মানসিক রোগীদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানো-ই সময়ের দাবি!
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ মানসিক রোগ বা এর চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাপারে এ দেশের সাধারণ মানুষের ধারণা এখনো সুস্পষ্ট নয়। প্রকৃত অর্থে মানসিক রোগ অন্যান্য শারিরীক রোগের মতো-ই এক ধরনের অসুস্থ্যতা। প্রাচীন কালে মানসিক সমস্যা সমূহে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ‘পাগল’ বলা হলেও, বর্তমানে বিজ্ঞানের আর্শীবাদে যে কোন মানসিক অসুস্থ্যতার চিকিৎসা করা সম্ভব। এই বিষয়টি নিয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৯২ সাল থেকে প্রতি বছর ১০ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যতো বেশি সম্ভব প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করার জন্য জাতিসংঘের সনদের আওতায় বিশেষজ্ঞ সংস্থা হিসেবে অবিরাম কাজ করছে। মানুষের স্বাস্থ্যের সকল দিকের সাথে সর্ম্পকিত যেমন পুষ্টি, মা, ও শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষা, পরিবেশগত নিরাপত্তা, মানসিক রোগ সমূহের নিয়ন্ত্রণের বিশেষ ব্যবস্থা, দূর্ঘটনা রোধ, চিকিৎসা ও পুর্নবাসন ক্ষেত্রের গবেষণা এবং উন্নয়নে সমন্বয় ও সহায়তা করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপ অনুযায়ী যে কোন দেশে গুরুতর মানসিক রোগীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় এক শতাংশ এবং লঘু মানসিক রোগীর সংখ্যা শতকরা প্রায় ১০ শতাংশ। এই সংক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা ও স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকা তাদের অধিকার। এ বিষয়টি উপলদ্ধির প্রেক্ষাপটে পালিত হয় ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’।
আধুনিক বিশ্বে সাইক্রিয়াট্রির বিভিন্ন ধরণের নিত্য নতুন শাখা বা ক্ষেত্র আবিস্কার হচ্ছে। অপরদিকে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে সমান্তরালে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেয়ার প্রয়োজনীয়তাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মদকাসক্তি, নারী ও শিশু নির্যাতন, দারিদ্র, বেকারত্ব, প্রভৃতি কারণে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ চাপের সঞ্চার হয়। বিভিন্ন অর্থ-সামাজিক ও শারিরীক কারণে প্রবীণদের মাঝে মানসিক অসুস্থ্যতার প্রবণতা অন্য বয়সের তুলনায় বেশি বলে এক জরিপে দেখা গেছে। এসব সমস্যা উন্নত বিশ্বের চাইতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ সমূহে প্রকট। এর প্রধান কারণ হলো ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং পাশ্চাত্ত্ব অপ-সংস্কৃতির প্রভাব। অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে এর বিস্তৃতী আরো প্রকট হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষঙ্গ মহল। এমতাবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা ও মাসসিক রোগীদের আধুনিক চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবন যাপনে এগিয়ে নিয়ে আসা বিশ্ব সমাজের কর্তব্য আর এই প্রতিশ্র“তির আলোকেই গণসচেতনতা সৃষ্টি করছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও মানসিক রোগীর স্বাস্থ্য সংরক্ষণে সদা সচেষ্ট। বাংলাদেশও মনে করে মানসিক স্বাস্থ্য সঠিক স্বাস্থ্যরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব না দিয়ে দেশের মূল স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনৈতিক তথা সঠিক উন্নয়ন আদৌ সম্ভব নয়। কারণ মানসিক ভাবে অসুস্থ্য ব্যাক্তির কর্মক্ষমতা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। পারিবারিক দ্বায়িত্ববোধ ও সন্তান লালন পালনে তারা অনেক ক্ষেত্রেই অসুবিধার সম্মুখিন হন। মানসিক রোগীরা সাধারণত পরিবার, বন্ধু বা রাষ্ট্রের উপর বিভিন্ন ভাবে নির্ভরশীল। বিশ্ব ব্যাংকের ১৯৯৩ সালের এক রিপোর্টের আলোকে জানা যায়, মানসিক, স্নায়ুবিক ও আচরণগত সমস্যার কারণে মানুষের কর্মক্ষম জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় নষ্ট হয়। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য সুবিধা অনেক সীমিত। বাংলাদেশের মানসিক বিশেষজ্ঞের সংখ্যাও অপ্রতুল। ২০০০ সালে পত্রিকায় প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েিেছলো তৎকালীণ প্রেক্ষাপটে প্রতি ১৯ লাখ মানুষের জন্য বাংলাদেশে রয়েছেন মাত্র ১ জন সাইক্রিয়াট্রিস্ট বা মানসিক রোগীর ডাক্তার। জনগণের সামাজিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় রেখে রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র শেরেবাংলা নগরে গড়ে তোলা হয়েছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। তাছাড়াও ঢাকার তেজগাঁয়ে রয়েছে কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাস্তবিক রূপে এগুলোর কার্যক্রম কতোটা ফলপ্রসু? সরকারি পরিচালনায় এসকল প্রতিষ্ঠানের অবস্থা অন্ত্যন্ত নাজুক। চিকিৎসা সেবা নিতে আসা এমন অনেকের অভিযোগ এসব কেন্দ্রের প্রতি রয়েছে। তাদের অভিযোগের মধ্যে রয়েছে যারা এসব কেন্দ্রে সুচিকিৎসা পাওয়ার আশায় আসেন তাদেও অধিকাংশ-ই বিবিধ বিড়ম্বনার শিকার হন। এসব কেন্দ্রে সুচিকিৎসার কোন লক্ষণ তো নেই-ই বরং এসব জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে দালালদের এক ধরণের সিন্ডিকেট, যারা অসহায় রোগী বা তাদের আতœীয়-স্বজনদের কাছ থেকে যে ভাবেই হোক টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। এই বিষয় গুলো বারংবার পত্রিকার মাধ্যমে আমরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমাদেও নিতান্ত-ই র্দুভাগ্য কতো সরকার আসে-যায়, কতো কিছুর পরিবর্তন বা পরিবর্ধন হয়, কিন্তু এসব বিষয় গুলো সব সরকারের কাছেই দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায়। আরেকটি বিষয় হলো প্রাইভেট ক্লিনিক। যেহেতু আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ডাক্তারের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল সেহেতু নিজস্ব ক্লিনিক খুলে এসব ডাক্তারদের অনেকেই অবতারনা করেছেন সেবার নামে প্রতারনার জাল। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু ওষুধ কোম্পানি। মানসিক রোগের চিকিৎসায় এখন এমন কিছু ওষুধ রোগীদের সেবন করানো হয়, যেগুলো পরবর্ত্তীতে রোগীকে নেশাগ্রস্থ করে তুলতে পারে। ওষুধ কোম্পানি গুলোর নানাবিধ প্রোলভোনে প্রলুদ্ধ হয়ে ডাক্তাররা এই ধরণের ওষুধ সেবনে রোগীদের বাধ্য করেন। অন্যদিকে, বেসরকারি প্রাইভেট ক্লিনিক সমূহের ব্যয়-ভার এ দেশের নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত লোকদের নাগালের বাইরে। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেকে-ই পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা পাওয়া থেকে নানা ভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই বিষয় গুলোর প্রতি সরকার যদি সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে মানসিক রোগ কোন ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করতে পারবে না। মানসিক রোগীকে দূরে ঠেলে না দিয়ে, তার বা তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িযে দেয়াটা-ই এখন সময়ের দাবি। আর এ লক্ষ্যে প্রয়োজন সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। আমাদের অঙ্গীকার বদ্ধ হতে হবে, মানবাধিকার সমুন্নত রেখে, সৃজনশীল সমাজ গঠনের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মোকে একটি সুন্দর ও নির্মল পৃথিবী উপহার দেয়া…! আর এই ব্রত পালণের মাধ্যমেই উপলদ্ধি করা যাবে ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’ পালনের মূল উপাত্ত!
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।