অপহৃত জেলের শিশুকন্যার আকূতিঃ ‘নতুন জামা লাগবেনা, মোর বাবারে আইন্না দেন’
জাফরুল হাসান রুহান, বরগুনা থেকে,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ ‘বাবায় যাওনের সময় মোরে কোলে লইয়া আদর করইর্যা কইয়া গ্যাছে, মনু, এইখাব সাগরে যাইয়্যা মাছ বেইচ্চা যে টাহা পামু, হেইয়্যা দিয়া তোমার লইগ্যা জামা-কাফুর কিইন্না আনমু। মজা কিন্না আনমু। হেরে বোলে ডাহাইতে ধইর্যা লইায়্যা গ্যাছে। মোর জামা-কাফুর লাগবেনা। আমহেরা মোর বাবারে আইন্না দেন’। ঘরে ভেতর থেকে তখন ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ। জলদস্যূদের হাতে জিম্মি পাথরঘাটার বাদুরতলা গ্রামের ইউনুস মাঝির পাঁচ বছরের মেয়ের সুমাইয়া বাবাকে ফিরে পেতে এমন আকূতি শুনে চোখের জল বাধা মানেনি মা খাদিজার। জলদস্যূদের হাতে জিম্মি পাথরঘাটার ৫৫ টি জেলে পরিবারে এখন শোকের মাতম। এইতো ক’দিন পরেই ঈদ। সারা মৌসুমের কৃপনতার পর বঙ্গোপসাগর যখন দানের হাত খুলতে শুরু করেছে তখন আশায় বুক বেuঁধ সাগরে মাছ শিকারে যাওয়া জেলেদের ওপর সংঘবদ্ধ জলদস্যু চক্র হামলা অপহরণ করেছে এসব জেলেদেরকে।
এমন চিত্র জেলে মাঝি জাকিরের পরিবারের। স্বামীকে হারিয়ে একদিকে যেমন ম্লান হয়েছে ঈদের আনন্দ, অপরদিকে মুক্তিপনের টাকা জোগারে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন জেলে জাকিরের স্ত্রী আসমা বেগম। আসমা বলেন ‘হারাডা বচ্ছর চাইয়্যা রইছি কহন গাঙ্গে ইলিশ পড়বে। ইলিশের আশায় দাদন আইন্না খাইছি, দেনা অহইছি। যহন কিছু মাছ পড়া ধরছে আশা হইর্যা হ্যারে (স্বামী) কে ট্রলারে পাডাইছিলাম। মোগো কপাল তো এহন পোড়ছে। ঈদ দিয়া কী হরমু। এহন হ্যারে ফিরাইয়া আনতে পারলে আর সাগরে যাইতে দিমুনা। লাগলে রিকশা কিইন্না চালাইতে কমু। তোমো (তবুও) আর সাগরে পাডামুনা। জেলে কাওসারের আমেনা বেগম ছেলে অপহরণের খবরে নির্বাক প্রায়। ছেলের সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ডুকরে কেঁদে ফেলেন। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, মোর পোলাডারে একবার আইন্না দেন। চাইর দিন ধইর্যা বাবা মোর মোহে খাওন ওডেনা। অর চিন্তায় মুই এক রাইতও গুমাইতে পারিনা। বাছায় যেদিন সাগরে গ্যাছে, মোরে কইয়্যা গ্যাছে, মা ঠিকমত খাওয়া দাওয়া হইর্যো। এইবার আইয়া তোমারে ভালো ডাক্তার দেহামু। মোর পোলাডারে আইন্না দেন। বলেই অঝোরে কাঁদতে শুরু করেন বৃদ্ধা আমেনা বেগম। একই অবস্থা অপহৃত ট্রলার মাঝি ওহিদুল, মাঝি ইউনুছ, হারুন মল্লিক, মতিয়ার রহমান, রহিমসহ অপর জেলে পরিবারগুলোর। এসব জেলে এখন জলদস্যূদের হাতে বন্দি।
দস্যূদের হাতে জিম্মি জেলেদের নির্যাতন ও হত্যা করা হতে পারে এমন আশংকায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ট্রলার মালিক বলেন,সারা মৌসুমে ইলিশ নেই। একাধিকবার লস দিয়েও এবার অনেক আশা নিয়ে ট্রলারে জেলেদের সাগরে পাঠিয়েছিলাম। কারণ, সাগরে ইলিশের দেখা মিলছে। আমাদের মত আরও অনেকেই এবার লস কাটিয়ে আয়ের আশায় সাগরে যাত্রা করে। কিন্তু ওৎ পেতে থাকা জলদস্যূরা এ সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে। এখন আমাদের যেমন দূর্দিন, তেমনি অসহায় জেলে পরিবারের সদস্যদের মুখের দিকেও তাকানো যায়না। সামনে ঈদ। এই মুহুর্তে এমন ঘটনায় আমরা দিশেহারা। বছরের প্রায় ছয়মাসই জেলেদের দাদন দিয়ে চালাতে হয়। মৌসুমের অর্ধেক পেরুলও ইলিশের দেখা মেলেনি। এ অবস্থায় জলদস্যুদের দাবীকৃত মুক্তিপন দিয়ে ট্রলার ও জেলেদের ছাড়িয়ে আনা একেবাড়েই অসম্ভব হয়ে পরেছে। আমাদের দিকে কেউ তাকায়না। আমাদের আশপাশেই দস্যূদের গুপ্তচর আছে। যে কারনে এমন ঘটনা ঘটানো সম্ভব হচ্ছে। সরকারের আমাদের দিকে নজর দেয়া উচিৎ। নইলে আমাদের মরন ছা্ড়া উপায় নেই।
জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা চৌধুরি বলেন, জেলেদের নিয়েই আমাদের ব্যবসা চলে। তাদের সুখে দুখের সবসময়ই আমরা পাশে থাকি। কিন্তু গত কয়েক মৌসুম ধরে ইলিশের আকালে একদিকে যেমন আমরা নিঃস্ব, তেমনি জেলেরাও অসহায়। এ অবস্থায় জলদস্যূদের মুক্তিপন বানিজ্যে আমরা দিশেহারা। প্রত্যেক ট্রলার মালিককেই কোন না কোন সময় মুক্তিপনের টাকা দিয়ে জেলেদের ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে। এবছর মৌসুমের মাঝামাঝি সময় এসে এ ধরনের হামলায় আমরা দিশেহারা। জেলে পরিবারগুলোকে মুক্তিপনের টাকা দিতে পারছিনা আর। এ অবস্থা চললে সাগরে ইলিশ শিকার বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই।
জেলে সমিতির সভাপতি আবদুল মান্নান মাঝি বলেন’ আমরা প্রতিবছরই সরকারকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব এনে দেই। এনে দেই বৈদেশিক মুদ্রা। অথচ জলদস্যু দমনে সরকারের নেয়া পদক্ষে আমাদের রক্ষা করতে পারছেনা। নৌ-যান ও লোকবল সংকটে কোস্টগার্ড আমাদের সহায়তা করতে পারছেনা। জেলেদের প্রায় সবাই ই হতদরিদ্র। এদের অনেকের নিজের বসতির জন্য জমিটুকুও নেই। নেই মাথা গোজাঁর উপযোগী বাসস্থান। এদের অনেকেই মহাজনদের কাছে ঋনগ্রস্ত। পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋন নিয়ে এদের সংসার চলে। অপেক্ষা ইলিশের। কিন্তু সাগরে ইলিশ ধরা দিলেই বেড়ে যায় দস্যূদের উৎপাত। মুক্তিপন আদায়ের এ বানিজ্য বন্ধ না হলে আমাদের মরন ছাড়া উপায় নেই।
কোস্টগার্ডে পক্ষ থেকে অভিযানের কথা বলা হলেও জিম্মি জেলেদের অবস্থানের ব্যাপারে সু-নির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই। বেরী আবহাওয়ার কারনে তাদের অভিযান পরিচালনা ব্যহত হচ্ছে। ফলে মুক্তিপন ছাড়া অপহৃত জেলেদের উদ্ধারের সম্ভাবনা ক্ষীন হয়ে দেখা দিয়েছে। দিন যত যায়, ততই জিম্মি জেলেদের ওপর নির্যাতন বাড়ে। ঈদে সুমাইয়াদের নতুন জামাকাপড় নয়। মুক্তিপন জোগাড়ের জন্য এখন দিগ্বিদিক জ্ঞানশুণ্য ছুটছেন জেলেদের স্বজনরা।