বিশ্ব বাবা দিবসঃ পিতার প্রতি ভালোবাসায় সিক্ত হোক এ ধারা…
প্রতিটি সন্তানের কাছে এক শ্বাশত, মহান ও গভীর অনুভূতিপূর্ণ শব্দ হলো বাবা। সন্তান, কিংবা পরিবার, সবার কাছেই বাবা আশ্রয়ের নাম, নির্ভরতার প্রতীক। বাবার অবদান, ত্যাগ, স্নেহ, ভালোবাসা সকল তুলনার ঊর্ধে। পিতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক কখনো শ্রদ্ধার, কখনো ভয়ের আবার কখনো বা বন্ধুত্বের। আজ ১৭ জুন। বিশ্ব বাবা দিবস। আমি আমার মনের পুঞ্জিভূত গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ আজকের লোখাটি আমার বাবা সদ্য প্রয়াত বিশিষ্ট সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জির স্বরণে উৎস্বর্গ করছি।
একজন পিতার শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ হচ্ছে তার সন্তান। বাবার প্রতি প্রতিটি সন্তানের মনে থাকে গভীর শ্রদ্ধা ও আবেগ। কিন্তু পরিবারের পরিবেশগত কারণে ক্ষেত্র বিশেষ এই শ্রদ্ধা কখনো পায় না পূর্ণ মর্যাদা। ঐতিহ্যগত ভাবে-ই মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক থাকে আনুষ্ঠানিক আবেগ ভিত্তিক। আর বাবার সাথে থাকে দূরত্ব। দূর থেকেই সন্তান তার মনের গভীরে, হৃদয়ের অন্তরালে লালন করে বাবার প্রতি সুগভীর ভালোবাসা। এই ভালোবাসা জগৎ এর সকল কিছুর তুলনার ঊর্ধে। বাবার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের লক্ষ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দিনে পালিত হয়ে আসছে বাবা দিবস। বিশ্বের সকল দেশের সাথে সংগতি রেখে বাংলাদেশেও বাবা দিবসটি যথাযথ মর্যাদা ও সম্মানের সাথে পালন করা হয়। বাবা দিবস পালনের রীতি মূলত প্রথম শুরু হয় আমেরিকায়। কিন্তু ঠিক কোন জায়গা বা কোন সময় থেকে এটি শুরু হয়েছিলো সে সর্ম্পকে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। জানা যায়, আমেরিকার পশ্চিম ভার্জেনিয়ায় মিসেস জন ডড তাঁর বাবাকে সম্মান প্রর্দশনের উদ্দেশ্যে এই বিশেষ দিনটির প্রচলন করেন। সেই প্রচলিত ধারাটি ব্যাপকতা লাভ করে ১৯১০ সালের জুন মাসের তৃতীয় রোববার ওয়াশিংটনের স্পোকনিতে। মিসেস ডড তাঁর বাবা উইলিয়াম স্মার্ট কে বিশেষ সম্মান প্রর্দশনের এই ভিন্নধর্মী দিবসটি প্রচলনের সুপ্ত কারণ ছিলো পৃথিবীর অন্তত একটি দিনে যেন সন্তানেরা তাদের বাবাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ভালোবাসা জানাতে পারে। উলিয়াম স্মার্ট সন্তান প্রসবকালীন স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর ৬ সন্তানকে পরবর্ত্তী সময়ে সম্পূর্ণ একা লালন-পালন তথা মানুষ করেন। মিসেস জন ডড পিতার এই বিশাল স্বার্থ ত্যাগের কথা বিশেষ ভাবে অনুধাবন করেন। আর এই উপলদ্ধি-ই বাবার প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে অনুপ্রাণিত করে। সেই অনুপ্রাণিত ভালোবাসাকে আনুষ্ঠানিকতার সাথে প্রকাশের জন্য তিনি মনের মাঝে তীব্রভাবে আলোড়ন অনুভব করেন। ভালোবাসার সেই আলোড়ন থেকেই ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বিশ্ব বাবা দিবস।
পৃথিবীর প্রথম বাবা দিবস পালিত হয় ওয়াশিংটনে ১৯১০ সালের ১৯ জুন। এরপর আমেরিকার বিভিন্ন শহরে দিবসটি আয়োজনের সাথে পালনের রেওয়াজ চালু হয়। ১৯২৪ সালে বোলভিন ক্যালিস বাবা দিবস পালনের এই পরিকল্পনার প্রতি তার ব্যক্তিগত আন্তরিক সমর্থন ব্যক্ত করেন। অবশেষে ১৯৫৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিনডন ব্যানিস জনসন এক ঘোষণার মাধ্যমে প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার কে আর্ন্তজাতিক বাবা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেন। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশ্ব বাবা দিবস পালন করা হয় এবং এ উপলক্ষে গ্রহণ করা হয় নানাবিধ কর্মসূচি। এই বিশেষ দিনে সন্তানেরা তাদের বাবার প্রতি বিভিন্নভাবে সম্মান ও ভালোবাসা প্রকাশ করার এক ঐকান্তিক সুযোগ পায়। সার্মথ অনুযায়ী বিভিন্ন উপহার সমগ্রী দেয়ার মাধ্যমে এই প্রর্দশিত ভালোবাসা হয় আরো গাঢ় এবং উজ্জ্বল আনুষ্ঠানিকপূর্ণ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও গিফট সপগুলো এ লক্ষ্যে ভিন্ন স্বাদের এবং ভিন্ন আমেজের গিফট হ্যাম্পার তৈরী করে। হলমার্ক, আর্চি, রুমা, প্রভৃতি গিফট সপগুলোর বিক্রি এই দিবসটিকে কেন্দ্র করে বেশ জমে ওঠে। পিতার পছন্দ অনুযায়ী উপহার সংগ্রহের ক্ষেত্রে এ সকল দোকানে সন্তানদের উপস্থিতি ও উৎসাহ থাকে পরিলক্ষনীয়। ২০০৬ সালের এমন দিনে আমি চট্রগ্রামের মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত থাকাকালীন সময়ে আমার বাবা আমার ওখানে উপস্থিত ছিলেন। বাবা দিবসে আমি তাঁকে একটি টেবিল ঘড়ি উপহার হিসেবে দিয়েছিলাম। আজ বাবা নেই। উপহার দিয়ে কারো চোখে আনন্দ অশ্রু দেখার সৌভাগ্যও আমার নেই। ঘড়িটি আজো টিক টিক শব্দে সময়ের শ্রোতকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাবার সাথে আমার অনাবিল স্মৃতি বিজরিত সেই হারিয়ে যাওয়া মুর্হূত্ব গুলোতে। ২০০৬ সালের-ই আগষ্ট মাসে আমার বাবার আকশ্মিক মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর পর আমার ভাগ্যের চাকাটি একদম থেমে গেছে। কতোকিছু পরিবর্তন হচ্ছে, কতো কিছুর পরিবর্তন হবে, কিন্তুু আমার এই থেমে থাকা ভাগ্যের চাকাটি হয়তো আর সঞ্চালিত হবে না। নিয়তির নির্মম পরিহাসে আমাকে চিরকাল বয়ে বেড়াতে হবে বাবার আবেগপূর্ণ সকল স্মৃতি…! আমার মতো এতিম ভাগ্যহীনদের প্রতি আজকের দিনে আমার সমবেদনা রইলো। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে সর্বত্র বাবা দিবস আনুষ্ঠানিকতার সাথে পালিত হলেও আমাদের দেশে এই দিবসটির পরিব্যপ্তি যথেষ্ট কম। এই বিশেষ দিবসটি সম্পর্কে অনেকের মনেই কোন স্বচ্ছ ধারণা অদ্যাবধি নেই। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রতিটি সন্তানের উচিত আজকের এই বিশেষ দিনে যে যার সাধ্যমতো বাবাকে ভালোবাসা প্রদর্শন করা। মানুষের জীবন আকাশের রং এর মতো। যে কোন মুর্হূত্বে-ই জীবনের রং পাল্টে যেতে পারে। হারিয়ে যেতে পারে জীবনের গতি। যাদের বাবা প্রয়াত তারাই শুধু অনুভব করতে পারবে বাবার স্নেহ কতোটা শক্তিশালী, বাবার উপস্থিতি কতোটা সাহস সঞ্চার করতে পারে, পারে কোন কাজে অভাবাবনীয় অনুপ্রেরণা যোগাতে। প্রতিটি সন্তানের বুক জুড়ে থাকে বাবার প্রতি চির অম্লান শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। এই ভালোবাসা জগতের সকল কিছুর তুলনার ঊর্ধে। আর সেই ভালোবাসা যদি সঠিক সময়ে সঠিক প্রয়োগ না হয়, তাহলে জীবনের প্রতিটি পদে, প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেকে নিজের কাছে-ই অপরাধী করে তুলতে পারে। আমি জানি, আমি আমার বাবাকে কতোটা ভালোবাসি। কিন্তু আজ আমার সেই ভালোবাসা আমি কাকে প্রর্দশন করবো? কাকে আমি সেই প্রিয় ‘বাবা’ বলে ডাকবো? আমার ভাগ্যবিড়ম্বিত এই আক্ষেপ অন্তরের। এই জ্বালা কি কোনদিন নিভবে?
জীবন বহমান। সকল হারানো কিংবা শোক-তাপের ঊর্ধেও জীবন স্বীয় গতিতে চলবে। এটাই চিরন্তন সত্য। স্মৃতি শুধুই স্মৃতি। কিছু স্মৃতি বড়ই বেদনাদায়ক। কিন্তু স্মৃতিকে যেমন ভূলে থাকা যায় না তেমনি অস্বীকারও করা যায় না। ভালোবাসার বহতার কথা বলেছেন কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর। তিনি তাঁর পিতার শেষ অন্তোষ্টি ক্রিয়ার প্রার্থনায় বলেছিলেন, ‘‘তাহা (বাবা) আলোকের ন্যায়, সমিরণের ন্যায়, তাহা শিশুকাল হইতে আমাদিগকে নিয়ত রক্ষা করিয়াছে, কিন্তু তাহার মূল্য কেহ কখনো চাহে নাই…!’’
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।।
jsb.shuvo@gmail.com