পুলিশের ব্যর্থতার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অপরাধ!

পুলিশের ব্যর্থতার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অপরাধ!

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ

রাজধানীতে অপরাধ সমান্তরালে বেড়েই চলছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মামলার সংখ্যা। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজি দাবি করছেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভালো রয়েছে। রাজধানীর ৪১টি থানা থেকে আদালতে করা ফৌজদারি মামলার পরিসংখ্যান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজির কথায় কোনো মিল নেই। পুলিশের করা মামলার রেকর্ড অনুযায়ী, প্রতিবছরই আগের রেকর্ড অতিক্রম করছে অপরাধের সংখ্যা। সেই সঙ্গে আসামির সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতে পেশ করা মামলাগুলোর মধ্যে মাদক, ছিনতাই, রাহাজানি, ভাংচুর এবং হত্যা মামলার সংখ্যাই বেশি। চুরি-ডাকাতি হলেও পুলিশ মামলা নিতে চায় না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চুরি-ডাকাতির মামলা পুলিশ গ্রহণ করলে অপরাধের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতো বলে মন্তব্য পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্তাদের।

ছিনতাইঃ ঢাকা মহানগরীতে প্রতিনিয়ত ছিনতাইয়ের কবলে পড়ছে নগরবাসী। এসব ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা করতে গেলে পুলিশ অনেক সময় মামলা নিতে রাজি হয় না। চুরি হলেও মামলা নেয় না পুলিশ। চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনার অভিযোগ নিয়ে থানায় গেলে জিডি করার পরামর্শ দেয়া হয়। অনেকে আবার থানা পুলিশের হয়রানি ও আদালতে যাতায়াতে বিড়ম্বনার ভয়ে মামলা করতে যায় না। তারপরও শুধু পুলিশ বাদী হয়ে যেসব মামলা দায়ের করে, সেই রেকর্ড বলে দেয় অপরাধ বেড়ে চলেছে। ঢাকার সিএমএম আদালতে রাজধানীর ৪১টি থানা থেকে পুলিশের করা ফৌজদারি মামলার পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০০৯ সালে ২০ হাজার ৬৪৬টি মামলা করা হয়েছে। এ মামলাগুলোয় আসামির সংখ্যা ৯১ হাজার ৬১১ জন। ২০১০ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ হাজার ৮০২টি। আসামির সংখ্যা ১ লাখ ১৯ হাজার ৫০ জন। ২০১১ সালে মামলার সংখ্যা আরও বাড়ে। এ বছর পুলিশ বাদী মামলার সংখ্যা হচ্ছে ২৮ হাজার ৪৪৬টি। এ মামলাগুলোর আসামির সংখ্যা হচ্ছে ১ লাখ ৫১ হাজার ৩৯২ জন। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমান সরকার আমলে প্রতিবছরই আগের রেকর্ড অতিক্রম হয়েছে। মামলা ও আসামির সংখ্যা উভয়ই বেড়েছে আগের বছরগুলোর তুলনায়। এ পরিসংখ্যানের সঙ্গে পুলিশের আইজি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে বৈপরীত্য রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মামলাগুলোর মধ্যে অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকেও পুলিশ অপরাধী হিসেবে আসামির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে আদালতে উপস্থাপন করে। এতে ভালো লোকের নাম উঠে এসেছে অপরাধীর তালিকায়। এসব নিরপরাধ ব্যক্তির মামলায় কোনোভাবে জামিন মঞ্জুর হলেও নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাজিরা দিতে হয় আদালতে। মাসে মাসে গুনতে হয় মামলার খরচ।

পুলিশের ব্যর্থতা এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তিঃ মামলাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন যথাসময়ে আদালতে দাখিল করতে না পারায় বিচার ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। জামিন হলেও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল না করলে মামলা শুনানির জন্য তৈরি হয় না। হাজিরা দেয়ার জন্য বছরের পর বছর প্রতি মাসে আদালতের বারান্দায় নিয়মিত ঘুরতে হয়। ঢাকা সিএমএম আদালত ভবনে মামলায় হাজিরা দেয়া আসামির ভিড় দেখা যায় প্রতিদিন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিএমএম আদালতে পুলিশের করা সবচেয়ে বেশি মামলা আসে মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ধানমন্ডি, গুলশান, লালবাগ, মতিঝিল, খিলগাঁও, ডেমরা ও শ্যামপুর থানা থেকে। মামলার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোহাম্মদপুর থানায় প্রতিবছর গড়ে সাড়ে ৭০০ পুলিশ বাদী মামলা দায়ের হয়। মিরপুর থানায় ২০০৯ সালে ৭৪০টি, ২০১০ সালে ৭২৫টি ও ২০১১ সালে ৭৭৯টি মামলা করা হয়েছে আদালতে। গুলশান থানা পুলিশ ২০০৯ সালে ৭৭৪টি, ২০১০ সালে ৭৭৮টি ও ২০১১ সালে ৭৯৯টি মামলা করেছে। মামলা দায়েরের দিক থেকে লালবাগ থানাও শীর্ষ তালিকায় রয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে ৩ বছরে গড়ে প্রতিবছর ৭৭৫টি করে মামলা করেছে এ থানা পুলিশ। ধানমন্ডি থানায় ২০০৯ সালে ৬৭৭টি, ২০১০ সালে ৭৬৬টি এবং ২০১১ সালে ৭৬৮টি মামলা দায়ের করেছে।
এসব মামলার পাশাপাশি বর্তমান সরকারের ৩ বছরে ঢাকায় অনেক চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা থেকে গুম হয়েছেন অনেকে। কোনো একটি ঘটনারও কূল-কিনারা করতে পারছে না পুলিশ। ঢাকা ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম গুম হওয়ার পর বছর পার হয়ে গেছে। যশোরের নাজমুল নামে এক ব্যবসায়ী ঢাকা থেকে অপহরণের পর গাজীপুরে লাশ পাওয়ার তিন মাস পার হয়েছে। সর্বশেষ সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তিন মাস অতিক্রম হয়েছে। সৌদি কূটনীতিক খুন হওয়ার ঘটনায়ও মাস পেরিয়ে গেছে। রাজধানীতে ঘটে যাওয়া এরকম চাঞ্চল্যকর অনেক ঘটনারই কূল-কিনারা করতে পারছে না পুলিশ। পরিবারের সদস্যরাও জানতে পারছেন না কেন তাদের স্বজনরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন।

বিশেষজ্ঞ অভিমতঃ শেয়ার মার্কেটে বিপর্যয়ের কারণে রাজধানীতে ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। শেয়ার বিপর্যয়ে পুঁজি হারিয়ে অনেকে এখন নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। শেয়ারবাজারে বিপর্যয় ঘটলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতার আশঙ্কা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ ধরনের একটি রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, শেয়ারবাজারে দরপতনের ফলে অপরাধপ্রবণতা বাড়তে পারে। টাকা হারিয়ে হতাশাগ্রস্ত, যুবসমাজটিকে থাকার জন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়বে। এমন তথ্য আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে। পুলিশের দাবি, গত জানুয়ারি থেকে চলতি মাসে রাজধানীতে পুলিশের রেকর্ডে ২১৫টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রায় ২শ’ ছিনতাইকারীকে আটক করা হয়েছে। ২০১১ সালে এ সময় ঢাকার বিভিন্ন থানায় রেকর্ড হয়েছে ৭৮টি ছিনতাই বা দস্যুতার ঘটনা। পুলিশ হয়রানির ভয়ে অনেক ছিনতাইয়ের ঘটনা অভিযোগ করা হয় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শেয়ারবাজারে লাগামহীনভাবে দাম বেড়ে যাওয়ায় পরপরই যুবসমাজ ও চাকরিজীবী অনেকেই বাড়তি আয়ের জন্য শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছে। শেয়ার বেচাকেনার লাভের টাকা দিয়ে সংসার খরচ চালাত। এছাড়া বাড়তি টাকা আবার পুঁজিবাজারে খাটিয়ে বেশি লাভ করার চেষ্টা করত। অনেকেই ধারকর্জ করা টাকা নিয়ে লাভের আসায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে। দফায় দফায় শেয়ারবাজারে দরপতনের ফলে অনেকেই টাকা হারিয়ে পথে বসেছে। টাকা হারিয়ে হতাশাগ্রস্ত যুবসমাজে টিকে থাকার জন্য নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই ছোটখাট অপরাধ থেকে শুরু করে ছিনতাই ও চাঁদাবাজি করছে।
শেয়ারবাজারে হঠাৎ করে দরপতনের কারণে তারা এখন মানবেতরজীবন কাটাচ্ছে। কোনমতে টিকে আছে। আবার অনেকেই শেয়ারবাজারে পুঁজি হারিয়ে বাসাবাড়ি ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। আর যুবসমাজে টিকে থাকার জন্য নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক একজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, শেয়ার মার্কেটের বিপর্যয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এছাড়াও সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।
jsb.shuvo@gmail.com

প্রধান সম্পাদক