খাঁটি, বিশুদ্ধ এবং নির্ভেজাল
সাযযাদ কাদিরঃ সবাই জানেন, সম্পদ অর্জনের শ্রেষ্ঠ উপায় বাণিজ্য। সেকালের পণ্ডিতেরাও বলেছেন, ধন ও ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী বাস করেন বাণিজ্যেই। তবে একালে বাণিজ্যের জন্য বণিক হওয়ার প্রয়োজন নেই। এখন যে ধরনের বাণিজ্যের রমরমা চলছে- ভর্তি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, গ্রেপ্তার বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, লাইসেন্স-পারমিট বাণিজ্য, শেয়ার বাণিজ্য ইত্যাদি- এ সবে যাঁরা জড়িত তাঁরা পরিচিত অন্য নামে। এখানে আসল ব্যাপার, সোজাই বলি, ঘুষ দেয়া-নেয়া। ঘুষ খাওয়া। এ খাওয়াটা খারাপ নয়। যদ্দূর জানি, ঘুষে কোনও ভেজাল নেই। একেবারেই খাঁটি ও বিশুদ্ধ বস্তু এই ঘুষ। এতে কাঁকর, ইঁটের গুঁড়া, কারবাইড, ফরমালিন, প্রিজারভেটিভ, কেমিক্যাল, রঙ, পোড়া মবিল, ওয়াসা’র পানি ইত্যাদি কিছু নেই। এখানে গরুর নামে মোষের গোশত, খাসি’র নামে ছাগল-ভেড়ার গোশত, মুরগির নামে কাছিমের ডিম খাওয়ানো চলে না। ওগুলো আছে আমাদের জন্য। আমরা মানে এই যারা চলি বাঁধা আয়ে, মাসের শেষ সপ্তাহে যারা চলি প্রায় পুরোপুরি কৃচ্ছ্রসাধন করে, দিনের এক বেলা ব্রেঞ্চ খেয়ে। অবশ্য এমনিতেও অভ্যস্ত আমরা ব্রেঞ্চ-এ। ব্রেঞ্চ মানে ব্রেকফাস্ট না করে একটু আগে-আগে লাঞ্চ সারা। তা সে ব্রেঞ্চেই বা কি খাই? কোন জিনিস কি খেতে পারি নিশ্চিত মনে? কিন্তু খাই, বেঁচে থাকার আশায় বাধ্য হয়ে খাই। তারপর শুরু হয় বেঁচে থাকার যাবতীয় যন্ত্রণা। ভেজাল খেয়ে এ অসুখ ও অসুখ বাঁধিয়ে ভুগি। দামি ওষুধ কেনার ভয়ে প্রথম দিকে চলি সহ্য করে। তারপর মর-মর অবস্থা হলে ডাক্তার ও ওষুধের পেছনে যৎসামান্য যা কিছু সঞ্চয় সব ফুরিয়ে আর পথ্য জোটাতে পারি না। ফলে অসুখ আর ছাড়েও না। কিছু দিন দমে থাকে, তারপর সময় সুযোগে এমন চেপে ধরে যে দম উঠে যায় নাকে। তখন চিকিৎসা কি হবে? কিভাবে হবে? না, দেশের চিকিৎসা-ব্যবস্থার কথা বলছি না- সে সব সবাই জানেন আপনারা, না হয় আরেক দিন বলবো। পরে দেখা যায়, এমন অসুখ বেঁধে গেছে যে লাখ-লাখ টাকা দরকার। কোত্থেকে আসবে এত টাকা? আমরা যারা ৯৯%, আমাদের সকলের অবস্থা তো একই রকম। আমাদের আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সবারই তো একই দশা। তারপর সাহায্যের জন্য প্রার্থনা। সে এক মহাবিড়ম্বনা। আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়ার চেয়েও দুঃসহ হয়ে পড়ে তা কখনও। সাহায্য পাওয়ার চেয়েও কঠিন হয়ে পড়ে সাহায্য প্রার্থনার প্রকাশ-প্রচার। ফেসবুক-এর বেশির ভাগ বন্ধুই শেয়ার পর্যন্ত করতে চান না মানবিক সাহায্যের আবেদন। তারপর কোনক্রমে মিডিয়ায় কিছুটা প্রকাশ-প্রচার করা গেলেও সাহায্য সহজে জোটে না, সবার জোটে না। যদি জুটে যাওয়ার মতো অভাবনীয় কিছু ঘটে যায়, তাহলে মরতে-মরতে বাঁচা যায় হয়তো, আর যাদের জোটে না? হাসপাতালের সিঁড়িতে বা বারান্দায়, অথবা আর্থিক অক্ষমতার এক ভয়ঙ্কর বিপন্নতায় নিমজ্জিত স্বজনের চোখের সামনে ধুঁকে-ধুঁকে মরা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে কি তাদের?
এখন বলুন, এমন পরিণতি কি চান কেউ? সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে সম্পূর্ণ বৈধ জীবন যাপনের এমন প্রতিফল? তাহলে আপৎকালের সম্বল যোগাড় করে রাখার উপায় কি বাণিজ্য ছাড়া? বলবেন, কোন বাণিজ্য? খাঁটি, বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল বাণিজ্য তো ওই একটাই। ঘুষ বাণিজ্য। এর বিকল্প আছে কি? আশির দশকের প্রথম দিকে, তখন আমি দৈনিক সংবাদ-এর সহকারী সম্পাদক, এক সম্পাদকীয় বৈঠকে কথায়-কথায় ‘সংবাদ’-সম্পাদক আহমদুল কবির বলেছিলেন সমঝোতার মাধ্যমে এক সমাধানের কাহিনী। ওই সময় তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য। তাঁর এলাকার থানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ‘বেতনের টাকায় সংসার চলে না, কাজেই উপরি চাই… তা মাসে তোমাদের কত হলে আর উপরি লাগবে না, ডিউটি ঠিকমতো করবে, চুরি-ডাকাতি ঠেকাবে?’ হিসাব করে একটা অঙ্ক জানাবার পর এলাকাবাসী নিজেদের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাসে-মাসে তা জমা দিয়েছে যথাস্থানে। এতে ফল দিয়েছে, এলাকাবাসী থেকেছে নিরুপদ্রব শান্তিতে।
ভেবে দেখুন, এমন আরও কোনও বিকল্প আছে কিনা!
সাযযাদ কাদিরঃ সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।।