চা শ্রমিক হত্যা দিবস
২০ মে। চা শ্রমিক হত্যা দিবস। মানব ইতিহাসের জঘন্য আর কালো এই দিবসটি রাষ্ট্রীয় কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগেও এখন আর পালিত হয় না। জানা যায়, ১৮৫৪ সালে ভারতের অনুর্বর অঞ্চলে অর্থাৎ উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, বিহার, মধ্যপ্রদেশসহ বিভিন্ন অঞ্চলে অভাবপীড়িত মানুষ অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাতো। গরিব মানুষের অর্থ সংকটের এ সুযোগটিকে সুকৌশলে কাজে লাগায় ব্রিটিশ সরকার। সিলেটের ‘মালিনীছড়া’ চা বাগান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ধূর্ত ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে প্রাথমিক ভাবে চায়ের বাণিজ্যিক চাষ শুরু করে। খুব স্বভাবিক কারণেই চা বাগান প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। ব্রিটিশ কোম্পানি উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, বিহার, মধ্যপ্রদেশসহ আশপাশ এলাকা থেকে অভাবপীড়িত মানুষদের আর্থিক লাভের মিথ্যা আশ^াস দিয়ে চা বাগানে নিয়ে আসে। তাদের চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করে। কোম্পানির মালিকরা এসব শ্রমিককে আসাম-সিলেট অঞ্চলের গহিন বনে নামমাত্র মজুরিতে অমানবিক কাজে বাধ্য করে। দিন-রাত খাটুনির পর যে মজুরি পেত, তা দিয়ে শ্রমিকদের ঠিকমতো একবেলা খাবারও জুটত না। একদিকে মালিকদের অত্যাচার-নির্যাতন, অন্যদিকে অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে শ্রমিকরা মানবেতর জীবন-যাপন করতে থাকে। ব্রিটিশ কোম্পানির মালিক শ্রেণীর শোষণ, নির্যাতন আর মিথ্যা আশ্বাসে সৃষদ্ব দারিদ্রে্যর দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে শ্রমিকরা তখন ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৯২১ সালে নিজ এলাকা বা বাসস্থানে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে শ্রমিকরা। কিন্তু মাতৃভূমিতে যাওয়ার পথ জানা ছিল না তাদের। তবে এটুকু ধারণা ছিল চাঁদপুর থেকে স্টিমারে কলকাতা যাওয়া যায়। ১৯২১ সালের মে মাসে চা শ্রমিক নেতা পন্ডিত দেওশরণ ও পন্ডিত গঙ্গা দীক্ষিতের নেতৃত্ত্বে কাছাড়া ও সিলেটের ৩০ হাজার চা শ্রমিক রেললাইনের পথ ধরে হেঁটে রওনা দেয়। ২০ মে তারা চাঁদপুর নদীবন্দরে পৌঁছে। পথে খাদ্য সংকট ও রোগাক্রান্ত হয়ে নারী-শিশুসহ অনেকে মারা যায়। এদিকে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় বাগান মালিকরা শ্রমিকদের পথরোধ করতে চাঁদপুরে আসাম রাইফেলসের গুর্খা সৈন্য মোতায়েন করে। তবে শ্রমিকরা দাসত্ত্বের শৃঙ্খল ছিন্ন করে নিজ মাতৃভূমিতে পৌঁছার সংকল্পে অটুট ছিল। ২০ মে শ্রমিকরা স্টিমারে উঠতে চাইলে গুর্খা সৈন্যরা বাধা দেয়। তখন ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকরা সেই বাঁধার বিরূদ্ধে বিদ্রোহ করে। শ্রমিকদের এ বিদ্রোহ দমন করতে সরকারের পক্ষে কমিশনার কিরণ চন্দ্র দেব, ম্যাজিসেদ্ব্রট সুশীল সিং, ইংরেজ মালিকদের প্রতিনিধি ফার্গুসনের নির্দেশে নির্বিচারে গুলি করে এবং হত্যাযজ্ঞ চালায়। যারা রেলস্টেশনে অপেক্ষা করছিল তাদেরও গুলি করে হত্যা করা হয়। চা শ্রমিকদের অগণিত লাশ মেঘনায় ভাসিয়ে দেয়া হয়। শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত হয় মেঘনা নদী। ২০ মে ইতিহাসে যুক্ত হয় আরেকটি শাসকশ্রেণী দ^ারা শ্রমজীবী মানুষকে পৈশাচিকভাবে হত্যার কালো ইতিহাস। শ্রমজীবী মানুষের জন্য এ দিনটি সংগ্রামের, স্বজন হারানোর বেদনার একটি দিন। এ হত্যাযজ্ঞ ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের ‘‘হে’’ মার্কেটে শ্রমিক হত্যার ঘটনাকেও হার মানায়। শ্রমিকদের মধ্যে প্রতি বছর ২০ মে ফিরে আসে স্বজন হারানোর কথা জানান দিতে। রক্তম্নাত এ দিবসটি রাস্ট্রীয় কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগে পালনের রীতিটি এখন বিলুপ্ত প্রায়। দেশের অবহেলিত-বঞ্চিত শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট-বেদনার খবর কেউ রাখার প্রয়োজন মনে করেন না। যাদের মাথার ঘামে দেশের সার্বিক উন্নতি অর্ন্তনিহিত, তারা-ই সমাজের প্রতিটি পদে পদে শুধু-ই বঞ্চনার শিকার হন। কতো সরকার অসে, যায়। কতো কিছুর পরিবর্তন হয়। হয় কতো কিছুর পরিবর্ধন। শুধু তিমিরে থেকে যায় দ্রারিদ্রের অভিশাপে অভিযুক্ত শ্রমিকদের ভাগ্য! এবার দেশের পরিবর্তিত এই প্রেক্ষাপটে কি এ দিবসটি পালিত হবে? এ প্রশ্নটি-ই বারবার ভাবিয়ে তুলছে আমাদের…!
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।।
jsb.shuvo@gmail.com