কেউ পালন করেননি মাহবুবের মৃত্যুবার্ষিকীঃ২১শে আগষ্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত শেখ হাসিনার দেহরক্ষী নিহত মাহবুবের পরিবার চরম অর্থকষ্টে
পি.এম. সিরাজ, কুষ্টিয়া প্রতিনিধি,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের একজন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেহরক্ষী মাহবুব। একসময় অনেকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন তাদের খোঁজ-খবর রাখে না কেউ। মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে মিলাদ মাহফিলেও কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায় না। শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করা কুষ্টিয়ার খোকসার ছেলে মাহাবুব রশিদের বাবা-মা, ভাই-বোন আজও নিদারুন কষ্টে জীবনযাপন করছেন। অর্থাভাবে দু’বোনের বিয়ে হচ্ছে না। সাহায্য সহযোগিতা যা আসে তা হতভাগ্য বাবা মায়ের হাত পর্যন্ত পৌঁছায় না। অসহায় এ পরিবারটির খোঁজখবর এখন আর কেউ রাখে না। মাহবুবের স্ত্রী শামীমা আক্তার আসমা বলেন, ‘‘আমাদের কষ্টের শেষ নেই। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ পরিবারে। অভাবের সংসারে বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট থেকে ২ হাজার এবং পেনশন তহবিল থেকে পাই ৬ হাজার টাকা। মোট ৮ হাজার টাকা দিয়ে কুষ্টিয়া শহরে ভাড়া করা বাড়িতে কোনো মতে বসবাস করে আসছি।’’ ‘‘বড় ছেলে আশিকুজ্জামান আশিক এসএসসি পাস করেছে। ছোট ছেলে আশরাফুজ্জামান আনাজ পড়ে দশম শ্রেণিতে। অভাবের সংসাদের তাদের লেখাপড়া সম্পন্ন হবে কিনা এ নিয়ে তার দুঃচিন্তার শেষ নেই। স্বামীর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এ জন্য তিনি কৃতজ্ঞ।’’তবে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ যদি আরেকটি বাড়িয়ে দিতে তাহলে ছেলেদের লেখাপড়া নিয়ে আর কোনো চিন্তা থাকতো না। একই সঙ্গে তার স্বামীর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন আসমা।
মাহাবুবের স্ত্রী ও সন্তানরা মোটামুটি জীবন ধারণ করতে পারলেও মাহাবুবের হতভাগ্য পিতা হারনুর রশিদ নিদারুন অর্থকষ্টে আছেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারানোর পর থেকে সংসারে অভাব-অনটন লেগেই আছে। অর্থাভাবে বিবাহযোগ্য দুই মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পারছেন না। বিয়ের জন্য মাহাবুবের পিতা হারুনুর রশিদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করলে তিনি পাত্রদের চাকুরি দিয়ে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। বিয়ের কথাবার্তা এক প্রকার পাকা করে চাকzুরর জন্য বার বার শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার জন্য ঢাকা গেলেও দেখা করতে পারেননি। নিজে পরের জমিতে কাজ করে আর দুই ছেলে ভ্যান চালিয়ে যা আয় হয় তা দিয়েই কোন রকম দুই বেলা দু’মুঠো ভাতের ব্যবস্থা হয়। প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় দুই ছেলের এক জনের চাকzুর হয় ঢাকার একটি গার্মেন্টসে, আরেক জনের হোটেলে। গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর তিন মাসের মাথায় হোটেল থেকে ছাঁটাই করে দেয়ায় মাহাবুবের দুই ভাই এখন ভ্যান চালিয়ে খায়। মাহাবুবের পিতা হারুনুর রশিদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলে শেখ হাসিনার জন্য জীবন দিলেও কেউ আমাদের খোঁজখবর রাখে না। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা কখনও ভুল করেও মাহাবুবের বাড়ির দিকে পা বাড়ান না। খোকসা উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সদর খান মাহাবুবের নামে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসার ফুলবাড়িয়ায় একটি সড়কের নাম ও স্মৃতিস্তম্ভ করার কথা ঘোষনা দিলেও আজও তা হয়নি। মাহবুবের অবিবাহিত দুই’বোন (আবেদা-শিরিনা) সদর খানকে ব্যঙ্গ করে বলেন, তার জন্যই আমরা আজ সব কিছু থেকে বঞ্চিত। দলের অন্য সবাই আমাদের সাহায্য সহযোগিতা দিতে গেলেও তিনি বাঁধা দেয় বলেও অভিযোগ করেন তারা। এমনকি এ বছর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ২১ আগস্ট মাহাবুবের মৃত্যুবার্ষিকীটিও পালন করেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার সময়ে তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে কুষ্টিয়ার হাশিমপুরের কর্নেল জামিল নিহত হয়েছিলেন। এরপর ঠিক ৩০ বছর পরে আবারো শেখ হাসিনার প্রাণ রক্ষায় নিহত হন কুষ্টিয়ার আরেক কৃতি সন্তান মাহবুব।
নিহত মাহাবুবের পিতা হারুনুর রশিদ স্মৃতি হাতড়ে জানান, একদিন কুষ্টিয়ায় সেনাবাহিনীতে লোক নেয়ার আহবান করা হয়। মাহবুব গিয়ে লাইনে দাঁড়ান। তারপর টাকা ধার করে বহু কষ্টে ঢাকায় গিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এখান থেকে মাহবুবের যাত্রা শুরু। আওয়ামীলীগ সভানেত্রীর দেহরক্ষী হিসেবে মাহাবুব যোগদান করেন ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে। এর আগে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক নির্ভীক সেনা, একজন ল্যান্স কর্পোরাল। ১০ ভাই বোনের মধ্যে তার অবস্থান দ্বিতীয়, নিজ গ্রামেই কেটেছে তার দুরন্ত কৈশর। এস.এস.সি পাশের পর দরিদ্র পরিবারের দ্বিতীয় ছেলে মাহাবুবের পড়াশুনা আর এগোয়নি। জীবন ও জীবিকার তাগিদে ১৯৮৭ সালে মাহাবুব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক পদে যোগ দিয়ে গাড়ী চালাতে শুরু করেন। বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে তাকে পাঠায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে। ২০০২ সালে ল্যান্স কর্পোরাল পদে থাকা অবস্থায় মাহাবুব চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন এবং ওই বছরই বিরোধী দলীয় নেত্রীর গাড়ীচালক ও ব্যক্তিগত দেহরক্ষী হিসেবে যোগ দেন। এই চাকরিতে মাহাবুবের পূর্ব পরিচিত সাবেক এক সৈনিক শেখ হাসিনার বর্তমান বিশেষ গাড়ি চালক তাকে সহায়তা করেছেন বলে মাহাবুবের পিতা জানান। শেখ হাসিনার ৪০ জন দেহরক্ষীর মধ্যে মাহাবুবের ব্যবহার-আচার ভদ্রতার কারণেই আলাদা করে চেনা যেত।
২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট মাহবুবের ছুটি ছিল। তারপরও জনসভায় যোগ দিতে ঢাকার বাসা থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে হাজির হন সেখানে। বিকাল ৫টা বাজার কিছু সময় পর শেখ হাসিনার বক্তব্য শুরু হয়। ঠিক এমন সময় জনসভার উপরে পড়তে থাকে একের পর এক গ্রেনেড। গ্রেনেড হামলায় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা তার বুলেট প্রুফ গাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সাহসী মাহবুব তাকে গাড়িতে প্রবেশ করতে অনুরোধ জানান। কিন্তু শেখ হাসিনা মাহবুবকে চিৎকার করে বলে, না আমি যাব না, ওরা মারে আমাকে মারুক। নেত্রীর সে কথায় কান না দিয়ে মাহবুব বুক দিয়ে আগলে গাড়ির মধ্যে তাকে ঠেলে দেন। আর ঠিক এ সময় ঘাতকের একটি বুলেট তার মাথার পেছন দিয়ে প্রবেশ করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আরো কয়েকটি গুলি তার বুককে বিদ্ধ করে। সেখানেই পড়ে থাকেন জননেত্রীর দেহরক্ষী মাহবুব। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে দ্রুত উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সব চেষ্টা বিফল হয়। ২১ আগস্ট রাতেই মাহবুব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
গ্রেনেড হামলায় নিহত মাহবুবের লাশ পরদিন ২২ আগস্ট খুব সকালে খোকসা উপজেলার ফুলবাড়িয়া হাইস্কুলের মাঠে হেলিকপ্টারে এসেছিল। তখন বৃদ্ধ পিতা হারুনুর রশিদ মোল্লা মাঠে কাজ করছিলেন। হেলিকপ্টারের বিকট শব্দে চারদিক থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে ফুলবাড়িয়া হাই স্কুল মাঠে মাহবুবকে দেখতে। পরিবারের ভরণ-পোষণের পাশাপাশি সকল কিছুই চলতো তার তদারকিতে। মাহবুবের অবর্তমানে তার পরিবারটি দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। বৃদ্ধ পিতার ৪১ শতক জমি চাষ করে সংসার চলে না। তার ওপর দুটি বিয়ের উপযুক্ত মেয়েকে লেখাপড়া করানো তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।