শিশুদের ডায়াবেটিসের ছোবল থেকে রক্ষা করুন
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ ১৯৯১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আর্ন্তজাতিক ডায়েবেটিস ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, প্রতিবছর ১৪ নভেম্বর ‘বিশ্ব ডায়েবেটিস দিবস’ পালন করা হবে। দিনটি পালনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে ডায়েবেটিস রোগের লক্ষণ, গতিধারা, চিকিৎসা এবং রোগটি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা সর্ম্পকে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা। ১৪ নভেম্বর ডায়েবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো এই দিন ফ্রেডারিক ব্যাটিং এর জন্মদিন। ফ্রেডারিক ব্যাটিং তাঁর সহযোগী চার্লস বেষ্টকে নিয়ে ডায়েবেটিস রোগ নির্ণয়ের মহৌষধ ইনস্যুলিন আবিস্কার করেন।
ডায়েবেটিস রোগী কর্মক্ষেত্রে নানা ভাবে বৈষম্যের শিকার হন। আর তাই ডায়েবেটিস রোগীদের অন্যান্য নাগরিকের মতো চিকিৎসা সেবা প্রদান ও সেই সাথে তাদের শিক্ষা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকার আইনের অন্যতম প্রধান শর্ত। আর্ন্তজাতিক ডায়েবেটিস ফেডারেশনের ১০০টির বেশি সদস্য ভুক্ত দেশে একই চেতনায় এই দিবসটি পালন করা হয়। বলা আবশ্যক যে, পৃথিবীর উন্নত দেশে যে সব রোগের কারণে মৃত্যু ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা থাকে, সেসব রোগের মধ্যে ডায়েবেটিস এর অবস্থান চর্তুথ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যা থেকে জানা যায়, সারা বিশ্বে ২০০০ সাল পর্যন্ত ডায়েবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি। এ হার অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালে ডায়েবেটিস রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩০ কোটি। বাংলাদেশে প্রতি বছর ব্যাপকভাবে ডায়াবেটিস রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজধানীর শাহবাগের ৬৫০ বেডের ডায়াবেটিস হাসপাতাল (জেনারেল) এবং ডায়াবেটিক সমিতির অধিভুক্ত দেশব্যাপী ৫৬টি কেন্দ্র রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। ডায়াবেটিস মূলত দুই ধরনের। এগুলো হল: টাইপ-১ ও টাইপ-২। টাইপ-২ রোগীদের রক্তের গ্লুুকোজ পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। টাইপ-১ ইনসুলিন নির্ভরশীল ডায়াবেটিস ও টাইপ-২ ইনসুলিন অনির্ভরশীল ডায়াবেটিস। টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে শিশুই বেশি। তাদেরকে ইনসুলিন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারে শিশু থেকে ২০ বছরের নীচের বয়সী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেশি বলে জানা যায়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কোন কোন শিশু-কিশোরের ক্ষেত্রে টাইপ-১ ও ২ উভয় ধরনের ডায়াবেটিসের বৈশিষ্ট্য থাকে। এ ক্ষেত্রে রোগটিকে প্রায়শ: ‘হাইব্রিড’ মিশ্রিত বা দ্বৈত ডায়াবেটিস বলা হয়। শিশু-কিশোরদের ওজনাধিক্য ও মেদবাহুল্যের সাথে এটি সম্পৃক্ত। সম্প্রতি রাজধানীর কয়েকটি স্কুলে জরিপ চালিয়ে দেখা যায় যে, ফাস্ট ফুডে অভ্যস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ডায়াবেটিসের হার বেশি। এই সকল খাবারে অভ্যস্থদের ওজন ও মেদ বেড়ে যায়। পাশাপাশি রক্ত চাপ বাড়তে থাকে। অন্যান্য ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্যসামগ্রী নিয়মিত খাওয়ার কারণেও ডায়াবেটিস হওয়ার আশংকা রয়েছে। দুধে মেলামাইন, তরল দুধ ও ফরমালিন মেশানো মাছ, পোড়া মবিল দিয়ে ভাজা হয় চানাচুর, ইউরিয়া সার ব্যবহৃত বেকারির খাবার, বস্ত্রকল ও ট্যানারির বিষাক্ত রংয়ের সংমিশ্রণে তৈরি হরেক রকম খাদ্যসামগ্রীও ডায়াবেটিস সৃষ্টির অন্যতম চিহ্নিত কারণ।
উন্নয়নশীল বা স্বল্প উন্নত দেশ গুলোতে ইনস্যুলিত অনির্ভরশীল ডায়েবেটিস রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। এক পরিসংখ্যান মতে, শতকরা ৯০ ভাগ ডায়েবেটিস রোগীই ইনস্যুলিন অনির্ভরশীল। অনিয়ন্ত্রিত ডায়েবেটিসের জটিলতায় হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনীর অক্ষমতা প্রভৃতি রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। বাংলাদেশে বারডেমের কেন্দ্রীয় গবেষণা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এক পরিসংখ্যানে দেখিয়েছে যে, ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশে মোট ডায়েবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল ১০ লাখ। ১৯৯৫ সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২৫ লাখে দাঁড়ায়। অর্থাৎ এই হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন-ই ডায়েবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সমান্তরালে বাড়ছে ডায়েবেটিস রোগীদের নানান জটিলতা। গত এক যুগ ধরে নবজাতক থেকে শুরু করে ২০ বছরের কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ডায়াবেটিসের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বাড়ছে। বিষাক্ত খাদ্যসামগ্রীর কারণে ডায়াবেটিস হওয়ার আশংকা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ অভিমত পোষণ করছেন। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি এবং ডায়াবেটিস হাসপাতালের পরিসংখ্যানে জানা যায়, চাহিদার তুলনায় ডায়াবেটিস হাসপাতাল এবং ডায়াবেটিক সমিতির অধিভুক্ত ৫৬টি কেন্দ্রে ও ন্যাশনাল হেলথ নেটওয়ার্কের মাত্র ২০ ভাগ রোগীর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। এই হিসাব অনুযায়ী শতকরা ৮০ ভাগ রোগী-ই চিকিৎসার বাইরে থাকছে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ না করলে পরবর্তীকালে চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট, কিডনি রোগসহ নানা জটিল ব্যাধি হওয়ার আশংকা বেশি থাকে। ডায়াবেটিক সমিতি আগামী ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষে নানা কর্মসূচি নিয়েছে। এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘শিশুরা যে কোন বয়সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে, আসুন, ডায়াবেটিসের ছোবল থেকে শিশুদের রক্ষা করি।’
গবেষকদের ধারণা অনুযায়ী একজন ডায়েবেটিস রোগীর বিষণœতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সুস্থ ব্যক্তির চেয়ে অনেক বেশি। ডায়েবেটিস সর্ম্পকে সুষ্ঠু জ্ঞান না থাকায় এ ধরণের অবস্থার সৃষ্টি হয়। ২০০২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বিষণœতায় একজন ডায়েবেটিস রোগীর চিকিৎসা খরচ একজন সাধারণ ডায়েবেটিস রোগীর চিকিৎসা খরচের প্রায় পাঁচ গুণ। সুষ্ঠু জ্ঞান প্রদানের মাধ্যমে, ডায়েবেটিস রোগীর প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়াই এখন সময়ের দাবি।
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।