ডিসিসিকে চাঁদাবাজমুক্ত করার কলা-কৌশল
আমরা ক্রমশ চাঁদাবাজদের দ্বারা আক্রামত্ম হচ্ছি। আক্রামত্ম হচ্ছে বড়-মাঝারি আর ছোট ব্যবসায়ীদের সাথে সাথে ফুটপাতের ÿুদ্রতর ব্যবসায়ীরাও। এই চাঁদাপাজদের দৌড়াত্মের কারনে নতুন করে বাড়ছে পণ্য সামগ্রীর দাম। কেননা, ব্যবসায়ীরাতো আর এই চাঁদার টাকা বাড়ি থেকে এনে দেবে না; ক্রেতার কাছে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি নিয়ে তবেই চাঁদার টাকা পরিশোধ করবে। বলা যায় অনেকটা বাহারি পণ্যের মত; বিশেষ করে ফেয়ার এন্ড লাভলী, লাক্স অথবা পেপসোডেন্ট। এই পণ্যগুলোর এতমাত্রায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয় যে, প্রায় প্রতিদনই দাম বাড়ে। তাদের বিজ্ঞাপন দেয়ার জরিমানা হিসেবে যেখানে দেশি সাবান পাওয়া যায় ২০ থেকে ২২ টাকা; সেখানে লাক্স সাবান কিনতে হয় ২৫ থেকে ৩৩ টাকায়। সে যাইহোক, বলছিলাম চাঁদাবাজির কথা। একটি পরিসংখ্যানে জানা যায়, ঢাকা দÿÿণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনে প্রায় ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে। আর সেই ডিসিসি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৮টি ক্রাইম জোনে বিভক্ত। প্রতিটি জোনে সমানভাবে চলছে তথাকথিত ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও সেচ্ছাসেবকলীগের পাশাপাশি পুলিশের চাঁদা বাণিজ্য। নগরীর ব্যসত্মতম এলাকাগুলোতে ফুটপাতে প্রায় এক লাখ ভাসমান দোকান রয়েছে। দোকানের আয়তনভেদে চাঁদার হার নির্ধারণ করে দেয় লাইনম্যানরা। এই লাইনম্যানরা মূলত স্ব স্ব এলাকার সরকার দলীয় রাজনৈতিক কর্মী; পাশাপাশি পুলিশের সাথে সখ্য গড়ায় স্থানিয় থানা পুলিশের সাথে লিয়াজো করে প্রতিটি থানা এলাকায় নির্দিষ্ট রম্নটে নির্দিষ্ট অংকের চাঁদা আদায় করে। লাইনম্যানদেরা এলাকাভেদে সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক ভাতা দেয় সংশিস্নষ্ট থানা পুলিশকে। ফুটপাতে এসব দোকান প্রতি সর্বনিম্ন চাঁদার হার প্রতিদিন ৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০০০ টাকা পর্যমত্ম নির্ধারিত। গড়ে ১৫০ টাকা করে এক লাখ দোকান থেকে প্রতিদিন চাঁদা ওঠে প্রায় এক কোটি টাকা। এ হিসাবে পুরো রমজানের এক মাসে সরকার দলীয় নেতাকর্মী ও পুলিশের চাঁদা বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৪৫ কোটি। তবে হকাররা একটি সংবাদপত্রকে জানিয়েছে, বিশ রমজানের পর থেকে চাঁদার হার আরও বাড়বে। যা ক্ষেত্র বিশেষে ১৫০০ টাকা পর্যমত্ম উঠবে। পাশাপাশি স্থানীয় মহাজোট-এর নেতারাও বড় অংকের চাঁদা আদায়ের জন্য বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে হানা দেয়।
তবে ফুটপাতের এই চাঁদাবাজরা দোকান প্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা করে চাঁদা ওঠায়। এক লাখ দোকান থেকে মহাজোটের নেতাকর্মীরা প্রতিদিন চাঁদা তোলে অমত্মত ৪০ লাখ টাকা। মাসে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১২ কোটি টাকা। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার তরফ থেকেও সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে ফুটপাত চাঁদাবাজির বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে। ওই রিপোর্টেও চাঁদার পরিমাণ এরকমই উলেস্নখ করা হয়েছে। সবমিলিয়ে পুলিশ ও মহাজোটের নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে ওঠানো চাঁদার পরিমাণ মাসে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। সেই সূত্র ধরে বলা যায় যে, ডিসিসিতে প্রতিদিন ২ কোটি টাকার ফুটপাত চাঁদাবাজি চলছে। যার পুরো দায়দায়িত্ব সরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের নয়। এখানে রয়েছে মহাজোট সরকারের শরীক ওয়ার্কাস পার্টিও রাশেদ খান মেনন, জাসদের হাসানুল হক ইনু, যুবলীগের সভাপতি ওমর ফারম্নক চৌধুরী, সেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পংকজ দেবনাথ, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, আসলামুল হক এমপি, ইলিয়াস মোলস্না এমপি, আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি, মোসত্মফা জালাল মহিউদ্দিন এমপিসহ শতাধিক নেতার পাশাপাশি সরাসরি পুলিশের বড় কর্তাদের ইন্ধন। যে কারনে নতুন করে চাঁদাবাজদের উত্থান ঘটছে। যা আমাদের কারো কাম্য না হলেও, হতে হচ্ছে চাঁদাবাদের বলি। ডিসিসিতে পুলিশ ও সরকারি দলের চাঁদাবাজ চক্রের বেপরোয়া ফুটপাত চাঁদাবাজির কারনে মানুষ শামিত্মতে ব্যবসা করতে পারছেনা, পারছে না কেনা কাটা করতেও। ডিসিসির বিভিন্ন এলাকার ফুটপাত থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা ওঠানো হচ্ছে। এছাড়াও রাজধানীর অধিকাংশ থানার ওসিদের ড্রাইভাররা ফুটপাতে চাঁদাবাজির সঙ্গে ওৎপ্রত জড়িত হচ্ছে। একটি পত্রিকার সাংবাদিক সরেজমিনে কথা বলে ও সংশিস্নষ্ট সূত্রর উদ্ধৃতি দিয়ে উলেস্নখ করেছে যে, রাজধানীর পূর্ব অঞ্চল যাত্রাবাড়ী থেকে শুরু করে দক্ষিণে সদরঘাট, পশ্চিমে মোহাম্মদপুর, উত্তরে তুরাগ থানা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিভিন্ন জনবহুল পয়েন্টে নির্ধারিত লোক রয়েছে, পাশাপাশি রয়েছে সংশিস্নষ্ট থানার নির্ধারিত পুলিশও। প্রতিদিন বিকেল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্দিষ্ট লোকেরা এ চাঁদা ওঠায়। রাজধানীর পোস্তগোলা, জুরাইন, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, টিকাটুলি, মতিঝিল, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, পল্টন, দৈনিক বাংলা, বঙ্গবাজার, মিরপুর, নীলক্ষেত, নিউমাকের্ট, গাউছিয়া, ঢাকা কলেজের সামনে, মালিবাগ, মৌচাক, মগবাজার, মহাখালী, বাড্ডা, খিলক্ষেত, উত্তরা, মিরপুর, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, গাবতলী, এয়ারপোর্ট এলাকায় ফুটপাত চাঁদাবাজি বেশ জমজমাট। এর মধ্যে শুধু মতিঝিল, গুলিস্তান ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় অন্তত বাইশ হাজার হকার রয়েছে। পল্টন এলাকায় চাঁদা ওঠান কবির নামে একজন দলীয় চাঁদাবাজ, সে ওয়ার্কার্স পার্টির যুব সংহতির নেতা বলে জানা গেছে। প্রতিদিন বিকাল ৩টার দিকে তিনি ওই্ এলাকার ফুটপাতের দোকানগুলো থেকে চাঁদা তোলেন। দোকানভেদে সর্বনিম্ন চাঁদার পরিমাণ ২০০ টাকা। সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। গুলিস্তানে জিপিও থেকে শুরু করে পুরো গুলিস্তান এলাকায় কয়েকজন নেতা চাঁদা ওঠায়। এরা হলো সালাম, দেলু ও বিমল বাবু। এখানে সর্বনিম্ন চাঁদার পরিমাণ দোকান প্রতি ২০০ টাকা। সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা দিতে হয় এখানকার ফুটপাত ব্যবসায়ীদেরকে। মতিঝিল এলাকায় মকবুল ও রহিম নামে দুজন চাঁদা ওঠায়। এ এলাকার হকারদেরকে ২০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। একইভাবে দৈনিক বাংলা এলাকায় চাঁদা তোলার দায়িত্বে রয়েছেন হেলাল। সর্বনিম্ন ৩০০ থেকে ৮৫০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয় প্রতিটি দোকান থেকে। গুলশান, উত্তরাসহ অভিজাত এলাকায় চাঁদার হারও তুলনামূলকভাবে বেশি। গুলশানে আবদুর রহিম লাইনম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই এলাকায় প্রতিদিন দোকানভেদে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয় লাইনম্যানকে। উত্তরাও চাঁদার হার একই। ফার্মগেট এলাকায় আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে লিয়াজোঁ করে চাঁদা তোলে পুলিশ। এখানকার দোকানদারকে সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। স্থানীয় ওই নেতার লোক বলে পরিচিত দুলাল ও শাহ আলম প্রতিদিন সন্ধ্যার পর চাঁদা তুলে নিয়ে যায়। যার এক ভাগ চলে পুলিশের কাছে। নিউমার্কেট এলাকায় রফিক ও সাত্তার লাইনম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন। ওই এলাকার প্রায় বিশ হাজার হকারের কাছ থেকে প্রতিদিন টাকা ওঠানো হয়। মালিবাগে রয়েছেন মকবুল। এই দুই স্থানেও দোকান প্রতি প্রতিদিনের চাঁদার হার সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত ধার্য করা রয়েছে। মোহাম্মদপুরে দায়িত্বপ্রাপ্ত লাইনম্যান আবদুলvহ। তিনি দোকানপ্রতি প্রতিদিন ৫৫ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলেন। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় ট্যাঙ্গা হাবীব চাঁদা ওঠান দোকানভেদে ১৫০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা। মিরপুর ১ নম্বর সেকশনে সুরুজ ও সানাউলvহ চাঁদা তোলেন। গেছে, তুরাগ, মহাখালী, বাড্ডা, রামপুরা, মৌচাক এলাকার ফুটপাতগুলোতেও একই পদ্ধতিতে চাঁদা ওঠানো হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে মিরপুর এলাকায় একচেটিয়া চাঁদাবাজি করছে এখলাস উদ্দিন মোলস্না ও ইলিয়াস মোলস্নার লোকজন। যদিও এব্যাপরে গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনের ডিসি মাসুদুর রহমান বলেছেন, পুলিশের পক্ষ থেকে চাঁদা তোলার কোন তথ্য তাদের জানা নেই। এমতস্থায় চাঁদাবাজি রোধ করতে যা করতে হবে, তা হলো- চাঁদাবাজ যেই হোক, দেশ ও মানুষের শামিত্ম সুখের কথা ভেবে সরকারকে নিতে হবে নিরপেÿ পদÿÿপ। তা না হলে দেশের মানুষ বিÿুদ্ধ হয়ে উঠবে। যা হবে বর্তমান সরকারের জন্য পরাজয়ের সূত্র। আর তাই সরকারের সাফল্যময় আগামীর জন্য যা করতে হবে, তা হলো- প্রতিটি থানায় বিশেষ বার্তা পৌছানো যে, চাঁদাবাজ সে, যে-ই হোক গ্রেফতার করো এবং সাথে বিচারের ব্যবস্থা করো।
এই একটি মাত্র কৌশলে স্বরাষ্টমন্ত্রী কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়ে এগিয়ে গেলে চাঁদাবাজী বন্ধ হবে। কেননা, যখন চাঁদাবাজ দেখবে তাঁর সামনেই সরকার দলীয় নেতা অথবা কর্মীর চাঁদাবাজীর ঘটনায় সাজা হয়ে গেছে; কোন রকম জামিন বা তদ্বীর-এ কাজ হয়নি। তখন নিজেতো দৌড়ের উপর থাকবেই অন্যদেরকেও সাবধান করে দেবে। তাতে করে কালোমেঘ মুক্ত হবে বাংলাদেশের রাজধানী। ঈদে চাঁদাবাজি ও হয়রানি বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত-ই হলো সর্বোচ্চ কৌশল। এই কৌশলে কোন ছাড় বা মাফ নয়; কঠোরতর হয়ে উঠতে হবে সংশিস্নষ্টদেরকে। আশাকরি, তাহলেই আমাদের আগামী হবে বয়ে চলা নদীর মত সুন্দর-স্বচ্ছ ও ছন্দিত…
মোমিন মেহেদী : রাজনীতিক ও কলামিস্ট
www.mominmahadi.com