মফস্বল সাংবাদিকতা
জাফরুল হাসান রুহানঃ বেশ কয়েক বছর ধরে আছি সংবাদিকতা পেশার সাথে। পেশা না বলে বরং নেশা বলাটাই বেশী ভালো। কারণ মফস্বলে যারা সাংবাদিকতা করে তারা নেশার কারণেই সাংবাদিকতা করে বলে আমার ধারনা। অনেকটাই নিজের খেয়ে বনে মহিষ তাড়ানোর মতো। নেশার কারণে সংবাদিকতা করে বলার কারণ, প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকে উপজেলা বা জেলা প্রতিনিধিরা বেতন পায়না, পায় সম্মানি। একজন উপজেলা প্রতিনিধির সম্মানি হলো ৫০০ টাকা (কিছু কিছু উপজেলা বেশী পায়)। অনেকেই ভাবছেন না না তা হয় কি করে? এটা অসম্ভব। কিন্তু ঘটনা সত্য। একজন প্রকৃত এ্যাকটিভ সংবাদিকের ৫০০ টাকা সম্মানিতে অন্য থরচ তো পরের কথা মোবাইল ফোনের ৩ ভাগের ১ ভাগ হতে পারে। তাহলে কি বলবেন পেশা না নেশা? যা ইচ্ছে বলতে পারেন কারণ মত প্রাকাশ করবেন আপনি? ঘটনার কিন্তু এখানেই শেষ নয়! সবে শুরু। রাজনৈতিক নেতারা মঞ্চে উঠে অনেক বড় বড় বুলি আওড়ান “সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে শিখুন” সাংবাদিক ভাইদের প্রতি অনুরোধ আপনারা সমাজের দরপর জাতির বিবেক আপনারাই পারেন সমাজের নানা অসংগতি তুলে ধরে সমাজকে বদলাতে। কিন্তু রাতের আধারে ঐ নেতার চামচারা রাস্তার সরকারী গাছ কেটে সাবাড় করেন সেই সংবাদটি পরের দিন সকালে খবরের কাগজে ছাপা হলে শুধু সেই সংবাদিক কেন পরিবারের কারোই প্রাণ থাকে না। প্রকাশ্যে বাড়ির সমনে দাড়িয়ে খুনের হুমকি দেওয়া হয়। সাংবাদিকের ১৪গুষ্টি উদ্ধার করে ছেড়ে দেওয়া হয়।আর প্রাণের ভয়ে না ছাপলে সকাল বেলা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে জনগণ বলবে সাংবাদিকরা টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। কিন্তু ছাপার কারণে যখন রাস্তায় ধরে আমার বোনে আপমান করা হবে, আমার বাবাকে বা আমাকে লাঞ্চিত করা হবে তখন কিন্তু চায়ের দোকানে বসা একজনও মুখ খুলবেন না।অনেকেই ভাবছেন আপনাদের বিষয়টাতো পত্রিকা অফিস দেখবে, দেখবে সম্পাদক। আছে পুলিশ প্রশাসন। এবারে এ বিষয়ে কটা কথা বলেই শেষ করবো। এলাকায় বড় কোন ঘটনা ঘটলে অফিস থেকে ফোনের উপর ফোন। নিউজ কই, এত দেরি কেন, কি করছেন সারাদিন আর কতক্ষণ? অস্থির করে ফেলবে অফিসের ১৩ বার ফোন ধরতে যেয়ে সংবাদ সংগ্রহ করা কাজে পিছিয়ে যেতে হবে আরো কিছুক্ষণ।সব ভোগান্তি পার করে সংবাদ সংগ্রহ করে যখন ফিরবো তখন আবারো মোবাইল ফোনে অস্তির ভাব খানা এমন যেন বাংলাদেশের একমাত্র আমার মোবাইল আছে। পকেট থেকে ফোন কানে ধরলে শোনা যাবে কোন এক নেতার বর্ষিয়ান কন্ঠ নিউজটা যেন ছাপা না হয়, আত্নীয় এটামার আত্নীয় ভাই সংবাদ না ছাপালে হয় না ওটামার আমার কাছের একটা লোক।কিছু দালাল প্রকৃতির লোক ফোন করে বলবে ভাই কত সংবাদ কোন দিকে যায় ঠিক নাই এটা থাকা কিছু চা-মিষ্টি খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবো ইত্যাদি।নিজের মোটর সাইকেলে তেল পুড়িয়ে, নিজের বাপের টাকায় কেনা ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে, নিজেরে পকেটের জমানো টাকায় কেনা মডেম আর কম্পিউটার ব্যবহার করে সংবাদটি যখন পাঠাতে গেলে দেখা যাবে বিদ্যুৎ নেই। পাশে বেচারী ফোনটা এতিমের মত চিৎকার করছে। অফিস থেকে এবার গালি নিশ্চয় খেতে হবে। কোন রকম হাতে পায়ে ধরে কিছুটা সময় নিয়ে পাঠাতে হয় সংবাদ। এত কিছু করার পরও যদি আপনি সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে পিটুনি খায় বা দূরঘটনার স্বীকার হয় তাহলে কিন্তৃ অফিস বলবে এত তাড়া হুড়োর কি দরকার? আর বিষয়টিতে যখন রিস্ক ছিলো তো ছবি তুলতে গেলেন কেন? না গেলেই পারতে শুধু সংবাদ পাঠাতেন। বাস তাদের সমস্ত দায়িত্ব শেষ।এই হলাম আমরা মফস্বল সাংবাদিক। জাতির বিবেক, সমাজের দরপন। সমাজ বদলানোর দায় কি শুধু সাংবাদিকদের? কি দরকার সমাজকে বদলাতে যাওয়ার? আমার জীবনের কি মায়া নেই? আমার বাবা-মা’র কি আমাকে ঘিরে কোন আশা নেই? স্বপ্ন নেই? আমার বাবা-মা কি আমাকে এত কষ্ট করে মানুষ করেছে রাস্তায় দিয়ে ভরা মজলিশে গালি খাওয়ার জন্য? লাথি খেয়ে রাস্তায় কুত্তার মত মরার জন্য? আমরা যারা মফস্বল সাংবাদিকতা করি তারাকি মানুষ না? অনেকেই ভাবছেন তাহলে করছেন কেন ছেড়ে দিন। আগেই বলেছি নেশা! এত কিছুর পরেও আমরা আছি এ জগতে। কিছু মানুষের ভালোবাসার কারণে।এ ভাবেই চলে মফস্বল সংবাদিকের জীবন।
জাফরুল হাসান রুহানঃ বরগুনা থেকে।