কোটি কোটি টাকার জাল নোট দেশে ঢুকছে!
নিজস্ব প্রতিনিধি,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ বাড্ডা এলাকার এক মুদি দোকানে কেনাকাটার পর পাঁচশ’টাকার একটি নোট দিলেন সজীব হোসেন। নোটটি হাতে নিয়েই দোকানির সন্দেহ হলো। তিনি বেশ কিছুক্ষণ এটি নেড়ে-চেড়ে পরখ করার চেষ্টা করেন। পাঁচশ’টাকার নোটটি জাল মনে হওয়ায় দোকানি নিতে চাইলেন না। এদিকে ক্রেতাও বলছেন, এটি জাল টাকা নয়, তিনি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাজার করতে এসেছেন। ক্রেতা-বিক্রেতার কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সেখানে লোকজন জড়ো হয়। আরও কয়েকজন নোটটি হাতে নিয়ে যাচাই-বাছাই করে দেখলেন পাঁচশ’টাকার নোটটি আসলেই জাল। বেচারা ক্রেতা তখন বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান। পাঁচশ’টাকার নোট নিয়ে কেনাকাটা করতে গেলে প্রায় সময়ই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। জাল টাকার ছড়াছড়িতে ক্রেতা ও বিক্রেতা কেউ সঠিকভাবে নোটটি আসল না নকল তা সহজে নির্দিষ্ট করতে পারে না।
গোয়েন্দারা বলছেন, সীমান্তের ওপার থেকে কোটি কোটি টাকার জাল নোট দেশে ঢুকছে। তার ওপর রাজধানীতেও ছাপানো হচ্ছে জাল টাকা। এ চক্রে ভারত, পাকিস্তান ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশের নাগরিকও রয়েছেন। এদিকে গত দেড় মাসে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো চারটি অভিযানে প্রায় এক কোটি ৩২ লাখ টাকা মূল্যের জাল নোট ও ১৫ হাজার জাল রুপি উদ্ধার করেছে। এসব অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছে সাতজন। এদের মধ্যে একজন জাল টাকা তৈরির কারিগর। বাকিরা পরিবেশক ও তত্ত্বাবধানকারী। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, দেশে জাল টাকা ধরা পড়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে। এখন পর্যন্ত যেসব জাল টাকার ঘটনা ধরা পড়ছে সেগুলো বেশির ভাগই ৫০০ টাকার নোট। এরপরই রয়েছে ১০০ টাকার নোট। তবে ৫০ টাকা বা এর চেয়ে কম মানের নোটগুলো জাল হচ্ছে খুবই কম।
রাজধানীতে প্রায়ই জালনোটসহ প্রতারক চক্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হচ্ছে, জালনোট তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম। কম্পিউটার, প্রিন্টারসহ জালনোট তৈরির অত্যাধুনিক সরঞ্জাম পাওয়া যাচ্ছে তাদের কাছে।
বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হওয়া প্রতারকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ীর্ যাবের কাছে তথ্য রয়েছে, জালনোট তৈরিতে দেশি-বিদেশি চক্রও জড়িত। আগে সীমান্ত এলাকা দিয়ে জালনোট দেশে আসত। এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে লাখ লাখ টাকার জালনোট, জাল ডলারসহ বিদেশি মুদ্রা। দেশীয় মুদ্রার মধ্যে ৫০০ ও ১০০ টাকার নোট বেশি জাল হচ্ছে। আগে ৫০০ ও ১০০ টাকার নোট জাল হলেও এখন ১ হাজার টাকার নোটও জাল হচ্ছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন।
জালনোট ছড়িয়ে পড়ছে ব্যাংকেও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টেও পাওয়া যাচ্ছে জাল টাকা। আবার কোনো কোনো ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তাও জালনোট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ফলে ব্যাংক থেকে সরবরাহ করা ৫০ হাজার টাকার বান্ডিলের মধ্যেও পাওয়া যায় দু’একটি ৫০০ টাকার জালনোট। সুকৌশলে ব্যাংকের বান্ডিলের মধ্যে জাল টাকা চালিয়ে দেয়া হয়। ইদানীং জাল টাকা এত সূক্ষ্মভাবে তৈরি করা হয় যে, অনেক সময় ব্যাংকের অত্যাধুনিক মেশিনেও তা ধরা পড়ে না। এ অবস্থায় সমস্যায় পড়ে সাধারণ মানুষ। পুলিশ জানায়, জাল নোট তৈরি ও বাজারজাতের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বেশ কয়েকটি চক্র। এদের সঙ্গে কিছু অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িত। তাদের মধ্যে ২১টি চক্রকে শনাক্ত করতে পেরেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
তাদের ধারণা, তারা ২১টি চক্রের সন্ধান পেলেও রাজধানীতে আরো বেশ কিছু চক্র রয়েছে। পুলিশ জানায়, ২১টি চক্রের মধ্যে জাল নোটের কারিগর রয়েছে ১২ জন। আর বাকিরা কেউ তত্ত্বাবধায়ক, কেউ সমন্বয়কারী আবার কেউ পরিবেশক। আর এ পরিবেশকের মাধ্যমেই জাল নোট ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামগঞ্জে। র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, ঈদকে সামনে রেখে টাকা জালিয়াত চক্র সক্রিয় হয় বেশি। এ জন্য র্যা বের গোয়েন্দাদের এই বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরা প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করছে।
আগে নতুন করে নোট ছাপানো হতো। তাতে অবশ্য একটু সাবধানতা অবলম্বন করলেই জাল নোট চিহ্নিত করা যেত। কিন্তু এখন একশ টাকার নতুন নোটের ওপর পাঁচশ টাকার ছাপ বসানো হচ্ছে। দশ টাকার নোটের ওপর বসানো হচ্ছে পঞ্চাশ টাকার ছাপ। এতে সহজেই নোটগুলোকে কেউ জাল বলে চিহ্নিত করতে পারে না। তিনি আরো বলেন, এই সুযোগে কোটি কোটি টাকা মূল্যমানের নোট ছাড়া হচ্ছে বাজারে। এ ব্যাপারে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মশিউর রহমান জানান, জাল টাকা ও এর কারখানার সন্ধানে অনেক আগে থেকেই কাজ করে আসছে গোয়েন্দা পুলিশ। সম্প্রতি এ চক্রের বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
কোরবানির ঈদ সামনে রেখে তাদের তৎপরতা বেড়ে যাবে এমন আশঙ্কায় ডিবি গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। তারই ধারাবাহিকতায় গত দেড় মাসে বেশ কয়েকটি চক্র ধরা পড়েছে। বাকিদেরও গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, “কয়েকটি ধাপে এসব টাকা প্রান্তিক পর্যায়ে সাধারণ মানুষের হাত পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া হয়। যারা নোট তৈরি করে তারা অল্প কয়েকজন পাইকারি কারবারির কাছে এসব নোট বিক্রি করে। সাধারণত এক লাখ টাকার একটি বান্ডিল ৮-১০ হাজার টাকা বিক্রি হয়। পাইকারি কারবারিরা আবার এসব টাকা খুচরা কারবারির কাছে ২০-৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। খুচরা কারবারিরা এসব টাকা নিজস্ব বাহিনীর মাধ্যমে বাজারে ছড়িয়ে দেয়।