সেই এক এসডিও
সাযযাদ কাদিরঃ ময়মনসিংহ জেলার অন্যতম মহকুমা (সাবডিভিশন) হিসেবে টাঙ্গাইলের আত্মপ্রকাশ ১৮৭০ সালে। এর ৯৯ বছর পর, ১৯৬৯ সালে, এর নতুন পরিচয় ঘটে জেলা হিসেবে। তা হলেও মহকুমা প্রশাসন অব্যাহত ছিল আশির দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন টাঙ্গাইলের মহকুমা কর্মকর্তা/প্রশাসক (সাবডিভিশনাল অফিসার-এসডিও)। বাংলাদেশে ভারতের প্রথম হাইকমিশনার সুবিমল দত্ত টাঙ্গাইলের এসডিও ছিলেন বৃটিশ আমলে। স্বাধীনতার পর ঢাকায় আসার কিছু দিন পর গিয়েছিলেন টাঙ্গাইলে। ঘুরেফিরে দেখেছেন শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এসডিও সাহেবের সেই লাল রঙের বাংলো বাড়িটি। পাকিস্তান আমলে এসডিও ছিলেন খালেদ শামস, আর শেষের দিকে ছিলেন আমার দুই পরম সুহৃদ নাসিরুদ্দিন আল মনসুর (প্রয়াত) ও অরবিন্দ কর। তবে টাঙ্গাইলবাসীর মনে যিনি এখনও এসডিও হিসেবে জ্বলন্ত হয়ে আছেন তাঁর নাম জি এম কাদরি। অবাঙালি, তবে ভালই বুঝতেন বাংলা। ষাটের দশকে দোর্দণ্ড প্রতাপে তিনি শাসন করেছেন টাঙ্গাইল মহকুমা। সেই প্রতাপ বেশি দেখিয়েছেন নানা আদেশ-নির্দেশ জারি করে, আর আয়ুব-মোনেম বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় সামনের সারির নেতাদের নানা রকম হয়রানিতে জেরবার করে। হয়রানির মধ্যে বেশি ছিল আজেবাজে মামলায় জড়িয়ে হেনস্তা করা। এমনিতে সভা-সমাবেশ করা প্রায় অসম্ভব ছিল তখন। জি এম কাদরি ১৪৪ ধারা জারি করে দিতেন প্রস্তাবিত সভাস্থলে। মিছিল করা যেতো না। একসঙ্গে পাঁচজনের চলাচল নিষিদ্ধ করে দিতেন। ১০-১২ জনকে একসঙ্গে দেখলেই লাঠিচার্জ। ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে প্রধান অতিথি-বিশেষ অতিথি হয়ে এসেছিলেন ‘ইত্তেফাক’-সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও কবি সুফিয়া কামাল। তাঁরা যাতে টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করতে না পারেন সেজন্য পথে-পথে পুলিশ দিয়ে নানা ধরনের বাধা দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন জি এম কাদরি। তাঁদের গাড়ি আটকাবার চেষ্টা করা হয়েছিল নানা জায়গায়। কিন্তু মানিক মিয়া ছিলেন অদম্য। সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে তিনি টাঙ্গাইল পৌঁছেন কয়েক ঘণ্টা দেরিতে। দুপুরশেষে। এর আগেই অনুষ্ঠানে মাইক ব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন জি এম কাদরি। মানিক মিয়া ও সুফিয়া কামাল দু’জনে বক্তৃতা করেন মাইক ছাড়াই। তাঁদের বক্তৃতায়, বলাবাহুল্য, জি এম কাদরি’র স্বেচ্ছাচারিতার প্রসঙ্গ এসেছিল বারবার। মানিক মিয়া বলেছিলেন, ‘তুমি যদি জি এম কাদরি হও, মনে রেখো আমিও মানিক মিয়া। তুমি কত ক্ষমতা ধরো তা আমি দেখবো।’ যদ্দূর মনে পড়ে, ঢাকায় ফিরে টাঙ্গাইলের অভিজ্ঞতা তিনি লিখেছিলেন তাঁর কলামে।
মামলার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল জি এম কাদরি’র। রাজনীতিকদের অপমানিত করে সাজা দিতে ছিল তাঁর পরম উৎসাহ। তখন ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল দেশ। টাঙ্গাইলে বাধা বেশি, আন্দোলনের তীব্রতা – উত্তালতাও বেশি। আন্দোলনরত ছাত্রদের বিরুদ্ধে পুলিশ ছাড়াও হামলা চালাতো দালাল ছাত্রদের সংগঠন জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন- ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন। সংক্ষেপে এনএসএফ। আমরা বলতাম নসফ। ওদের নিয়ে একটা গানও ছিল আমাদের- ‘নসফ দালাল রে…’! চিত্রনায়ক ওয়াসিম (মেসবাহউদ্দিন আহমেদ) ছিলেন ওই সংগঠনের সদস্য। বডিবিল্ডার। মি. ইস্ট পাকিস্তান। ময়মনসিংহ থেকে দলেবলে এসেছিলেন করটিয়া সা’দত কলেজে। কিন্তু সুবিধা হয়নি, বিরোধী ছাত্রনেতা-কর্মীদের প্রচণ্ড পালটা মারের চোটে গুরুতর আহত হওয়ায় জীবন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল তাঁর। এ নিয়ে মামলা হয়, মহাঝামেলায় পড়েন বহু ছাত্রনেতা।
একবার ছাত্রনেতারা কোন ব্যাপারে ডেপুটেশনে গিয়েছিলেন জি এম কাদরি’র অফিসে। অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করে তাঁদের প্রায় তাড়িয়েই দেন তিনি। নেতারাও অবশ্য কথা বলেননি ছেড়ে। পরে জি এম কাদরি তাঁদের সহ আরও কয়েকজনের নামে দেন চুরির মামলা। তাঁরা নাকি তাঁর অফিস থেকে গোপনে সরিয়েছেন অনেক মূল্যবান কাগজপত্র। ওই মামলায় অন্যতম আসামি ছিলেন বর্তমান মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। এ ধরনের অনেক মামলা দিয়ে হয়রানি করা ছিল জি এম কাদরি’র বিশেষ কৌশল। সে সময় এসব মামলা বিনা ফি-তে পরিচালনা করতেন টাঙ্গাইলের বিশিষ্ট আইনজীবী আবদুল আলী সিদ্দিকী (লতিফ সিদ্দিকী-কাদের সিদ্দিকী’র পিতা)। এ কারণে তাঁর আইনজীবীর সনদ বাতিল করে দিয়েছিলেন জি এম কাদরি।
ষাট দশকের সেই আন্দোলনমুখর দিনগুলোর কথা মনে পড়ে নানা কারণেই। অনেক নির্যাতনকারী শাশুড়ি ভুলে যান এক দিন বধূ ছিলেন তিনি, অনেক দুর্ব্যবহারকারী বধূ ভুলে যান একদিন শাশুড়ি হবেন তিনি। আসলে নির্যাতিতরা বিশেষভাবে মনে রাখে নির্যাতনের নানা কৌশল, পরে সেগুলোই প্রয়োগ করে তারা। তাই সেই দোর্দণ্ড এসডিও জি এম কাদরি নেই এ কথা সত্য নয়, গত চার দশক ধরেই তিনি আছেন ভিন্ন-ভিন্ন নামে।
সাযযাদ কাদিরঃ সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।।