আপনি মোড়ল ও বিশ্ব গাড়ল!
সাযযাদ কাদিরঃ রাজশাহী থেকে শামীম হোসেনের সম্পাদনায় বেরোয় ‘শিল্প সাহিত্যের ছোটকাগজ’ নদী। এ পর্যন্ত বেরিয়েছে ১১টি সংখ্যা। সর্বশেষ সংখ্যা এপ্রিল ২০১২ হাতে পেলাম এই মাত্র। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ। মোহাম্মদ নূরুল হক লিখেছেন, “… কবিতার সবচেয়ে বড় শত্রু ‘উপকবি’। এ উপকবিই পাঠকমনে কবিতা সম্পর্কে বিরূপ ধারণার জন্ম দেয়ার জন্য দায়ী। তাই ‘উপকবি’কে কবির ছায়ার নিচে মাড়িয়ে দিলে সে ছায়া থেকে বড় কবির আত্ম-উদ্বোধন সম্ভব।” প্রবন্ধকার ‘উপকবি’র পরিচয় একটু খোলাসা করে দিলে বেশ উপকার হতো আমার। সাহিত্যজগতে এই উপগ্রহ ধরনের কিছু প্রাণীকে দেখা যায় সবসময়েই। এরা প্রচার-প্রকাশ মাধ্যমগুলো এক প্রকার দখল করেই রাখে, আর পুরস্কার-পদক সব বাগায় অবলীলাক্রমে। তবে এ জেল্লা বেশি দিন থাকে না তাদের। কিছু দিন পর অন্য উপগ্রহরা ঢুকে পড়ে ক্রমে-ক্রমে। আমরা ‘উপগ্রহ’ বলি যাদের – মোহাম্মদ নূরুল হক তাদেরই ‘উপকবি’ বলছেন না কিনা তা বুঝতে পারতাম যদি বর্ণনায় একটু বিশদ হতেন তিনি। আমরা অবশ্য কখনওই উপগ্রহদের দাপট ও চোটপাট নিয়ে ভাবি নি কিছু, কারণ আমাদের বরাবরই ধারণা – স্রোতে মরা মাছই ভাসে।
নদীর এ সংখ্যার বিশেষ চমৎকারিত্ব দু’ পর্বের সম্পাদকীয়। এর শিরোনামটিও সে চমৎকারিত্বের এক বিশেষ অংশ: “কোনো অধ্যাপকীয় কিংবা মোড়লীয় মনোভাব নিয়ে এই সম্পাদকীয় পড়বেন না”। এতে বলা হয়েছে ‘আনুকূল্য ও করুণালোভী’দের কথা, ‘শক্তিশালী লেখক’দের দংশনকারী ‘সুযোগসন্ধানী সাপ’দের কথা। মনে হয় এদের কাউকে-কাউকে আমি চিনি। কারও-কারও আনুকূল্য পেতে ওই ‘সাপ’গুলি দেখলাম আপনি মোড়ল সেজে তকমা বিলিয়ে বেড়াচ্ছে বেছে-বেছে। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ওই ‘অধ্যাপকীয়’ চরিত্ররা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে চাকরি বাগিয়ে এদের কেউ-কেউ ভাবছে, এই বাগানোর যোগ্যতাই বুঝি সব কিছু বলা বা লেখার যোগ্যতা। তাই লিখতে গিয়ে প্রমাণ করছে তারা আদি ও অকৃত্রিম গাড়ল। বিশ্ব গাড়ল। ওই আপনি মোড়লদের মতোই। এদের মোড়লি-গাড়লি বেশি ধরা পড়েছে যখন ষাটের দশকের কবি ও কবিতা নিয়ে কি সব লিখেছে তারা। ওই দশক সম্পর্কে আবছা ধারণা, পড়াশোনার অভাব ছাড়াও ওই ধান্দাবাজদের মতলববাজি স্পষ্ট বোঝা যায় তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মন্তব্য-মূল্যায়ন পড়লেই। অথচ ওই দশকের সাহিত্যিক দলিলপত্র দুর্লভ নয় একেবারে, ওই সময়ের প্রতিনিধিস্থানীয় কবি-সাহিত্যিকদের অনেকে জীবিত আছেন এখনও। ওই সব দলিলপত্র সংগ্রহ করে, ব্যক্তিত্বদের সাক্ষাৎকার নিয়ে কিছু লেখে নি এই মোড়ল-গাড়লদের কেউ, তা লিখলে তো ধান্দা হয় না, মতলব হাসিল হয় না, ‘আনুকূল্য ও করুণা’ পেতে ‘দংশন’ করা হয় না।
গত শতকের ষাটের দশক অন্যান্য দশকের চেয়ে একটু দীর্ঘ। ১৯৬০ সালে শুরু হয়ে ১৯৬৯ সালে শেষ না হয়ে পাড়ি দিয়েছে ১৯৭০ সালও। পৌঁছেছে ১৯৭১-এর মার্চ পর্যন্ত। অন্যান্য দশকের সঙ্গে হিসাবে আমাদের এ ভিন্নতার কারণ মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের সূচনা বায়ান্নতে হলেও ষাটে মোকাবেলা পৌঁছেছিল চরমে। ফলে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন থেকে স্বাধিকারের সংগ্রাম হয়ে স্বাধীনতার লড়াইয়ে পূর্ণতা পায় এই এক দশকেই। ওই সময় রাজনীতির সঙ্গে-সঙ্গে দ্রোহ ছড়িয়ে গিয়েছিল সাহিত্য-সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রেই। কেবল আমাদের দেশে নয়, পৃথিবী জুড়েই। ঘরের কাছে পশ্চিমবঙ্গে তখন চলছিল নকশালবাড়ি আন্দোলন, চলছিল চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব, ফ্রান্সে ছাত্র-শ্রমিকদের প্রতিবাদ-সংগ্রাম, যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম বিরোধী শান্তি আন্দোলন, এশিয়া আফরিকা লাতিন আমেরিকায় উপনিবেশবাদ বিরোধী লড়াই, প্যালেস্টাইন আলজেরিয়া কিউবা লাওস কমবোডিয়া ইনদোনেশিয়ায় – দেশে-দেশে জনযুদ্ধ। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সকল শাখায় প্রবল প্রভাব পড়ে এই মুখর অস্থিরতায়। সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটক, চিত্রকলা – সবকিছুতে প্রতিষ্ঠা পায় প্রতিষ্ঠা-বিরোধিতা, নিয়ম ভাঙার নিয়ম। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ষাটের দশক বা ‘দ্য সিঙটিস্’-এর সময়কাল অবশ্য ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত – গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উদ্ভব, বিকাশ ও পরিণতির নিরিখে। সংক্ষেপে একটি বিবরণ দেয়া যাক সেই ষাটের:
“… The 1960s term also refers to an era more often called The Sixties, denoting the complex of inter-related cultural and political trends across the globe. This “cultural decade” is more loosely defined than the actual decade, beginning around 1963 and ending around 1974.
… “the Sixties”, as they are known in popular culture, is a term used by historians, journalists, and other objective academics; in some cases nostalgically to describe the counterculture and social revolution near the end of the decade; and pejoratively to describe the era as one of irresponsible excess and flamboyance. The decade was also labeled the Swinging Sixties because of the fall or relaxation of some social taboos especially relating to sexism and racism that occurred during this time.
The 1960s have become synonymous with the new, radical, and subversive events and trends of the period, which continued to develop in the 1970s, 1980s, 1990s and beyond. In Africa the 1960s was a period of radical political change as 32 countries gained independence from their European colonial rulers.
Some commentators have seen in this era a classical Jungian nightmare cycle, where a rigid culture, unable to contain the demands for greater individual freedom, broke free of the social constraints of the previous age through extreme deviation from the norm. Christopher Booker charts the rise, success, fall/nightmare and explosion in the London scene of the 1960s. This does not alone however explain the mass nature of the phenomenon.
Several governments turned to the left in the early 1960s. In the United States, John F. Kennedy, a Keynesian and staunch anti-communist, pushed for social reforms such as civil rights for African Americans and healthcare for the elderly and the poor. He was elected to the Presidency, also pledging to land a man on the Moon by the end of the decade, a feat that was accomplished in 1969. Italy formed its first left-of-centre government in March 1962 with a coalition of Christian Democrats, Social Democrats, and moderate Republicans. Socialists joined the ruling block in December 1963. In Britain, the Labour Party gained power in 1964. In Brazil, João Goulart became president after Jânio Quadros resigned….”
এ দেশের পরিস্থিতি তখন কেমন ছিল তার একটা বিবরণ দিয়েছেন সমালোচক-গবেষক মানবর্দ্ধন পাল: “… সে সময়ের রাষ্ট্র-রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, অর্থনীতি-বাণিজ্য, উৎপাদন-বণ্টন – এক কথায় সমাজের অন্তর্কাঠামো এবং উপরিকাঠামো – সর্বত্রই জন-অগ্নিগিরির লাভায় উত্তপ্ত, গণবিদ্রোহের ভূমিকম্পে টলটলায়মান। স্বৈরশাসিত রাষ্ট্র ও রাজনীতির প্রতিক্রিয়াশীলতা, দুর্বৃত্তায়িত প্রশাসনের নির্যাতন, পূর্ববাংলায় বৈষম্য ও শোষণমূলক ব্যবস্থা স্থায়ীকরণের অপচেষ্টা, শৃঙ্খলিত সংস্কৃতি, পদদলিত মানবাধিকার ইত্যাদিতে এ দেশের মানুষের জীবনে এক দিকে মুমূর্ষুর নাভিশ্বাস, অন্যদিকে হতাশার কালো গহ্বরে নিমজ্জন।… ষাটদশকী এই জাতীয় দুর্যোগের সৃজন-বেদনকালে বেহিসেবি-বেপরোয়া একদল তরুণ কবি-লেখকদের আবির্ভাব ঘটেছিল। ওঁরা এসেছিল সেইভাবে যেভাবে আগুন-লাগা স্থানে চারদিক থেকে হু-হু করে বাতাস বইতে থাকে। এই অদম্য-অসহিষ্ণু এবং দুর্বিনীত লেখক-কবিকুল ছিল ষাটদশকী সমাজজীবন ও শিল্প-সাহিত্যে অনেক অঘটন ঘটনের ক্রীড়নক। কিংবা বলা যেতে পারে, সময়ের মার, কালের চাবুক এবং যুগের প্রহার তাঁদের মধ্যে যে উপপ্লবের সৃষ্টি করেছিল তারই বিষামৃত তাঁরা উদগীরণ করেছিলেন সে সময়ের পত্রপত্রিকায়, লিটলম্যাগে – বিকল্পধারার সাহিত্য-বাহনে। চিন্তায়-চরিত্রে, ভাবনায়-বক্তব্যে, ভাষায়-প্রকাশভঙ্গিতে এঁরা ছিলেন প্রচলিত সমাজজীবন বিগর্হিত। যুগের যন্ত্রণায় এবং কালের কালবিষে তাঁরা এমনই জর্জরিত যে, কোনও ধরনের শুভবোধ, কল্যাণধর্ম ও মানবিক মঙ্গলচিন্তার বিপরীতে জীবনবিধ্বংসী হতাশা-শূন্যতা, আত্মপীড়ন-অন্ধকার বন্দনা ও যৌনতা-পাপাচারই এঁদের একমাত্র আরাধ্য হয়ে ওঠে।…” (‘মহাদেব সাহা:কবির আঙুলে কত জাদু’, কলি প্রকাশনী, ২০১২)
এই প্রথা ও প্রতিষ্ঠাবিরোধী সাহিত্যধারার জয়ধ্বজাবাহী মুখপত্র ‘কণ্ঠস্বর’-এ এক ঘোষণাপত্রে ষাটদশকী কবি-লেখকদের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছিল ‘সাহিত্যের সনিষ্ঠ প্রেমিক, … শিল্পে উন্মোচিত, সৎ, অকপট, রক্তাক্ত, শব্দতাড়িত, যন্ত্রণাকাতর, … উন্মাদ, অপচয়ী, বিকারগ্রস্ত, অসন্তুষ্ট, বিবরবাসী, তরুণ, প্রতিভাবান, অপ্রতিষ্ঠিত, শ্রদ্ধাশীল, অনুপ্রাণিত,… পঙ্গু, অহঙ্কারী, যৌনতাস্পৃষ্ট’ হিসেবে। ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছিল ‘প্রবীণ মোড়ল, নবীন অধ্যাপক, পেশাদার লেখক, মূর্খ সাংবাদিক, পবিত্র সাহিত্যিক, গৃহপালিত সমালোচক’দের বিরুদ্ধে।
এখন সেই প্রথা ও প্রতিষ্ঠাবিরোধীরা কে কোথায় কি করছেন – সে খোঁজখবর বিশেষভাবে নেয়া দরকার। কারা আপস করেছেন, কারা করেন নি – তা দেখতে হবে। কারা ভঙ্গিসর্বস্ব চটকদারি করেছেন, আর কারা ছিলেন প্রকৃত অঙ্গীকারবদ্ধ – তা জানতে হবে। নাহলে আপনি মোড়ল ও বিশ্ব গাড়লরা কোন মতলবে কি ধান্দা করছে তা স্পষ্ট হবে না অনেকের কাছে।
সাযযাদ কাদিরঃ সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।।