মন্দের প্রতিফলন মন্দ

মন্দের প্রতিফলন মন্দ

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিকঃ বিচার ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য নিরূপণ করে আইনি প্রতিকার দেয়া। কিন্তু আদালতে প্রতিকার পাওয়া একটা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল ব্যাপার। তাই সমাজে ঘটে যাওয়া ছোটখাটো অনেক অপরাধের প্রতিকার পেতে অনেক সময় আদালতে যাওয়া বাস্তবসম্মত হয় না। যেমন কারো একটা ছাগল হারানো গেলে তার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হওয়া কোনো যুক্তিসঙ্গত কাজ হবে না। কারণ আদালতের ফি ও আইনজীবীর খরচ গুনতে গুনতে তার দশটা ছাগলের পয়সা ফুরাবে। কিন্তু এসব অপরাধকে আবার বিনা বিচারে যেতে দেয়াও ঠিক হবে না। পৃথিবীর বয়স যতদিন, মানুষে মানুষে বিরোধের বয়সও ততদিন। মানব সভ্যতার শুরু থেকেই বিরোধ নিষ্পত্তির বিভিন্ন পন্থা মানুষ আবিষ্কার করেছে। এর মধ্যে পক্ষগণ কর্তৃক আদালতের বাইরে বা আদালতের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির একটি প্রক্রিয়া রয়েছে, এ  প্রক্রিয়াকে এডিআর বলা হয়। বাংলাদেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা প্রধানতঃ ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত বিচার ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। সেসময়ের প্রবর্তিত আইনসমূহু হুবুহু বা কতিপয় পরিবর্তণ সাপেক্ষে এখনও আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। আমাদের আইন ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হতে পারেনি। সে কারন প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে অনেক পিছিয়ে রেখেছে।

 

বিরোধী বিষয় বলতে এমন একটি ঘটনাকে বুঝায় যা এক পক্ষ কর্তৃক দাবী করা হয় এবং অপর পক্ষ তা অস্বীকার করে ও উভয় পক্ষই তাদের দাবীর সমর্থণে কতিপয় যুক্তি উপস্থাপন করে। তবে বিরোধ নিষ্পত্তি বলতে এমন একটি বিষয় বুঝানো হয় যা পক্ষগণ একত্রে সমাধা করে এবং যা আদালতে মোকদ্দমা দায়েরের মাধ্যমে জয় লাভের প্রত্যাশায় করা হয় না। এটা শান্তিপূর্ণভাবে পক্ষগণ কর্তৃক মীমাংসিত হয়ে থাকে। আপোষ নিস্পত্তির বিষয়ে পবিত্র কোরআন শরীফে বলা হয়েছে, ‘‘মন্দের প্রতিফলন মন্দ, আর যে ক্ষমা করে দেয় ও আপোষ নিষ্পত্তি করে তার পুরুস্কার আল্লাহর কাছে। আল্লাহ সীমা লংঘনকারীদের পছন্দ করে না।

সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন একজন নারী। যৌতুকের একটি মামলার সাক্ষ্যপর্ব চলছে। মেয়েটি তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে মামলাটি করেছেন। মেয়েটির অভিযোগ, স্বামী তার সন্তানকে অস্বীকার করেছে। অপবাদ দিচ্ছে এ সন্তান তার না। বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের কারণে নানাভাবে অত্যাচার করছে। নিরুপায় হয়ে যৌতুকের ও সন্তানের ভরণপোষণ চেয়ে মামলা করেছে আদালতে। মেয়েটির নাম রহিমা (ছদ্মনাম)। মাঝারি গড়নের, চিকন ও ফরসা। ডাগর ডাগর দুটি চোখ জুড়ে যেন সরলতার প্রতিচ্ছবি। ওই দুটি চোখই বলে দেয়, তার হৃদয়ের গহীনে জমে থাকা যন্ত্রণার ঢেউ।

২০০৮ সালে। পারিবারিকভাবেই রহিমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর সে রহিমাকে তার বাবার বাড়িতে নিয়ে যায়নি। প্রথমে শুধু কাবিন করলেও পরে আর তুলে নেয়নি। এরই মাঝে রহিমার কোল জুড়ে আসে একটি ফুটফুটে ছেলে সন্তান। ছেলেটিকে সম্বল করেই বেঁচে থাকা রহিমার।

২০১০ সালে অতিষ্ঠ হয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করে রহিমা। মামলার পরই স্বামী তালাক দেয় রহিমাকে। আসলে রহিমাও তালাক চাচ্ছিল। কারন বিয়ের পর তার প্রয়োজন মেটাতেই আসত। আর বাচ্চা হওয়ার পর তো একদমই খোঁজ নিত না। রহিমার বিয়ের দেনমোহর পাঁচ লাখ টাকা। দেনমোহর ও সন্তানের খোরপোষ, অভিভাবকত্ব চেয়েও পারিবারিক আদালতে মামলা করেছে। রহিমার কোলে তার ছেলের চেহারাটা কত মায়াবী, চোখ দুটি ছলছল করছে, বাবার আদর-যত্ন থেকে বঞ্চিত চেহারাটা। ছেলেটি বোবা হয়ে আছে যেন বাবা ডাকার জন্য।

যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০ এর ৪ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি যৌতুক দাবি করে তাহলে দায়ী ব্যক্তি সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত যা কোনোভাবেই এক বছরের নিচে নয় জেল বা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে। দেনমোহর ও ভরণপোষণের দাবি করে পারিবারিক আদালতে প্রতিকার চাইতে হয়। দেনমোহরের টাকা অবশ্যই স্ত্রীকে দিতে হবে। তালাক কার্যকর হওয়ার আগে পর্যন্ত এবং ইদ্দতকাল পর্যন্ত অবশ্যই স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে হবে। তালাক হওয়ার পর তিন বছরের মধ্যে দেনমোহরের জন্য মামলা করতে হয়। সহকারী জজ আদালতগুলো পারিবারিক আদালত হিসেবে বিচারকাজ করে থাকেন। উপরোক্ত মামলাটি অবশেষে পক্ষগণ কর্তৃক আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি হয়। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআন শরীফের সুরা নিসার ১২৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘কোন স্ত্রী যদি তার স্বামীর কাছ থেকে থেকে দুর্ব্যবহার ও উপেক্ষিত হওয়ার আশংকা করে, তবে তারা আপোষ নিষ্পত্তি করতে চাইলে তাতে কোন দোষ নেই। আপোষ করা তো ভাল।

 

ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হলো অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া। আর এর মাধ্যমে রাষ্ট্র দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন করতে চায়। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ভুয়া মামলা, মিথ্যা মামলা ও হয়রানিমূলক মামলা করার অনেক নজির আছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য বাদী অনুরূপ মামলা করে থাকে। পুলিশ কর্তৃক দায়েরকৃত মামলায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুরূপ দৃষ্টান্ত লক্ষ করা যায়। তা ছাড়া পুলিশ প্রতিবেদনও সব সময় সঠিকভাবে দাখিল করা হয় না। পুলিশ বিভাগে আলাদা তদন্ত সেল না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ অফিসারকে তাড়াহুড়া করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। এতে ত্রুটি থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।

সব দেওয়ানি মামলায় যেমন এডিআর সম্ভব নয়, তেমনি সব ফৌজদারি মামলায় আপস-মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যাবে না। কারণ এতে অপরাধীদের মনে ভয়ভীতি থাকবে না, বরং অপরাধ করে মীমাংসার সুযোগ থাকায় অপরাধ প্রবণতা আরো বেড়ে যেতে পারে। তবে এমন কিছু মামলা আছে, যা আসলেই মীমাংসা হওয়া দরকার। যেমন যৌতুক মামলা, পারিবারিক মামলা ইত্যাদি। তাহলে আদালতে মামলার চাপ কমবে।

লক্ষ্য করা যায়, আদালতের বিজ্ঞ আইনজীবীরাও অনেক ক্ষেত্রে মামলা মীমাংসার পক্ষপাতী থাকেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, সাক্ষীর কাঠগড়ায় স্বামী, আসামির কাঠগড়ায় স্ত্রী বা সাক্ষীর কাঠগড়ায় বাবা, আসামির কাঠগড়ায় ছেলে। এরূপ ক্ষেত্রে পক্ষদ্বয় যদি আসলেই সমঝোতা চায়, আদালত অনেক বিষয় চিন্তা ও বিবেচনা করে বিকল্পভাবে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ দিয়ে থাকেন। যৌতুক মামলার ক্ষেত্রে ফরিয়াদির অনেক সময় এ রকম উদ্দেশ্য থাকতে পারে আসামিকে জেলের ভাত খাওয়াব। আবার কিছুদিন পরে সেই মামলাটিতেই পক্ষদ্বয় আপস করতে চায়। আসল কথা হলো, কোন কোন মামলায় আপস নিষ্পত্তি হওয়া দরকার, এর একটা স্পষ্ট নীতিমালা থাকলে বিচারকাজ সহজ হয়। এডিআর বিষয়ে ভবিষ্যতে আইন প্রণয়নের সময় এ বিষয়টি চিন্তা করা উচিত।

লেখকঃ সাপ্তাহিক ‘সময়ের দিগন্ত’ পত্রিকার প্রকাশক-সম্পাদক ও আইনজীবী জজ কোর্ট, কুষ্টিয়া।

E-mail: seraj.pramanik@gmail.com

এসবিডি নিউজ ডেস্ক