স্মৃতির ডায়েরীর পাতা থেকে…
জবরুল আলম সুমনঃ প্রতিটা পরিবারেই একজন করে টপ টেরর থাকে, যার নির্দেশ অমান্য করার শাস্তি হয় ভয়ংকর। পরিবারের অনেক সদস্যের চোখে তারা টেররিষ্ট হলেও তারা পরিবারের শৃংখলা রক্ষার্থে নিত্য নতুন আইন প্রণয়ন ও আইনের প্রয়োগও করে থাকেন নিজস্ব কায়দায়। পারিবারিক টেররিষ্টদের অস্ত্রও হয় বিভিন্ন রকমের যা গোলা বারুদের চাইতেও কয়েক গুণে শক্তিশালী হয়ে থাকে। একসময় আমাদের পরিবারের টেররিষ্ট ছিলেন আমার দাদাজি। আমার দাদাকে আমি খুব একটা পাইনি। কারণ আমার বয়স যখন মাত্র নয় বছর তখনই তিনি আমাদের ছেড়ে চিরতরে না ফেরার দেশে চলে যান। তাই তার অনেক স্মৃতিই আমার কাছে ঝাপসা হয় গেছে।
দাদাজানের মুখের উপর কথা বলার সাহস তখন কারোই ছিলো না। তিনি যা বলতেন তাই করতেন। কেউ যখন তার কথার বাইরে চলে যেত তখনি তার অস্ত্র প্রয়োগ করতেন আর তার মূল অস্ত্র ছিলো অনশনব্রত পালন। আন্না হাজারির চাইতে কোন অংশে কম ছিলেন না আমার দাদাজান। এক দিন দুই দিন অনশন পালন করা কোন ব্যপারই ছিলো না তার কাছে। অনশনব্রত পালন কালেও তিনি সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলছেন চলছেন ফিরছেন প্রয়োজনীয় কাজও সারছেন কিন্তু মুখে কিছুই নেননা। এমন কি এক ফোটা পানিও না। তখন পরিবারের সবাই আত্মীয় স্বজনদের (ফুফুদের) খবর দিয়ে নিয়ে আসতো, রাতে বিচার সভা বসতো ফুফুরা বিজ্ঞ বিচারকদের মতোই সবাইকে দোষী সাবস্ত্য করে দাদাজানের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশ দিতেন তারপরই দাদাজানের অনশন ভঙ্গ হতো। আমার দাদা মৃত্যুকালে তার এই শক্তিশালী অস্ত্রটা আমার বাবাকে উইল করে দিয়ে গেছেন বলে বাবাও প্রায় অনশন অস্ত্র ব্যবহার করতেন ছোট খাটো কোন কারনেও। এখনো করেন তবে সেই অস্ত্রের তেজ আর আগের মতো নেই, কিছুটা ভোঁতা হয়ে গেছে সময়ের মরচে পড়ে হয়তো।
প্রত্যেক মানুষের কিছু দূর্বল দিক থাকে, আমার দাদাজানেরও ছিলো। আর আমার দাদাজানের সবচে দুর্বল দিক হলো আমি। তাই দাদাজান বেঁচে থাকা কালে আমার উপর কেউ চোখ রাঙানীর সাহস পেতনা দাদাজানের ভয়ে। তখন সাত খুন মাফ ছিলো আমার জন্য, আমিও দাদাজানকে ঢাল তলোয়ার হিসেবে ব্যবহার করে হাজারো দস্যিপনা করে বেড়াতাম। আমাকে না দেখে দাদাজান কোথাও বেশিক্ষণ থাকতে পারতেন না। আমি যতক্ষণ স্কুলে থাকতাম দাদাজানও স্কুলের অফিস রুমে বসে থাকতেন, কখনো বারান্দায় বা খেলার মাঠে হাঁটা হাঁটি করতেন, স্কুল ছুটি হলে তিনি আমাকে নিয়ে বাসায় ফিরতেন। বিকেল বেলা আমি খেলার মাঠে গেছি, দাদাজানও আমার পেছনে পেছনে খেলার মাঠে চলে এসেছেন। এভাবেই আমার আর আমার দাদাজানের দিনগুলো কেটে যেতো।
আমাদের বাড়িটা অনেক বড়, ঘরটাও বেশ বড় সড়। অনেকগুলো শোবার ঘর আছে, প্রতিটা শোবার ঘরেই খাট বিছানা থাকলেও বেশির ভাগ শোবার ঘরগুলো খালি পড়ে থাকতো। আত্মীয় স্বজন আসলে বা বিদেশ থেকে চাচারা আসলে খালি ঘর গুলোতে থাকতেন। যদিও আমার জন্মের পর ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজি সহ আরোও গোটা ছয়’জন জন্ম লাভ করে অব্যবহৃত থাকা ফাঁকা ঘর গুলোর দখলদার হয়ে গেছেন বলে এখন আর ফাঁকা ঘর খুব একটা নেই। একদিন স্কুল থেকে এসে আমি একটা খালি শোবার ঘরে ঢুকে কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে ওয়াকম্যানে গান শুনতে শুনতে কোন ফাঁকে ঘুমিয়ে পড়ি টেরই পাইনি। অনেক্ষণ থেকে দাদাজান আমাকে দেখতে না পেয়ে খোঁজ করা শুরু করলেন কিন্তু আমার কোন সাড়া শব্দ নেই। আশা পাশের বাড়িতেও খোঁজা খুজি শুরু হয়ে গেলো কিন্তু আমি লাপাত্তা! এভাবেই ঘন্টা দেড়েক পার হয়ে গেলে সবার মধ্যেই উৎকন্ঠা আর ভয় দেখা দিলো। সেসময়ে ছেলেধরার দৌরাত্ম ছিলো মারাত্মক ভাবে। প্রায়ই শোনা অমুকের ছেলে অমুকের মেয়ে নিখোঁজ হয়ে গেছে বা ছেলেধরা নিয়ে গেছে, কারো ভাগ্য খুব বেশি প্রসন্ন হলে ফিরে আসতে পারতো কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিখোজদেরকে আর ফিরে পাওয়া যেতনা।
আমি খুব সহজেই যে কারোর সাথে মিশে যেতে পারতাম বলেই আমার দাদাজান ধারনা করে ফেলেছেন যে কোন ছেলেধরা আমাকে ধরে নিয়ে গেছে। আমার দাদাজান নাকি খুব কঠিন চিজ ছিলেন, হাসা-হাসির মধ্যে থাকলেও কান্না-কাটির মতো ছেলেমানুষী কাজে তার অনুপস্থিতি ছিলো বেশ লক্ষ্যনীয়। সেই দাদাজান আমার জন্য বাচ্চাদের মতো উচ্চস্বরেই কান্না কাটি শুরু করে দিলেন। পাড়া প্রতিবেশী অনেকেই ছুটে এলো দাদাজানের কান্না শুনে। পাড়া প্রতিবেশীর অনেকেই তখন আমার খোজে আশে পাশে বেরিয়ে পড়েন। অনেকেই খোঁজাখোজি করে দাদা জানের কাছে এসে জানালেন যে আমাকে কোথাও পাওয়া যায়নি এমন কি কেউ আমাকে দেখেওনি। অনেকের মুখে এই খবর শোনে দাদাজান জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। দাদাজানকে তখন ধরাধরি করে খাটে শুইয়ে দেয়া হয়। মুখে পানির ছটা দেয়া হলো, রসুনের কোয়া দাঁতে ঘষে ঘষে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনা হয়। জ্ঞান ফিরে পেতেই দাদাজান ঘর থেকে প্রায় দৌড় দিয়ে বের হয়ে তার দুটো চোখ বন্ধ করে আকাশের পানে তাকিয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন “হে আল্লাহ… তুমি আমার নাতিকে ফিরিয়ে দাও, আমি জানের বদলে জান সদকা করবো”
মহান আল্লাহ তায়ালা আমার দাদাজানের দোয়া কবুল করলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমি চোখ মুখ কচলাতে কচলাতে ঘর থেকে বের হলাম। মা আমাকে দেখেই চিৎকার দিয়ে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সবাই জড়ো হয়ে গেলো। দাদাজান তখন মায়ের কোল থেকে আমাকে ছুঁ মেরেই তার কোলে তুলে নিলেন। আমি তখন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কি হচ্ছে এসব! আমার ঘুম ভাঙ্গা চেহারা দেখে কেউ আর প্রশ্ন করেনি কোথায় ছিলাম আমি, কারণ সবাই বুঝতে পেরেছিলো আমি কোন একটা ফাঁকা ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উপস্থিত অনেকেই তখন কিছুটা হাসা হাসি করে যার যার বাসায় চলে গেলেন। রাতে আবারো সভা বসলো। তবে এ সভা বিচারের সভা নয়, এ সভা ছিলো দাদাজানের মানত পূরণের সভা। আমার ছোট ফুফুর বাসা ছিলো আমাদের বাসার খুব পাশেই তাই আমাদের পারিবারিক যে কোন সভায় তার উপস্থিতি ছিলো বাধ্যতামূলক। ছোট ফুফু প্রস্তাব করলেন একটা মোরগ জবাই করে দুই তিন জন গরীব লোক ডেকে খাইয়ে দেবার জন্য। তার যুক্তি ছিলো যেহেতু আমাকে কেউ ধরে নিয়ে যায়নি এবং কোন দূর্ঘটনাও ঘটেনা তাই মোরগ জবাই করে মানত পূরণ করলেও আল্লাহ খুশী থাকবেন। ছোট ফুফুর কথা শুনে দাদাজান চটে গেলেন গরম গরম কিছু কথাও শুনিয়ে দেন সাথে সাথে, দাদাজানের তিরস্কার পেয়ে ছোট ফুফু সভা থেকে ওয়াক আউট করলেন। আমার বাবা তখন লন্ডনে থাকার কারণে সভায় তিনি অনুপস্থিত ছিলেন, তাই দাদীজান প্রস্তাব করলেন একটা ছাগল বা খাসী কুরবানী করে গরীবদের মধ্য ভাগ করে দেয়া যেতে পারে। দাদাজান আবারো রেগে গিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। দাদাজানের রেগে যাওয়া মানেই অনশন আসন্ন!! রাতেই তিনি না খেয়েই থাকলেন, সকালে আবারো ছোট ফুফুসহ অনেকেই এসে দাদাজানে অনশন ভঙ্গ করালেন এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে একটা গরু জবাই করে গরীব মিসকিনদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হবে।
পরদিনই একটা গরু কিনে জবাই করে দাদাজান তার মানত পূরণ করেন। এই পুরো ঘটনা আমি বেমালুম ভুলে গেছি, খুব একটা মনে নেই। গতকাল রাতে হঠাৎ করেই প্রসঙ্গক্রমে আমার মা এই হাস্যকর ঘটনা বলছেন আর হো হো করে হেসে উঠছেন সেই সাথে তার চোখের কোণ দিয়ে পানি ঝরতেও দেখেছি। আমার দাদাজান মারা গেছেন অনেক দিন হলো। দুই একটা বাদে তার প্রায় সবগুলো স্মৃতি আমার মাথা থেকে মুছে গেছে। কিন্তু যখন তার কবরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাই তখনি থমকে দাঁড়াই আর মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি হে আল্লাহ তুমি আমার দাদাজানকে বেহেস্ত নসীব করবো। আমীন।