কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে দেশের ভবিষ্যত?

কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে দেশের ভবিষ্যত?

– অজয় দাশ গুপ্তঃ

রবীন্দনাথ ও নেহেরুর একখানা চমৎকার ছবি আছে যা জগত আদৃত। ক্ষীর্ণকায় নেহেরু বালকের মতো উপবিষ্ট। বেতের চেয়ারে, মুখোমুখি ইজি চেয়ারে অর্ধ শয়ানরত কবি গুরু। অনেকটা নেহেরুর চোখের সামনে, কিন্তু দুজনের ভঙ্গী ও চেহারায় একাগ্রতা আর তৃপ্তির ছাপ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও নোবেলজয়ী বাঙালি কবির যুগলবন্দি এই ছবিটি তাৎপর্যের। বিশেষত আজকের দিনে। রাজনীতিবিদ ও বাঙালি নোবেল বিজয়ীর আজকের সম্পর্ক! একে অপরের মুন্ডুপাত আর জিঘাংসার শিকার। প্রধানমন্ত্রী ত বটেই যে কোন পাতি মন্ত্রীর মুখোমুখি ওভাবে সাবলীল ভঙ্গিতে বসলেও নিজের পদযুগলের ওঠা নামার প্রতি খেয়াল না রাখলে খবর ছিল। শিলাইদহ তো বটেই হয়তো শান্তি নিকেতন বিক্রি করেই মামলা মোকদ্দমার খরচ যোগাতে হত।

অর্বাচীনতার ঘোর ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে বাঙালি। কে কি বলছেন, কেন বলছেন কেউই বুঝতে পারছেন না। অথচ আম জনতা বা সাধারণ বাঙালির কোন সমস্যা নেই। তাঁরা ঘরে বাইরে, বাজারে হাটে স্ত্রী পুত্র বা অন্য কারো বেলায় আগের মতই আছেন। বদলে গেছেন ক্ষমতার স্পর্শ বা চেয়ার আসীন বাঙালি। মন্ত্রী মিনিস্টার বিরোধী দল বা যেখানেই আসন পাতা হোক না কেন তাঁর ভাষা আজ সৌজন্য বর্জিত, আচরণ দূর্বীনিত। রাজনীতির এমন কদর্য চেহারা আগে কখনো দেখা যায়নি, এটা একেবারে নিশ্চিত তার সর্বগ্রাসী আচরণে সে এখন বেপরোয়া। যে কারণে আমাদের দেশের বরেণ্য সর্বজনশ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদদের পরিবারেও তার প্রভাব পড়ছে। বঙ্গবন্ধুর কথাই ধরা যাক। আজীবন বিপরীত মেরুর রাজনীতিতে থাকার পরও মাওলানা ভাসানীর প্রতি তার শ্রদ্ধায় চিড় ধরেনি, এমন কি মুসলিম লীগের সবুর খানের একত্রে জেল বসবাসের পর ছাড় পাওয়া বঙ্গবন্ধু বিশ্বাসঘাতক সবুর খানের কীর্তির কথা বলতে গিয়ে একটি বারের জন্যও ‘সবুর ভাই’ বলা থেকে বিরত থাকেন নি। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য সুহৃদ ও সহকর্মী সৈয়দ নজরুল বা তাজউদ্দিন আহমেদেকে নিয়েও একই কথা বলতে পারি আমরা। অথচ এঁদের সন্তানরাই আজ কিন্তু ভাষায় কথায় বলেন। তাদের ভাষা বা আচরণ সেনাতন্ত্রের বুটের তলায় দম নেয়া উগ্র জাতীয়তাবাদ আর ধর্মানু দলের নেতাদের কথাকেও হার মানায়। কেন এই অবক্ষয়?

গত ১৫-৫-১২ তারিখে সৈয়দ আশরাফ আরেকটি বোমা ফাটিয়েছেন। কিশোরগঞ্জ টাউন হলের দলীয় সমাবেশে টক শো, প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় অংশগ্রহণ কারী লেখক সাংবাদিকদের তিনি স্বম্প জ্ঞান সম্পন্ন মূর্খ বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে এখন আর পথিকৃত কেউ বেঁচে নেই, ফলে যার যা খুশী বলছে বা লিখছে বলেও মতামত ব্যক্ত করেন তিনি। চ্যানেল গুলোকে ‘কচু পাতার পানি’ লেখকদের অনভিজ্ঞ, সীমিত জ্ঞানের মনে করেন সৈয়দ আশরাফ।

সৈয়দ বংশের ফুলের এহেন মন্তব্য আমার মত জ্ঞান হীন, অর্বাচীন লেখকের জন্য প্রযোজ্য বটে, কিন্তু আজকের পত্রিকা বা প্রিন্ট মিডিয়ার সবচে বহুপ্রজ্ঞা লেখক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর বেলায় কি হবে? তিনি তো শত্রু পক্ষের মতে আওয়ামী ঘরানারই লেখক। বেগম জিয়ার খাস বান্দা অধূনা শাবক শফিক রেহমানই যে ফতোয়া জারি করেছেন, আছেন বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, আনিসুজ্জামান, এ বি এম মূসার মতো লেখক। প্রবীন ও কৃতিমান সাংবাদিক, লেখকের ভীড়ে ঠাসা আমাদের সংবাদ পত্র। তোয়াব খানের মত সম্পাদক বঙ্গদেশে আবার জন্মাবে কিনা তা একমাত্র সময়ই তার উত্তর দিতে পারে। এমন মেধাবী মিডিয়া জগতকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ায় আর যাই থাক প্রজ্ঞা নেই, নেই মেধার পরিচয়। টক শোর ব্যাপারে তার মন্তব্য মানতে নিম রাজী আমি। এক্ষেত্রে প্রচুর মেধাবী আর অভিজ্ঞ মানুষ থাকার পরও ‘শো’ জমানোর স্বার্থে যাদের হায়ার করা হয় তাঁরা সৈয়দ আশরাফের দলের মন্ত্রী, সাংসদ, নেতা অথবা ধামা ধরা। বিপরীত প্রান্তে বিএনপি বা অন্যদলের অভিজ্ঞ বা সৈয়দ আশরাফের ভাষায় ‘মুর্খের’ দল। মজার ব্যাপার এই যুদ্ধেও জ্ঞানী আশরাফের দল এখন প্রায় পরাজিত আত লেপে গোবরে। অন্ততঃ দুটি টক শোর কথা আমি বলতে পারি যার একটিতে প্রাক্তন মন্ত্রী বিএনপি নেতা মঈন খানের কাছে গলাবাজি আর উঁচু স্বরে চিৎকার করেও কূপোকাত হয়েছিলেন নৌ মন্ত্রী শাহজান। অন্যটিতে নব্য আওয়ামী নেত্রী প্রখ্যাত অভিনেত্রী কবরীর চড়া গলা ও পরাজয় মানতে না পারার আস্ফালন দেখে চমকে উঠেছিলাম।

কথায় বলে ক্ষমতায় গেলে মানুষের মাথায় কিছু একটা ভীড় করে। কেউ তা নিতে পারে, কেউ পারেনা। কারো তখন ‘আউলা আউলা’ লাগে। সব কিছু অসহ্য আর ধরাকে সরা মনে হয়। তা যদি না হবে মনমোহন সিং এর পরিজগত অবস্থান আর আমাদের দেশের শীর্ষ নেত্রীর অবস্থানের তুলনা করে সুখ পেতেন না। একজন বসে আছেন নিয়ম আর নিষ্ঠার রাজনীতিতে, গণতান্ত্রিক ভোট যুদ্ধ গদী পাওয়া ও হারানোর বেদীতে। অন্যজন যে কোথায় তার উত্তর সৈয়দ সাহেবই ভালো জানেন।

অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস বলে পতনের পূর্বে অথবা পরাজিত হবার আশঙ্কায়ই মানুষ প্রগলভ হয়ে উঠে। শেষ পর্যন্ত মিডিয়া বা প্রচার মাধ্যমের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আত্মাহুতি অথবা পতন নিশ্চিত করে তোলে। ধী মান বিদেশী জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সৌম্য দর্শন সৈয়দ সাহেব ও আশরাফ আতরাফের পার্থক্য বুঝতে পারছেন না, এ বড় আফসোসের। কোথায় চলেছে আওয়ামীলীগ ? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে দেশের ভবিষ্যত ? একথা গুলোই বা কে বলবে ? সৈয়দ সাহেবের ভাষায় মুর্খের দল না বিজ্ঞ রাজনীতিবিদেরা ? তিনি যেমন বললেন জহুর হোসেন চৌধুরী নেই, ওবায়দুল হক নেই, মানিক মিয়া নেই, তেমনি বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দিন ভাসানীও নেই তবু তাঁরা আছেন, থাকবেন, শুধু অন্যের বেলায় প্রশ্ন আত যোগ্যতার মাপকাঠি।

অজয় দাশ গুপ্তঃ সিডনী প্রবাসী কলামিষ্ট।।

dasguptaajoy@hotmail.com

অতিথি লেখক