আদিবাসী খাসিয়াঃ গভীর বনের পানপুঞ্জি হুমকির মুখে
সুমন দে, সিলেট প্রতিনিধি,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ চেনা জগতের বাইরে অন্য এক সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবন। সেখানে চোখে মায়া ধরানো নরম সবুজ গোলগাল পাতার অর্থকরী গুরুত্বটাও আমরা বুঝতে পারি। এই পান চাষের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন মূলত আদিবাসী খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন।একদল মানুষ যারা যুগ যুগ ধরে পাহাড়ের গভীর বনে গড়ে তুলছে পানপুঞ্জি, পানজুম। সেখানে টিলার ওপর আছে ছোট ছোট ঘর। কিছু পুঞ্জিতে দু’একটি গারো ও বাঙালি পরিবার আছে। তবে মূল পানচাষি হচ্ছেন খাসিয়ারাই। প্রতিটি পুঞ্জিরই একজন করে মন্ত্রী বা পুঞ্জিপ্রধান আছেন। একেকটি পুঞ্জিতে ৩০, ৪০ ও ৫০ ঘর আদিবাসী খাসিয়ার বাস। তাদের উৎপাদিত পানের নামও হচ্ছে ‘খাসিয়া পান’।
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, বড়লেখা, জুড়ী ও রাজনগর উপজেলায় ছোটবড় প্রায় ৬৫টি পানপুঞ্জি আছে। আর এসব পানপুঞ্জিতে প্রায় দশ হাজার আদিবাসী খাসিয়ার বসবাস। এর বাইরে সিলেট জেলার জৈন্তা, সুনামগঞ্জের মেঘালয়ঘেঁষা সীমান্ত এবং হবিগঞ্জ জেলার পাহাড়ি এলাকায় খাসিয়াদের গড়ে তোলা পানপুঞ্জি আছে। আমরা যতটুকু জানি, এই খাসিয়ারা ঐতিহ্যগতভাবে উত্তরাধিকার সূত্রে বনভূমিতে পান চাষের মাধ্যমে জীবিকা চালিয়ে আসছে। এই পানপুঞ্জিতে যারা বসবাস করছেন, যারা পান শ্রমিক হিসেবে পরিচিত, তাদের অনেকেই ভালো বাংলা বলতে পারেন না। মূল স্রোতধারা থেকে তারা অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। তবে যারা পুঞ্জির মালিক, যাদের মন্ত্রী বা পুঞ্জিপ্রধান বলা হয়, তারা কেউ কেউ হয়তো উন্নত, আধুনিক জীবনযাপন করেন। কিন্তু এই কিছু লোকের উন্নত জীবনযাপন আদিবাসী খাসিয়াদের উন্নত জীবনযাপনের কোনো চিত্র নয়। এখনও অধিকাংশ আদিবাসী খাসিয়াই সহজ-সরল। সমতল ভূমির মানুষের জটিল জীবনধারার সঙ্গে হয়তো এখনও মানিয়ে নেওয়ার মতো দক্ষ হয়ে ওঠেনি তারা (মনে হয় জটিল হওয়ার দরকারও নেই। কারণ এসব সরল মানুষ হারিয়ে গেলে সরলতার শিক্ষা পাওয়ার জায়গাগুলোও ফুরিয়ে যেতে পারে)। জৈন্তাপুর উপজেলায়, মুকামপুঞ্জি, শ্রীপুর, খাসিয়াহাটি ইত্যাদি এসব পুঞ্জিতে নুন্যতম প্রায় ১১ হাজার একর ভূমিতে চাষ হচ্ছে খাসিয়া পান। যা থেকে আয় হচ্ছে বছরে প্রায় কয়েক শত কোটি টাকা। গত মৌসুমেও বিদেশে রপ্তানী করে এ পরিমাণ টাকা আয় হয়। কিন্তু বৈরী আবহাওয়া এ মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও যুক্তরাজ্যের বাজারে খাসিয়া পানের কদর অত্যাধিক। এছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশেই কম-বেশি খাসিয়া পান রপ্তানী করা হয়। জৈন্তাপুর উপজেলায় খাসিয়া পান পুঞ্জিগুলোকে প্রকৃতিগতভাবেই খাসিয়া পান চাষ করা হয়। পান জুমে কোন প্রকার কীটনাশক ও সার ব্যবহার করা হয় না। এখন পানের ভরা মৌসুম। কিন্তু সময়মতো পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হবার কারণে এখনো পানের উৎপাদন আশানুরূপ নয়। তার উপর পানের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলেও বাজার মূল্য আশাতীত নয়। এছাড়া অধিকাংশ পান জুমের পানগুলো হলদে রং ধারন করায় পান চাষিরা পড়েছের দূর্ভাবনায়। গত মৌসুমের শেষের দিকেও প্রতি কান্তা (১২০টি পান) খাসিয়া পানের বাজার মূল্য ছিল কমপক্ষে ৭০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে খাসিয়া পানের উৎপাদন হ্রাস ও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি সত্ত্বেও প্রতি কান্তার (১২০টি পান) বাজার মূল্য মাত্র ৪০ থেকে ৫০ টাকা। তারা জানান, উৎপাদন গত মৌসুমের মতো হলে এ মূল্য হ্রাসও তাদের কোন সমস্যার কারণ ছিলো না। এছাড়া চলতি মৌসুমে অজ্ঞাত কারণে পান জুমগুলোতে উৎপাদিত বেশীর ভাগ পানের রং হলদে হয়ে যাওয়ায় পানের বাজার মূল্য আরো কমছে। অনেক সময় বাজারে খাসিয়া পান বিক্রি করে পান পুঞ্জি থেকে বাজারে পান নিয়ে যাওয়ার পরিবহন খরচও উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থা কয়েক মাস অব্যাহত থাকলে আদিবাসী খাসিয়াদের বিকল্প জীবিকার সন্ধানে নামতে হতে পারে বলে জানান তারা।
পান সংগ্রহ ও অন্যান্য কাজে খাসিয়া সদস্যদের সহায়তা করার জন্য প্রতিটি পান জুমে দৈনিক ১২০ থেকে ১৫০ টাকা মজুরীতে শ্রমিক (পান সংগ্রহকারী) রাখতে হয়। জুমের আকার ও আয়তন হিসেবে প্রতিটি জুমে ২ থেকে ৫ জন পর্যন্ত শ্রমিক রাখা আবশ্যক। একজন পান সংগ্রহকারী শ্রমিক প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ কান্তা (প্রতি কান্তায় ১২০টি পান) পান সংগ্রহ করতে পারে। ৪০ থেকে ৫০ কান্তা পানে হয় এক খাঁচা। বর্তমান মৌসুমের শুরুতেই প্রকৃতিক বৈরীতার কারণে পানের উৎপাদনে ধ্বস নামায় এবং পান হলদে হয়ে যাওয়ায় এখন একজন শ্রমিক গড়ে ৩ কান্তা পান সংগ্রহ করতে পারে। যা থেকে হয় এক খাঁচা পান। এ কারণে পানের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও সে অনুপাতে পাওয়া যাচ্ছে না বাজার মূল্য।
তবে অনেকদিন ধরে লক্ষ্য করেছি, পানচাষের সঙ্গে যুক্ত আদিবাসীদের নিয়ে সমতলের মানুষের ধারণাটা খুব ভালো বা স্বচ্ছ নয়। কমবেশি সবাই মনে করেন, আদিবাসী হওয়ার সুবাদে তারা সরকারি বনভূমি দখল করে নিচ্ছে। পানচাষ করে লাখ লাখ টাকা মুনাফা করছে। সে টাকা তারা দেশে রাখে না। বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। সরকারের বিশাল বন দখল করে তারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। পান একটি অর্থকরী ফসল, এটা হয়তো ঠিকই আছে। হয়তো এ কারণে এই পানপুঞ্জির দিকে কারো কারো লোভের চোখও থাকতে পারে। কিন্তু এ রকম একটি ধারণা কেন প্রচার হয়েছে, মনে হয় আদিবাসী নেতাদের সেটা ভেবে দেখার দরকার আছে। অন্তর্মুখী জীবন পদ্ধতির কারণে সাধারণ আদিবাসীদের জীবন যন্ত্রণার অনেক খবরই সমতলের মানুষের জানা নেই। আর এই প্রচারটার সুযোগ নেয় যারা, পানের বাণিজ্য কিংবা পানচাষের জায়গাকে মুঠোয় পুরতে আগ্রহী তারা।
আদিবাসী খাসিয়াদের সঙ্গে কথা বললে তারা একটা কথা সহজভাবেই বলেন, তারা প্রকৃতির সন্তান। বনই তাদের জীবন ও জীবিকা। মনে হয়, এটা কোনো বানানো কথা নয়। তাদের কথা থেকে বোঝা যায়, প্রতিনিয়ত তাদের বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। আদিবাসীরা বলেছেন, অনেক সময় প্রভাবশালীদের হাতি, গরু, মহিষ দ্বারা পান বাগান বিনষ্ট হচ্ছে। গাছচোর ও অবৈধ কাঠ ব্যবসায়ীদের দ্বারা হয়রানিসহ নানামুখী সমস্যা তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এছাড়াও দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় তাদের বাস। সেখানে কোনো বিদ্যালয় নেই। পড়ালেখা করতে গেলে তাদের শহরে আসতে হয়। শহরে এসে লেখাপড়া করতে গেলে তখন আবাসিক সংকট থাকে। যে কারণে অধিকাংশ আদিবাসী খাসিয়া পরিবারের সন্তানের পক্ষে লেখাপড়া করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এমনকি তাদের মাতৃভাষাটারও সুরক্ষা হচ্ছে না। অন্যদিকে রয়েছে চিকিৎসা সংকট। পানপুঞ্জি এলাকায় কোনো চিকিৎসা সুবিধা নেই। চিকিৎসার জন্য খাসিয়াদের ন্যূনতম উপজেলা সদরে আসতে হয়। উপজেলা সদর পাহাড় থেকে অনেক দূর। এক্ষেত্রে পাহাড়ি দুর্গম রাস্তা হওয়ায় কোনো গণপরিবহন ব্যবস্থা নেই। কাউকে আসতে হলে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থায় আসতে হয়, যা ব্যয়বহুল। অনেকের পক্ষে আর্থিক কারণে চিকিৎসা সুবিধা গ্রহণ সম্ভব হয়ে ওঠে না।
তারা এটাও বলেন, যুগ যুগ ধরে বনে বাস করলেও ভূমির মালিকানা তাদের নেই। পুঞ্জির মন্ত্রী বা প্রধান যারা ছিলেন, আদিবাসী সংস্কৃতির সঙ্গে মিলে না বলেই হয়তো তারা জমি ভোগ করলেও জমির দলিলপত্র সংগ্রহ বা জমির ওপর তাদের স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। দলিলের ধারণাটাই তাদের ছিল না। যে কারণে অনেক জমি তাদের বেহাত হয়েছে। অনেক জমি নিয়ে বন বিভাগের সঙ্গে দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। বন বিভাগ মনে করে, তারা বন বিভাগের ভূমি দখল করে নিয়েছে। পানচাষের জন্য গাছ কেটে বন উজাড় করছে। বন বিভাগের অনেকের সঙ্গে কথা বলেও এ রকম ধারণা পাওয়া যায়। বন বিভাগের কোনো কোনো কর্মকর্তা তো আদিবাসীদের নাম শুনলেই জ্বলে ওঠেন। কারো কথা শুনলে মনে হতে পারে, আদিবাসীরাই হয়তো বিশাল বনভূমি উজাড় করেছেন। এখানে আর কারো হাত নেই। বন কর্মকর্তারা বনের জমি রক্ষা করবেন, গাছ রক্ষা করবেন। সেদিক দিয়ে তারা হয়তো দখল ধারণাটাকেই বড় করে দেখবেন। তাদের দিক থেকে এই জ্বলে ওঠার হয়তো একটা যুক্তিও আছে। আবার কোনো কোনো চা বাগানের সঙ্গেও পুঞ্জির এই আদিবাসীদের টক্কর লেগে যাচ্ছে। প্রায়ই শোনা যায় চা বাগানের জমিতে খাসিয়ারা পানচাষ করছে। কোনো কোনো বাগান কর্তৃপক্ষ চা বাগানের জমি দাবি করে পানপুঞ্জির গাছ কাটার চেষ্টা করছে। এ নিয়ে বেশ হৈচৈ হচ্ছে। বনের ভেতর প্রতিবেশীর সুসম্পর্ক ভেঙে পড়ছে।
এই যে আদিবাসী, বন ও চা বাগানের নিয়মিত সমস্যা, তা কেন যে বছরের পর বছর ধরে জিইয়ে রাখা হয়েছে, তা একটা রহস্য। সহজ করে আমরা বুঝি, সবাই একই রাষ্ট্রের জল-হাওয়ার সমান অংশীদার। এটা একটা দিক। অন্যদিকে প্রতিটি নৃতাত্ত্বিক সমাজের নিজেদের মতো একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। সেদিকটাকে গুরুত্ব দিয়ে বোঝার কারণ আছে। সংস্কৃতির এই বাস্তবতাটা সরলীকরণ করে দেখা হয় বলেই হয়তো অনেক সময় বিপত্তি ঘটে। রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠীর আচার-আচরণ উপলব্ধি করার দরকার আছে। বুঝতে হবে, বন বিভাগের ভূমি কেন আদিবাসীরা দখল করবে, কেনই-বা আদিবাসী খাসিয়ারা তাদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে সংকটে ভুগবে। কেন মানসিক নিরাপত্তাবোধ বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
দীর্ঘদিন ধরে এই সংকট কেন চলমান থাকবে! তার একটা সুরাহা দরকার। আদিবাসীদের পানপুঞ্জির জায়গাটুকুর সীমারেখা টেনে ওই ভূমির ওপর তাদের অধিকার দেওয়া যায় না! অন্যান্য নাগরিকের সুযোগ-সুবিধা যা-ই আছে, তাদের মতো সেই সুযোগ-সুবিধা দিতে সমস্যা কোথায়! এর জন্য একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা, দর্শন তৈরির প্রয়োজন আছে। কাউকে ছোট বা কাউকে বড় করার জন্য নয়, যার যার সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ও জীবিকাকে গুরুত্ব বা মর্যাদা দিয়ে ভাবলে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেটা কমে আসবে বলেই মনে হয়। সমস্যাটা চিহ্নিত ও সমাধানের পথ খুঁজতে ‘প্রকৃতির সন্তান’ এই ধারণাটাই অনেক। আর যেহেতু ভূমি, বন ও মানুষ রাষ্ট্র বা সরকারের, রাষ্ট্রকেই এক্ষেত্রে হতে হবে মাতৃহৃদয়ের মতো উদার, সহনশীল, সৃজনশীল পরিকল্পক ও বাস্তবায়নকারী। যাতে করে গাছ থাকবে, বন থাকবে, পান থাকবে, আদিবাসীরা থাকবে। শুধু বিরোধ বা সাংঘর্ষিক পরিবেশ থাকবে না।