রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রঙিন কাব্যভূবন
প্রকৃত প্রেম-ভালোবাসার রথযাত্রা শুরম্ন হলে সেখান থেকে ফেরার কোন উপায় থাকে না। আর তাই তিনি যেমন জীবনব্যাপী হেঁটেছেন ভালোবাসার রঙিন রাসত্মায়; তেমন আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রতিনিয়ত। তাঁর ভালোবাসা-আলোআশার সকলকথা বলতে গেলে হাজার শত পৃষ্ঠা লিখলেও শেষ হবে না বলে কবি গুরম্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য গবেষক ও আবৃত্তিশিল্পী অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী যে অভিমত ব্যাক্ত করেছেন; সে অভিমতের সূত্র ধরে স্পষ্ট যে রবীন্দ্রনাথ সকল দিকের মত ভালোবাসার দিকেও ছিলেন যথেষ্ট পক্ক। আর তাই নির্বিঘ্নে ‘অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে’ কবিতায় লিখেছেন, অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না।/ এবার হৃদয় মাঝে লুকিয়ে বোসো,/ কেউ জানবে না, কেউ বলবে না।/ বিশ্বে তোমার লুকোচুরি, দেশ বিদেশে কতই ঘুরি -/ এবার বলো আমার মনের কোণে/ দেবে ধরা, ছলবে না।/ আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না…
প্রেম-ভালোবাসাসহ সকল দিকের সব্যসাচি লেখক আমাদের রবীন্দ্রনাথকে, রবীন্দ্র চর্চাকে গতিশীল করার অনন্য কারিকর বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ : বিশ্বকবি ও বাঙালি’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ হচ্ছে নদীর স্রোতের মতো। কোথাও আঙুল দিয়ে বলা যাবে না যে, ‘এই হলেন রবীন্দ্রনাথ’। রবীন্দ্রনাথ অতুলনীয় কারণ কোনো একটা একক রচনা দিয়ে তাঁকে চিহ্নিত করা যাবে না, যেমন ফাউস্ট দিয়ে করা যাবে জার্মান কবি গ্যেটেকে, রবীন্দ্রনাথকে বরঞ্চ চিহ্নিত করতে হবে তাঁর ‘ব্যাপ্তি, বৈচিত্র্য ও পরিমাণ’ নিয়ে। আর অমিত চৌধুরী ‘বলাকা’ কবিতার পরিব্রাজনতার ওপর নির্ভর করে রবীন্দ্রনাথের কাব্যভাষা নিয়ে যে তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন, এবং যেভাবে আধুনিক যুগের প্রধান ইংরেজ কবি এলিয়টের রচনার সঙ্গে বারবার সমীকরণ টেনেছেন তাতে রবীন্দ্রনাথকে পশ্চিমা পাঠকের কাছে খুবই খন্ডিতভাবে উপস্থাপন করার মওকা তৈরি হয়েছে। পাঠক মনে করবেন, রবীন্দ্রনাথ বুঝি কেবল ভাষা নিয়ে পরীক্ষারত একজন অস্তিত্বশীল আধুনিকমনস্ক কবি ছিলেন। লেখাটিতে কবিতা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্য নিয়ে তো কোনো আলোচনা নেই, বরঞ্চ মনে হবে যেন কবি রবীন্দ্রনাথ বুঝি কেবল এলিয়ট-ধরনের শক্তিশালী কোনো আধুনিক কবি। অথচ যেজন্যে এ-তুলনাটা গর্হিত সেটি হচ্ছে, এলিয়ট একটি সাহিত্যের একটি যুগের প্রধান কবি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ একটি জাতির সর্বযুগের প্রধান কবি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা চলবে সব জাতির প্রধান কবিদের, এটা নিঃসংশয়ে বলা যায় : গ্রিসের হোমার, ইতালির ভার্জিল এবং দান্তে, জার্মানির গ্যেটে, ইংরেজদের শেক্সপিয়র কিংবা ঔপন্যাসিক হলেও রাশিয়ার তলস্তয়ের সঙ্গে। সব দিক দিয়ে যিনি সেরা তিনি রবীন্দ্রনাথ। সমাজ-জীবন- দেশ-মানুষ-প্রকৃতির পাশাপাশি প্রেমজ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনের মায়াবদ্ধ হয়ে ক্ষণিকা কবিতায় লিখেছেন, খোলো খোলো, হে আকাশ, সত্মব্ধ তব নীল যবনিকা -/ খুঁজে নিতে দাও সেই আনন্দের হারানো কণিকা।/ কবে সে যে এসেছিল আমার হৃদয়ে যুগামত্মরে/ গোধূলিবেলার পান্থ জনশূন্য এ মোর প্রামত্মরে/ লয়ে তার ভীরম্ন দীপশিখা!/ দিগমেত্মর কোন্ পারে চলে গেল আমার ক্ষণিকা।
রবীন্দ্রনাথ মানেই পরিপূর্ণ কবি। যার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যমত্ম একজন মানুষের সকল দিকের আনাগোনা। তিনিই একমাত্র কবি বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কাছে, যিনি নতুন মত নতুন পথ তৈরি করেছিলেন তাঁর কবিতার পঙতিতে পঙতিতে। উদাহরণ দেয়ার মত শত শত কবিতা খুঁজে পাওয়া যাবে, যেখানে তিনি নতুন আলোয় হেসে উঠেছেন নিজের অজামেত্মই। যাবার দিন শীর্ষক কবিতায় আমাদের আরাধ্য কবি গুরম্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই -/ যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।/ এই জ্যোতিসমুদ্র মাঝে যে শতদল পদ্ম রাজে/ তারি মধু পান করেছি, ধন্য আমি তাই।/ যাবার দিনে এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।/ বিশ্বরূপের খেলাঘরে কতই গেলেম খেলে,/ অপরূপকে দেখে গেলেম দুটি নয়ন মেলে।/ পরশ যাঁরে যায় না করা সকল দেহে দিলেন ধরা,/ এইখানে শেষ করেন যদি শেষ করে দিন তাই -/ যাবার বেলা এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।।
কার্ল মার্কসের ভারত প্রসঙ্গকথা নিয়ে আমরা আমাদের কবিগুরম্নর কাব্যজ জীবন নিয়ে এগিয়ে গেলে দেখতে পাবো, মার্কস ভারতে ইংরেজ-প্রবর্তিত আধুনিক ব্যবস্থার পত্তন, স্থবির সনাতন সমাজ ভাঙা ইত্যাদি প্রসঙ্গে সাধুবাদ জানিয়ে ও ভারতে উপনিবেশবাদী ইংরেজ শাসন-শোষণের ভয়ংকর রূপটির সমালোচনা করতে ভোলেননি এবং এ-অবস্থা থেকে ভারতীয়দের সংগ্রাম ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ করেছিলেন। যেখানে ভালোবাসা এসেছে সাহসের সাথে। কেননা, ভালোবাসাহীন কোন বীর তার বীরত্বই প্রমাণ করতে পারে না। বীরের জন্যও ভালোবাসার রঙিন ভূবন প্রয়োজন হয়। আর সেই সাহসময় ভালোবাসার রঙিন ভূবনের বাসিন্দা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবিতায়-কথায় তিনি তুলে এনেছেন ভালোবাসার মুখ। সাহসের বীজ বুনেছেন ভালোবাসার জলসহ। দায়মোচন কবিতায় কবির সেই সাহসজলের প্রেমজ বুননের প্রমাণ উঠে এসেছে। কবিতার রাজা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, চিরকাল রবে মোর প্রেমের কাঙাল,/ এ কথা বলিতে চাও বোলো।/ এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল -/ তার পরে যদি তুমি ভোল/ মনে করাব না আমি শপথ তোমার,/ আসা যাওয়া দু দিকেই খোলা রবে দ্বার -/ যাবার সময় হলে যেয়ো সহজেই,/ আবার আসিতে হয় এসো।/ সংশয় যদি রয় তাহে ক্ষতি নেই,/ তবু ভালোবাস যদি বেসো।/ বন্ধু, তোমার পথ সম্মুখে জানি,/ পশ্চাতে আমি আছি বাঁধা।/ অশ্রু নয়নে বৃথা শিরে কর হানি/ যাত্রায় নাহি দিব বাধা।/ আমি তব জীবনের লক্ষ্য তো নহি,/ ভুলিতে ভুলিতে যাবে হে চিরবিরহী,/ তোমার যা দান তাহা রহিবে নবীন/ আমার স্মৃতির আঁখিজলে -/ আমার যা দান সেও জেনো চিরদিন/ রবে তব বিস্মৃতিতলে।/ দূরে চলে যেতে যেতে দ্বিধা করি মনে/ যদি কভু চেয়ে দেখ ফিরে,/ হয়তো দেখিবে আমি শূন্য শয়নে -/ নয়ন সিক্ত আঁখিনীরে।/ মার্জনা কর যদি পাব তবে বল,/ করম্নণা করিলে নাহি ঘোচে আঁখিজল -/ সত্য যা দিয়েছিলে থাক্ মোর তাই,/ দিবে লাজ তার বেশি দিলে।/ দুঃখ বাঁচাতে যদি কোনোমতে চাই/ দুঃখের মূল্য না মিলে।/ দুর্বল মস্নান করে নিজ অধিকার/ বরমাল্যের অপমানে।/ যে পারে সহজে নিতে যোগ্য সে তার,/ চেয়ে নিতে সে কভু না জানে।/ প্রেমেরে বাড়াতে গিয়ে মিশাব না ফাঁকি,/ সীমারে মানিয়া তার মর্যাদা রাখি -/ যা পেয়েছি সেই মোর অক্ষয় ধন,/ যা পাইনি বড়ো সেই নয়।/ চিত্ত ভরিয়া রবে ক্ষণিক মিলন/ চিরবিচ্ছেদ করি জয়।
বিচ্ছেদ দূর করার এই চেষ্টাকারী কবির নাম রবীন্দ্রনাথ। যিনি আজীবন চেষ্টা করেছেন ভালোবাসার সাথে থাকতে। আর তাই তাঁর কবিতায় আমরা পাই ভালোবাসার রঙিন ফুল। এই ফুলের ঘ্রাণে সুরভিত হোক রবীন্দ্রপ্রিয় সকলের সামনের দিনগুলো। এমন প্রত্যয় যখন নতুন করে আসে প্রতিনিয়ত। তখন রবীন্দ্রনাথ হন আমাদের আরাধনা-সাধনা। চির-আমি কবিতার রঙিন জমিনে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুলে এনেছেন ভালোলাগা গহীন ভূবন। লিখেছেন, যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,/ বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,/ চুকিয়ে দেব বেচা-কেনা, মিটিয়ে দেব লেনা-দেনা/ বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে -/ আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,/ তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।/ যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়,/ কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়,/ ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বনবাসের,/ শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায় -/ আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,/ তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।/ যখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে,/ কাটবে গো দিন যেমন আজও দিন কাটে।/ ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী এমনি সেদিন উঠবে ভরি,/ চরবে গোরম্ন, খেলবে রাখাল ওই মাঠে।/ আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,/ তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।/ তখন কে বলে গো, সেই প্রভাতে নেই আমি?/ সকল খেলায় করবে খেলা এই-আমি।/ নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে,/ আসব যাব চিরদিনের সেই-আমি।/ আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,/ তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।
শেষের কবিতায় আলো লাগা ভালো লাগার যে পাল তুলেছেন কবি গুরম্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; সে পালে বাতাস লেগে লেগে আজো অনবদ্য আমাদের আলোকিত ভালোলাগার নাও। অনন্য এই ভালোলাগার রঙিন পাল দেখে যে কোন কাব্যজ মানুষ মনের সকল সমস্যার রাসত্মা এড়িয়ে উচ্চারণ করে উঠবেন, কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?/ তারি রথ নিত্য উধাও।/ জাগিছে অমত্মরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন/ চক্রে পিষ্ট আধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।/ ওগো বন্ধু,/ সেই ধাবমান কাল/ জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল তুলে নিল দ্রম্নতরথে/ দু’সাহসী ভ্রমনের পথে/ তোমা হতে বহু দূরে।/ মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে/ পার হয়ে আসিলাম/ আজি নব প্রভাতের শিখর চুড়ায়;/ রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়/ আমার পুরানো নাম।/ ফিরিবার পথ নাহি…
গানে-কবিতায় আমাদেরকে ভালোবাসায় মগ্ন করে রেখেছেন একমাত্র রবীন্দ্রনাথ। তাঁর গান না হলে যেখানে আমাদের বৈশাখ আসে না, পালিত হয় না বসমত্ম উৎসব; সেখানে জামায়াত-শিবিরের হায়েনারা রেঙে উঠছে কালোমেঘের রঙে। তারা চায় তাদের কালো সংস্কৃতি আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে। যুদ্ধাপরাধী-জামায়াত-শিবিরের পোষ্য তথাকথিত কবিদের রবীন্দ্রনাথ বিরোধী আষ্ফালন। এই আষ্ফালনের বিরম্নদ্ধে কবি রবীন্দ্রনাথের কবিতার মত করেই জেগে ওঠার আমন্ত্রণ সকল সাহসকবিতার রঙিন মানুষদের কাছে। যারা জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসে কবিতা- দেশ-মানুষ আর প্রকৃতি। আমাদের মধ্যে যারা জীবনকে যুদ্ধÿÿত্র মনে করে, যারা জীবনকে বেঁধে রেখেছেন ভালোবাসায়-কবিতায় আর সাহসের সাথে। তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে কবিগুরম্নর কাব্যজ মিলনায়তনে। যাতে করে আর কোন দেশ বিরোধী চক্র আমাদের জাতীয় সঙ্গীতকে পরিবর্তনের কথা বলার সাহস না রাখে…
Email:mominmahdi@gmail.com; website: www.mominmahadi.com