – হ্যালো-ও-ও! ওয়াও! রু রু রু……!
আমার প্রথম বিশ্বাস হল না, যে আমাকেই মন্তব্য করা হয়েছে। মন্তব্যকারী যাত্রী নিয়ে রিকশা ততক্ষণে আমাকে অতিক্রম করে গেছে। এক ঝলকে যতটুকু দেখলাম, রিকশায় তিনজন তরুণ যুবক – যারা বলতে গেলে বুয়েটে প্রথম বর্ষে পড়া আমার ছোট ছেলে সুহাসের বয়সী! ওরা আমাকে দেখে অমন করলো কেন? অবিশ্বাস করারও কিছু নেই। কারণ যাকে লক্ষ করা হয় সে ঠিকই বুঝতে পারে। আশেপাশে ওদের লক্ষ্য হওয়ার মত আর কাউকে দেখতে পেলাম না। তারপরেও আমি ধরে নিলাম – নিশ্চয় আমার পেছনে কোন গাড়ি বা অন্য কোন যানবাহনে অন্য কেউ ছিলো, যাকে উদ্দেশ্য করে ওরা মন্তব্য করেছে। মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। এত ছোট ছোট ছেলে – রাস্তায় নেমে ওরা কেন এমন অশোভন আচরণ করে! ওদের দেখে ভদ্রলোকের ছেলে মনে হচ্ছিলো।
মিনিট পাঁচেক পরে আবার চমকে উঠি। এবার মন্তব্য – বাংলা…. প্যাক প্যাক…. বাংলা…. প্যাক…. প্যাক….।
ঐ রিকশা! ঐ তিনটি ছেলে! আমার রিকশার আগে! ওদের একজন ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুখ নাড়াচ্ছে। সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে দেখা মুখ। চেনা মুখও কেমন অচেনা মনে হয়। তারপরেও মনে হল ঐ মুখটি আমার চেনা। আমারই কোন ছাত্র। ছাত্র তো হবেই! আমাকে মন্তব্য করেছে ‘বাংলা’ বলে। আমি বাংলার ছাত্রী বলে নয়, বাংলা পড়াই বলে! কারণ ওরা আমার সহপাঠীর বয়সী নয়, ওরা আমার ছাত্রের বয়সী! আমারই ছাত্র আমাকে রাস্তায় যেতে যেতে রসিকতা করে মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছে! আমার সাথে অশোভন আচরণ করছে! মায়ের বয়সী মহিলাকে টিজ করছে! আমি বিশ্বাস করতে পারিনা। মানতেও পারিনা। রিকশাটি আমার রিকশার চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। আমি মনে মনে আশা করি – আমার রিকশাটি ওদের রিকশার পাশে চলে যাক। ওদের ডাক দেব। বলব, তোমরা কি আমার ছাত্র? অথবা আমার মত কোন শিক্ষকের ছাত্র, যিনি তোমাদের সত্যি সত্যি বাংলা পড়িয়ে অসভ্য করে গড়ে তুলেছে! মনটা বিষাদে ভরে উঠতে থাকে…

আমার শরীরের সব কটি লোম শিউরে দাঁড়িয়ে গেলো উপরের অংশটা পড়ে। আমরা এ কোন সভ্যতার যুগে বাস করছি ? কেন আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম এতোটা অসভ্য হয়ে উঠছে নিজের মনে মনে এমন প্রশ্ন করতে করতে নিজের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো। খুবই অস্বস্তি, সংকোচ আর দ্বিধা নিয়ে গল্পটা সবার সাথে শেয়ার করছি, আশা করি আমাকে সবাই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাস। আমি তখন দশম শ্রেণীতে টেষ্ট পরীক্ষা শেষে ১৯৯৭ সালের এস,এস,সি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু আমরা যারা পরীক্ষার্থী কেবল তাদের জন্য স্কুলটা খোলা। সেসময়ে আমি আমার গন্ডির মধ্যে সেরা দুষ্টু বালক হিসেবে পরিচিত ছিলাম। কিন্তু কখনো বড়দের সাথে খারাপ আচরণ করিনি। স্কুলে কোচিং শেষ করে বিকেলের কিছু মুহুর্ত মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলে মাগরিবের আজান পড়লেই আবারো প্রাইভেট পড়ার জন্য একজন স্যারের বাসায় যেতাম। আমার সাথে আমার এক বছরের সিনিয়র এক বন্ধুও স্যারের কাছে পড়তে যেত। সে তখন কলেজে প্রথম বর্ষে কিন্তু আমাদের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব, যাকে বলে গলায় গলায় পিরিত। একদিন পড়া শেষে স্যারের বাসা থেকে বের হতে হতে রাত ৮টা বেজে গেলো। ডিসেম্বরের রাত ৮টা মানে অনেক রাত তাও আবার প্রচন্ড শীতের রাত তার উপর অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকার, রাস্তায় মানুষ জন খুবই কম প্রচন্ড শীতের কারণে, এই সময়ে নব বিবাহতি ব্যক্তিটিও বউকে রান্না ঘরে ছেড়ে দিয়ে নিজে লেপের ভিতরে কুন্ডুলী পাকিয়ে শুয়ে শুয়ে লেপের উষ্ণ আদর নিতে থাকে। একান্ত প্রয়োজন না হলে রাস্তায় বেরুবার দুঃসাহস কেউ সহজে দেখায়না। আমাদের বাসা থেকে স্যারের বাসার দূরত্ব ছিলো প্রায় দেড় কিলোমিটার। বেশির ভাগ সময়ে আমরা পায়ে হেঁটেই যাওয়া আসা করতাম। আজও স্যারের বাসা থেকে বের হয়ে আমরা হাঁটা ধরেছি। দুজনের পরনেই ভারী জ্যাকেট তারপরও যেন হাত পা গুলো এগুচ্ছেনা শীতের দাপটে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম রিক্সা টিক্সা পাওয়া যায় কিনা, নাহ সব রিক্সাওয়ালারাও বাড়ি ফিরে গেছে, কেউ কেউ হয়তো বউয়ের সাথে খুনসুটি করছে। মিনিট দশেক অপেক্ষার পর আবারও হাঁটতে শুরু করলাম। তখন আমার মাথার মধ্যে একটা দুষ্টু বুদ্ধি এলো, একটা সিগারেট কিনে টানতে টানতে যেতে পারলে শীত আর আমাদের কাবু করবেনা। আমরা তখন সবেমাত্র সিগারেট খাওয়া শিখেছি, প্রতিদিন খেতাম না, সপ্তাহে একদিন বা দুই দিন বন্ধুরা এক সাথে হলে তিনটা-চারটা কিনে আনা হতো তারপর সবাই মিলে খুব সতর্কতার সাথে খেতাম। আমাদের নির্দিষ্ট একটা জায়গাও ছিলো। আমাদের খেলার মাঠের পাশে ছোট্ট একটা বন, বনের ভেতরে আমরা আট দশজন বন্ধু ঢুকতাম তারপর দু-তিন জনকে পাহারায় দিয়ে বাকিরা সার্ট খুলে গোল হয়ে বসে পড়তাম যাতে সার্টের মধ্যে গন্ধ না লাগে। যারা টানছেনা তারা তখন সেগুন গাছের বড় বড় পাতা দিয়ে বাতাস করে ধোঁয়া তাড়াতো যদি কেউ দেখে ফেলে এই ভেবে। শেষ হয়ে গেলে যার যার বাসা চলে আসতাম, আমি তখন বাসায় আসার আগে পেয়ারার পাতা মুখে নিয়ে চিবাতাম যাতে মুখের দূর্গন্ধ চলে যায়। বাসায় খুব সতর্কতার সাথে ঢুকেই ওয়াশ রুমে ঢুকে ব্রাশ করে নিতাম প্রথমে তারপর প্রাইভেট থাকলে খাতা কলম নিয়ে বের হয়ে যেতাম বা পড়তে বসতাম। যাহোক, আমার বন্ধুকে পাঁচ টাকার একটা নোট হাতে ধরিয়ে দিই সিগারেট কেনার জন্য। সে কিছুটা অস্বস্তি আর ভয় নিয়ে কিনতে যায়। সিগারেট কেনা হয়ে গেলেও সিগারেটে আগুন ধরাতে পারেনি ভয়ে। দারুণ ফ্যাসাদে পড়া গেলো এবার আগুন ধরাবো কিভাবে ? হঠাৎ করেই লক্ষ্য করলাম আমাদের সামনে কেউ একজন সিগারেট টানতে টানতে যাচ্ছে কিন্তু ঘোমট অন্ধকারের কারণে কেবল মাত্র সিগারেটের আগুনটাই দেখা যাচ্ছে ভাবলাম উনার কাছ থেকেই আগুন নিয়ে নেবো তার আগে কাছে গিয়ে দেখবো উনি আমাদের পরিচিত কিনা, কিছুটা দ্রুত হেঁটে তার কাছে গেলাম। কিন্তু তিনি কে তা কিছুতেই বুঝতে পারলাম না এতোটা কাছে গিয়েও। শেষে আমিই তাকে সাহস করে বললাম “ভাই একটু আগুন দেবেন?” তিনি থমকে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন কে, কি চাই ? তখন আমাদের ধড় থেকে যেন প্রাণটা ফুড়ৎ করে উড়াল দিলো। সাথে সাথে পেছন দিকে দিলাম সজোরে দৌড়, আমার বন্ধুটি কিছু দূর যেতেই উষ্টা খেয়ে পড়ে গেলো আমি তাকে উঠাতে সাহায্য করলাম তারপর আবার দে ছুট। বেশ কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পর আমরা অন্য একটা রাস্তা দিয়ে যার যার বাসায় চলে গেলাম।

ভয়ে আতংকে সে’রাতেই আমার জ্বর চলে এলো, ভীষণ জ্বর। পরদিন জ্বর আর ভয়ে স্কুলে কোচিংয়ে যাওয়া হয়নি। কারণ যার কাছে আমরা আগুন চেয়েছিলাম তিনি আমাদের স্কুলের সবচে ড্যাঞ্জার টিচার হিসেবে পরিচিত আশরাফ স্যার ! আশরাফ স্যারের চোখ রাঙ্গানীতেই নীচু ক্লাসের ভীতুরা প্যান্ট নষ্ট করে দিতো আর তিনি যেদিন বেত হাতে নিতেন সেদিন ছোট খাটো একটা কেয়ামত শুরু হয়ে যেত। পরের তিন দিন আমি স্কুলেই যাইনি বলে স্কুল থেকে খবর এলো আমি কোচিংয়ে যাচ্ছিনা কেন। যাহোক চতুর্থ দিন থেকে আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম কিন্তু কোন ভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছিনা, মনে হচ্ছে এই মাত্র আশরাফ স্যার পেছন থেকে আমার সার্টের কলারে ধরে টান দিবেন। সবার সামনে আমাকে কঠিন শাস্তি দিবেন। কোচিংয়ে আশরাফ স্যারের একটা ক্লাশও ছিলো। তিনি যখন ক্লাশে এলেন আমি তখন ভয়ে মাথা নীচু করে বসে আছি, কিছুতেই স্যারের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। ভালো ছাত্র হিসেবে আমার অবস্থান সব সময়ই প্রথম সারিতেই ছিলো কিন্তু তখন আমি পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বসেছি, স্যার সেটা লক্ষ্য করলেন। আমাকে দাঁড়াতে বললেন। আতংকে আমার গা শিউরে উঠেছে ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছিনা। স্যার তখন খুবই আদর মাখা কন্ঠে বললেন কিরে সুমন জ্বর এখনো সারেনি ? আমি তখনো কিছু না বলে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি। তিনি তখন আমার কাছে এলেন আমার কপালে হাত রেখে বললেন জ্বরত নেই তাহলে মাথা নীচু করে আছিস কেন ? আমি তখন খুব ভয়ে ভয়ে বলি মাথা ব্যথা করছে। স্যার তখন আমার হাত ধরে ক্লাসের বাইরে নিয়ে এলেন আমি আতংকে মরে যাচ্ছি এই বুঝি স্যার আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবেন সবার সামনে কিংবা আরোও বড় কিছু যা আমার ভাবনার বাইরে। কিন্তু না তিনি আমাকে নিয়ে অফিস রুমের দিকেই হাঁটা দিলেন, অফিস রুমে ঢুকে এইড বক্স থেকে একটা প্যারাসিটামল বের করে এক গ্লাস পানি নিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন খেয়ে নে, তারপর চুপচাপ এখানে বসে থাক। মাথা ব্যথা সেরে গেলে ক্লাসে আসিস আর না সারলে ক্লাসে এসে বই নিয়ে বাড়িতে চলে যাস। একটা প্যারাসিটামল খেলে মানুষ মারা যায়না, তেমন কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও হয়না তাই আমি সাথে সাথে স্যারের সামনেই প্যারাসিটামলটা খেয়ে নিই। স্যার আমাকে অফিস রুমের একটা চেয়ারে বসিয়ে তিনি ক্লাসে ফিরে গেলেন। আমার পাশে আরোও একজন স্যার বসা, তিনি একবার আমার কাপালে হাত রেখে আর কিছু বলননি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। নিশ্চিত হলাম যে সেদিন স্যার আমাদেরকে মোটেও চিনতে পারেননি। তারপর আমি ক্লাসে চলে গেলাম। সেদিনের পর থেকে অন্তত তিন বছর আমি আর সিগারেট ছুঁয়েও দেখিনি। কিন্তু আজকালকার ছেলে মেয়েদের মধ্যে স্যার বা শিক্ষকদের প্রতি আমাদের সময়কার সম্মান বা ভয় কোনটাই নেই। তার এখন ক্লাসে বসেই সিগারেট ফুঁকে, আর সেই উল্লাসিত দৃশ্য বাসায় ফিরে ফেসবুকে শেয়ার করে!

সময় কখনোই আটকে থাকেনা। পলক, সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টার হাত ধরে কেবল এগুতেই থাকে। সময়ের পরিক্রমায় আজ যেটা ধৃষ্টতা কাল সেটাই স্বাভাবিক বা সহনশীল একটা দৃশ্য। কিন্তু তাই বলে এই মুহুর্তে যে চরিত্রে আমাকে মানাবে না সেই চরিত্র কেন আমি আমার মাঝে ধারণ করবো ? আমাদের সমাজ গন্ডিবদ্ধ সমাজ, বয়স বাড়ার সাথে সাথে গন্ডির আকারও বাড়তে থাকে কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে বাব-মা বা অভিভাবকের উদাসীনতায় আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মরা লাগাম ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। একটা সময় আমরা যা ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতো এখনকার সময়ের ছেলে মেয়েরা তা অহরহই আমাদের চোখের সামনে তা ঘটাচ্ছে। একজন মধ্য বয়েসী বা মায়ের বয়েসী শিক্ষিকাকে টিজ করা কি আমাদের সমাজে খুবই সম্মানজনক বা বীরত্বের কাজ ? কেন এমন ঘটছে ? অভিভাবকদের যথাযত তত্বাবধানের অভাবে আমি আমার জীবনের লক্ষ্যে পৌছাতে পারিনি কিন্তু আমি বিপদগামী হইনি। কারণ তখনকার সময়ে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ছিলো খুবই রক্ষণশীল। কিন্তু আজ কি চলছে আমাদের সমাজে ? ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম করে বেহায়াপনা, অশ্লীলতা আর উদ্ধত আচরণ আর কত আমাদেরকে হজম করতে হবে ? বড়রা যেমন দায়িত্ব নিতে চায়না ঠিক তেমনি ছোটরাও বড়দেরকে যথাযত সম্মান করেনা। বেড়ে উঠার প্রক্কালেই যাদের মধ্যে মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধ ক্ষয়ে যাচ্ছে তারা বড় হলে যখন ক্ষমতাধর হবে তখন আমরা তাদের কাছ থেকে কতটুকু ভালো আচরণ আশা করতে পারি ? আমাদের বাবা-মা বা অভিভাবকদের এখনি সচেতন হতে হবে তার সন্তান কোথায় যাচ্ছে কি করছে, সঠিক ভাবে মানুষের মতো মানুষ হয়ে বেড়ে উঠছে কিনা তা না হলে একদিন তারাই নিজ সন্তান কর্তৃক বিতাড়িত হবে লাঞ্ছিত হবে বঞ্চিত হবে অসম্মানিত হবে। অভিভাবকদের একটু সচেতনতাই পারে তার সন্তানকে সুষ্ঠু ভাবে বেড়ে তুলতে, এই প্রজন্মের অধঃপতন রোধ করতে। আর সংখ্যা গরিষ্ঠ অভিভাবক যদি সচেতন হোন তাহলেই কেবল আমরা একটি সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ প্রত্যাশা করতে পারি।

জবরুল আলম সুমনঃ গবেষক ও প্রাবন্ধিক।।

ফিচার সম্পাদক